বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৯ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জে সংবাদকর্মীর কন্যাকে অপহরণ চেষ্টায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন সংগঠনের
  •   লক্ষ্মীপুরে মাদকসহ বাবা ও দুই ছেলে আটক
  •   চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশের অভিযানে বিভিন্ন মামলার ৮ আসামী আটক
  •   ফরিদগঞ্জ পাকহানাদার মুক্ত দিবস পালন
  •   যৌথ অভিযানে কচুয়া থানার লুণ্ঠিত পিস্তলের ৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার

প্রকাশ : ২১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

যদি থাকে চেষ্টা, ভালো হবে শেষটা
রাসেল হাসান

বিতর্ক জয়ের একটি তৃষ্ণা আছে। এই তৃষ্ণায় যে যত বেশি কাতর, জয় ততটা তার সন্নিকটে। ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক স্ক্রিপ্ট লিখে দিবেন আর শিক্ষার্থী তা মুখস্থ করে মঞ্চে তোতাপাখির মত অনর্গল বলে যাবে’ এই চেষ্টার নাম বিতর্ক নয়। বিতর্কে বিতার্কিকের নিজস্ব একটা আগ্রহ, চেষ্টা থাকাটা জরুরি। যার বিতর্ক জয়ের চেষ্টা আছে তার মধ্যে তেষ্টা আছে। এই তেষ্টা নিবারণের জন্যেই বিতার্কিক কখনও দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের কাছে, কখনও সিনিয়র বিতার্কিকদের কাছে, কখনও প্রজ্ঞাবান কোনো ব্যক্তির দ্বারস্থ হন। তাঁদের দেয়া বিভিন্ন যুক্তি, তথ্য, উপাত্ত একত্র করে বিতার্কিক তৈরি করেন একটি আদর্শ স্ক্রিপ্ট। তৈরিকৃত স্ক্রিপ্টটি যতটা না তার খাতায় থাকে, তার চেয়েও বেশি মাথায় থাকে। মাথার লড়াইয়ের বিতর্কটিই শ্রোতার কাছে হয়ে উঠে উপভোগ্য।

প্রতিজন আদর্শ রাঁধুনীই তার রান্না ভালো করতে চান। রান্নাকে সুস্বাদু করতে বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করেন। প্রতিজন বিতার্কিকও তার বিতর্ককে উপভোগ্য করে শেষ হাসি হাসতে চান। কিন্তু রাঁধুনী যে পরিমাণ উপকরণ নিয়ে রান্না ঘরে যাচ্ছেন, বিতার্কিক সে পরিমাণ উপকরণ নিয়ে বিতর্ক মঞ্চে যাচ্ছেন কি? কতিপয় অলস রাঁধুনী যেমনি মসলা বাটা বা ব্লেন্ডিং-এর মত পরিশ্রম না করে বাজারের রেডিমেড প্যাকেট মসলা দিয়ে কোনোরকম রান্না চালিয়ে যান, তেমনি কতিপয় বিতার্কিকও বিষয়ের গভীরে প্রবেশ না করে, যুক্তির পেছনে না ছুটে, তথ্য সংগ্রহের পরিশ্রমটুকু না করে দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের দেয়া রেডিমেড স্ক্রিপ্টের প্যাকেট নিয়ে মঞ্চে গিয়ে উপস্থিত হন। বাটা মসলার রান্নার স্বাদ আর বাজারের রেডিমেড প্যাকেট মসলায় রান্নার স্বাদ যেমন কখনও এক নয়, তেমনি নিজস্ব সাধনায়, পড়ালেখায়, চেষ্টায় যুক্তির উদ্ভাবন করে তা দিয়ে নির্মিত স্ক্রিপ্টের বিতর্ক আর অন্যের দেয়া রেডিমেড স্ক্রিপ্টের বিতর্ক কখনও একই মানের হবে না। তাই বিতর্ক জয়ের পূর্বশর্ত হলো বিতার্কিকের অকৃত্রিম চেষ্টা।

