সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   শনিবার চাঁদপুরে ৪ শতাধিক নারী-পুরুষের অংশগ্রহণে ম্যারাথন প্রতিযোগিতা
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।

প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা প্রসঙ্গ
এম আবদুল আলীম

সম্প্রতি মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বার্ষিক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তাতে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা খাতে কোনো অর্থ ব্যয় করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কি গবেষণা ওঠে গেছে? ইউজিসির প্রতিবেদন তো সে কথাই বলছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে উদ্বেগের।

এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ এবং লক্ষ্যই তো হচ্ছে বহুমাত্রিক গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানসৃষ্টি এবং এর বিচিত্র শাখার পুষ্টিসাধন। কিন্তু তা হচ্ছে না কেন? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা লয় পাচ্ছে কেন? একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাসূত্রে কিছু প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শেয়ার করতেই এ লেখার অবতারণা।

বঙ্গদেশে প্রাচীন কাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠলেও ইউরোপীয় ধ্যানধারণাপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠে আধুনিক যুগে। পূর্ববঙ্গে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে, সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বর্তমানে তা ১০০ বছরে পদার্পণ করেছে। এরপর একে একে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমান সরকার একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ এবং প্রযুক্তিজ্ঞানে সমৃদ্ধ যুগোপযোগী মানবসম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে চলেছে। সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তবে কী হচ্ছে তা সবাই অবগত। বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ না হওয়ার প্রধান কারণ শিক্ষা এবং গবেষণাসংশ্লিষ্ট অধ্যাপকরা উপাচার্য পদে নিযুক্ত না হওয়া। যারা নিয়োগপ্রাপ্ত হচ্ছেন বেশির ভাগই যুক্ত হয়ে পড়ছেন নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে। ইউজিসির তদন্তে সেসবের প্রমাণ মিলেছে। তদন্তে অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরও শাস্তির আওতায় না আসায় উপাচার্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন; তারা ধরেই নিয়েছেন তাদের কর্মকা- ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফলে একাডেমিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক দুর্নীতি চলছে লাগামহীনভাবে।

উপাচার্যদের অনেকে মনে করছেন, অধ্যাপনা জীবনে তাদের বড় প্রাপ্তি উপাচার্য পদ। তাই এ পদের যতটুকু ক্ষমতা আছে তা প্রয়োগ করে তারা নিজের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আত্মীয়-স্বজন এবং এলাকার মানুষকে পুনর্বাসন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ অপেক্ষা নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখেন। অযোগ্য, অদক্ষ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বারোটা বাজাচ্ছেন। এ কাজ করতে গিয়ে সেই সব উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে তুলেছেন দুষ্টচক্র। যোগদান করেই নানা নীতিবাক্য ছাড়লেও ধীরে ধীরে প্রকাশিত হয় তাদের আসল চেহারা। উপাচার্যের পদ ব্যবহার করে কলমের মাধ্যমে ‘ছিঁচকে চুরি থেকে দুর্ধর্ষ ডাকাতি’ সবই করছেন তারা।

সবচেয়ে বড় কথা, এসব কাজে তারা এতাই নির্লজ্জপনার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেজে উঠছে সর্বনাশের ঘণ্টাধ্বনি। যোগদান করেই শুরু হয় তাদের অপকর্ম। শতভাগ অনুগত লোকদের দিয়ে গঠন করেন সিন্ডিকেট এবং রিজেন্ট বোর্ড; নিয়োগসংক্রান্ত কাজেও যুক্ত করেন শতভাগ অনুগত ব্যক্তিদের। পরস্পর যোগসাজশে নিয়োগ পরীক্ষার নামে প্রহসন করে অযোগ্য-অদক্ষ লোকদের নিয়োগ দিয়ে অতিসংগোপনে গড়ে তুলছেন সম্পদের পাহাড়। আর্থিক লেনদেনের কোনো প্রমাণ না থাকলেও চাকরিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পরিবার এবং এলাকার লোকদের কাছে খোঁজ নিলেই জানা যায়, কেউ জমি বিক্রি করেছেন বা বন্ধক রেখেছেন, কেউ ধারকর্জ বা ঋণ গ্রহণ করে উপাচার্য এবং তার অনুগত ব্যক্তিদের চাহিদা পূরণ করেছেন। বিয়ে করে যৌতুক এনেও কেউ কেউ এসব অর্থের চাহিদা পূরণ করে থাকেন। কর্মচারী নিয়োগে ৫-১০ লাখ, কর্মকর্তা নিয়োগে ১০-১৫ লাখ এবং প্রভাষক নিয়োগে ১৫-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেনের কথা শোনা যায়। সম্প্রতি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য এবং অধ্যাপকদের ফাঁস হওয়া ভিডিওতে দর-কষাকষির মতো নির্লজ্জপনার প্রমাণ দেখেছে দেশবাসী।

বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যদের তল্পিবাহকদের দাপটে গবেষণাসংশ্লিষ্ট শিক্ষকরা নিজ বিভাগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কোণঠাসা। গবেষণায় কোনো বরাদ্দ তো নেই-ই, সুস্থিরভাবে গবেষণা করারও নেই তেমন পরিবেশ। উপাচার্যরা সেই সব শিক্ষককে প্রশাসনিক দায়িত্ব দেন এবং পরামর্শক মনোনীত করেন যারা তোষামোদ, চাটুকারিতা, তেলবাজি এবং অনিয়মে পারদর্শী। কোনো নিয়ম-কানুন এবং আইনের তোয়াক্কা না করে ডিন, চেয়ারম্যান এমনকি প্রভোস্ট, ছাত্র উপদেষ্টা এবং প্রশাসক পদে নিয়োগ দেন। সিনিয়রদের ডিঙিয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষকও পান বড় বড় দায়িত্ব; সবই উপাচার্যের ক্ষমতা। একাডেমিক এবং গবেষণার কাজ বাদ দিয়ে উপাচার্যের আশীর্বাদপুষ্ট সেসব শিক্ষক উপাচার্যের নানা ফাইফরমাশ খাটেন এবং ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। অনেকে ক্লাস পরীক্ষার দায়িত্ব পালন দূরে থাক, বিভাগীয় সভাপতির ফোনও রিসিভ করেন না! তল্পিবাহকদের সঙ্গে নিয়ে উপাচার্য যখন ক্যাম্পাসে মহড়া দেন, মনে হয় মধ্যযুগীয় কোনো রাজা-মহারাজা পুনর্বার ধরাধামে আবির্ভূত হলেন!

বেশির ভাগ উপাচার্য ব্যস্ত থাকেন নিয়োগ, কেনাকাটা, নির্মাণকাজ প্রভৃতির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ তদারকিতে। এটা করতে গিয়ে একাডেমিক এবং গবেষণার প্রতি দৃষ্টি রাখতে পারেন না। কিভাবে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানো যায়, গবেষণাসংশ্লিষ্টদের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা যায়, এসব নিয়ে উপাচার্যদের ভাবার সময় কোথায়? এতে তো তার পরিবার এবং নিজের কোনো স্বার্থ নেই। একজন উপাচার্যের নিজের যেমন গবেষণায় যুক্ত থাকার কথা, তেমনি দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনও জরুরি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এটা চোখেই পড়ে না। ফলে সরকারি যে বরাদ্দটুকু গবেষণা খাতে আসে তা-ও ব্যয় করার সময় তারা পান না।

কিন্তু এভাবে চলতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার উপযোগী করতে হলে প্রথমে দরকার গবেষণাসংশ্লিষ্ট অধ্যাপকদের উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া। একই সঙ্গে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত উপাচার্যদের কর্মকা- যথাযথ তদন্ত করা। প্রমাণ সাপেক্ষে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। মেয়াদ শেষ হলেই যেন তাদের অনিয়ম-দুর্নীতি তামাদি না হয় সেদিকে তীক্ষ নজর রাষ্ট্রকে রাখতে হবে। স্বায়ত্তশাসনের নামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাতে উপাচার্যদের রামরাজত্ব কায়েম না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক কর্মকা- যাতে বিধিসম্মতভাবে স্বচ্ছতার সঙ্গে পরিচালিত হয় সেদিকে ইউজিসি এবং মন্ত্রণালয়ের কঠোর নজরদারি করতে হবে। রিজেন্ট বোর্ড এবং সিন্ডিকেটে যেসব রাজনীতিবিদ থাকেন তাদের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ এবং আর্থিক কর্মকা-ে অযাচিত হস্তক্ষেপ না করা। একই কাজ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিদেরও করতে হবে। যোগ্য, দক্ষ এবং গবেষণাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান সে ব্যাপারে সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে।

উপাচার্যদের ব্যক্তিস্বার্থ অপেক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় তথা রাষ্ট্রের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্বেচ্ছাচারিতা পরিহার করতে হবে। জ্ঞানসৃষ্টি এবং জ্ঞানের নিত্যনতুন দিগন্ত উন্মোচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। নিজেকে গবেষণায় নিযুক্ত থাকতে হবে এবং গবেষণাসংশ্লিষ্টদের কাজে সহযোগিতা করতে হবে। গবেষণা খাতে সরকারি বরাদ্দের অর্থ যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে গবেষকদের প্রদান করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা সেল গঠন করে আলাদাভাবে গবেষণা কার্যক্রম তদারক করতে হবে। গবেষণার উপযোগী অত্যাধুনিক গবেষণাগার স্থাপন, বইপুস্তক এবং পত্রপত্রিকা ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশি-বিদেশি গবেষকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে সেমিনার আয়োজন এবং গবেষণার ফলাফল প্রকাশের উপযোগী জার্নাল প্রকাশ করতে হবে।

যেসব বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে কোনো অর্থ ব্যয় করেনি, সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় এনে তিরস্কার করা দরকার। ভবিষ্যতে যাতে তারা এমন কাজ আর না করেন সে বিষয়েও পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। অন্যদিকে যেসব উপাচার্য গবেষণার বেশি অর্থ ব্যয় করেছেন তাদের পুরস্কৃত করতে হবে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই এই তিরস্কার এবং পুরস্কার প্রদানের কাজটি করতে হবে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। এখান থেকে ডিগ্রি অর্জন করেই শিক্ষার্থীরা দেশসেবায় নিযুক্ত হয়। তাদের যোগ্য, দক্ষ এবং গবেষণামনস্ক করে গড়ে তুলতে না পারলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা কেন লয় হচ্ছে, তা যথাযথভাবে অনুসন্ধান করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

লেখক : গবেষক-প্রাবন্ধিক; শিক্ষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়