পরিশ্রমী বিতার্কিকরাই ক্রমান্বয়ে সেরা বিতার্কিক হয়ে উঠে। কারণ তাদের ভালো করার সীমাহীন চেষ্টা থাকে। এই চেষ্টা শুধুমাত্র স্ক্রিপ্ট গঠনের জন্যে নয়, নিজস্ব বাচনভঙ্গিতে, উচ্চারণে, শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধিতে, সত্য তথ্য উদ্ঘাটনে থাকে সীমাহীন। নবাগত অনেক বিতার্কিকেরই হয়তো অজানা, প্রতিজন প্রতিষ্ঠিত বিতার্কিকের বিতর্ক করার আলাদা একটি স্টাইল থাকে, একটি সুর থাকে। যে সুর শ্রোতাকে আকৃষ্ট করে দারুণভাবে। নবাগতদের যে কোনো একটি স্টাইল বেছে নিতে হয়। যে কোনো একটি বিতর্ক সুরে বিতর্ক চর্চা চালিয়ে যেতে হয়। বিতর্কের এই সুর শেখার বা শোনার জন্যে খুব যে বেশি দূরে যেতে হবে তা কিন্তু নয়। এখন সকলের হাতের কাছেই স্মার্ট ফোন। ইউটিউবে সনাতনী বিতর্ক সার্চ দিলেই অসংখ্য বিতর্কের ভিডিও ফুটেজ সামনে চলে আসবে। সেখান থেকে যে বিতার্কিকের বিতর্কের সুর মুগ্ধ করে, যে বিতর্ক স্টাইলটি ভালো লাগে, সেটি বেছে নিয়ে ধারাবাহিক চর্চার চেষ্টা করলে নতুন একটি নিজস্ব স্টাইল তৈরি হবে। তবে মনে রাখা উচিত 'সংসদীয় বিতর্ক' আর 'সনাতনী বিতর্ক' দুইয়ের উপস্থাপন, ডেলিভারি স্টাইল, বিতর্ক চলাকালীন হাতের ব্যবহার ও প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার ধরণ আলাদা। তাই সনাতনী বিতর্ক ফরমেটের নবাগত বিতার্কিকদের শুরুর দিকে সনাতনী বিতর্কগুলো অনুসরণ করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

বিতর্ক জয়ের চেষ্টাটা থাকতে হবে দলের প্রত্যেক সদস্যেরই। অধিকাংশ দলে দেখা যায়, দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের পাশাপাশি দলপ্রধানের চেষ্টাটা ভীষণ থাকে। দলের বাকি দুই বক্তা রেডিমেড স্ক্রিপ্টের জন্যে অপেক্ষায় থাকেন। এমন দলগুলো টুর্নামেন্টের প্রথম বা দ্বিতীয় ধাপে দু-চারটা বিতর্কে জয়ী হলেও বেশি দূর এগুতে পারে না। তিন বিতার্কিকের চেষ্টা কিভাবে কার্যকর হবে, কবে কখন কোথায় থেকে চেষ্টা শুরু করবে সে সম্পর্কেও ধারণা থাকা উচিত। বিতর্কের কোনো একটি বিষয় হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ভাবতে হবে, কীভাবে ও কোন্ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি উপস্থাপন করতে হবে। এরপর ভাবতে হবে যুক্তির প্রয়োজনে কোন্ বিষয়গুলোকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তারপর তিন বিতার্কিক মিলে ভাগ করে নিতে হবে কে কতটুকু বলবে।

ধরা যাক বিতর্কের বিষয় ‘দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ হোক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অঙ্গীকার’। এখানে প্রথমেই ভাবতে হবে দারিদ্র্য কী, মুক্তিযুদ্ধ বলতে কী বোঝাব, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কী বলব, অঙ্গীকার বলতে কী বলব? আবার যদি বিপক্ষ দলের হয়, তাহলে চিন্তা করতে হবে দারিদ্র্যমুক্ত না হলে কী-মুক্ত বাংলাদেশ তারা চাইবে। এরপর প্রথম, দ্বিতীয় ও দলনেতা মিলে ভাগ করে নিতে হবে কে কী বলবে। একজন বিতার্কিকের জানা প্রয়োজন কী বলব। এর চেয়েও বেশি জরুরি কীভাবে বলব এবং কেন বলব? এই 'কীভাবে' এবং 'কেন'-এর উত্তর খুঁজে বের করাটাই বিতর্ক পূর্ববর্তী পরিশ্রম বা চেষ্টা।

প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, বিতর্ক চলাকালীন যত শক্ত যুক্তিই উপস্থাপন করুক না কেন, তা মোকাবেলা করার চেষ্টা ও মানসিকতা ধরে রাখতে হবে। প্রায় আধা ঘণ্টার মঞ্চায়নে একটু ভেঙ্গে পড়লেই প্রতিপক্ষ আরো বেশি কাবু করে ফেলবে যুক্তির অস্ত্র দ্বারা। তাই প্রতিপক্ষ যত ভালোই বলুক তা হাসিমুখে উড়িয়ে দিয়ে তার চোখে চোখ রেখে ইতিবাচক অঙ্গভঙ্গি দ্বারা বুঝিয়ে দিতে হবে প্রতিপক্ষের কথাগুলো মোকাবেলা করা কোনো ব্যাপারই না। এই কাজটি করার চেষ্টা থাকতে হবে তিন বিতার্কিকেরই। অধিকাংশ দলের প্রথম ও দ্বিতীয় বক্তা মনে করেন 'আমার বক্তব্য শেষতো দায়িত্ব শেষ।' যা মোটেই সমীচীন নয়। দলীয় প্রচেষ্টা ছাড়া দলগত বিতর্কে জয়ী হওয়াটা কষ্টসাধ্য কাজ। বিতর্কে বক্তব্য রাখাকালীন 'আই কন্টাক্ট' যেমনি বক্তার জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি বক্তার বক্তব্যের স্বাভাবিক গতিকে হ্রাস করতে প্রতিপক্ষের তিন বক্তার আই কন্টাক্টও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অসংখ্য বিতর্ক মঞ্চে দেখেছি, প্রতিপক্ষ বক্তব্যের সময় যখন যুক্তির খই ফোটাচ্ছেন প্রতিপক্ষে বক্তাগণ তখন বসে বসে বাসা থেকে লিখে আনা স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করছেন। যেন তারা স্ক্রিপ্টের লেখাগুলো কোনোরকম বিরতিহীন ডেলিভারি দিতে পারলেই বাঁচেন। এ যেন যুদ্ধ শুরুর আগেই প্রতিপক্ষের সামনে দু হাত তুলে নিজেকে আত্মসমর্পণ করা।

প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিতর্ক করতে চাইলে বিতর্কের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা হবে অকৃত্রিম। শুধুমাত্র মনের জোরে, চেষ্টার জোরে গ্রামের বহু অখ্যাত বিতর্ক দলকে দেখেছি শহরের বিখ্যাত বিতর্ক দলকে হারিয়ে দিতে। ‘আমি পারবো, আমাকে পারতেই হবে’--জয়ের জন্য এই একটি লাইনই যথেষ্ট। তাই জোর গলায় বলছি, বিতর্কের বিষয় প্রাপ্তির পর থেকে বিতর্ক মঞ্চের শেষ সময় পর্যন্ত যদি থাকে চেষ্টা, ভালো হবে শেষটা। বিজয়ের মুকুট যায় তাদেরই কাছে, পরিশ্রম, আত্মবিশ্বাস ও চেষ্টা যাদের হৃদয়ে আছে।

রাসেল হাসান : উপাধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি; পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্কে কলেজ পর্যায়ে হ্যাট্রিক চ্যাম্পিয়ন দলের দলপ্রধান ও বহুবার নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ বক্তা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়