প্রকাশ : ০৮ জুন ২০২৪, ০০:০০
বাণী
দেড় দশকের মহাকাব্য

মহাযজ্ঞের কথা মহাকাব্যের শামিল। মহাযজ্ঞ বৈদিক যুগের মহা অর্জনের পুণ্যানুষ্ঠান হলেও বক্ষ্যমান মহাযজ্ঞ কলিযুগের কীর্তি। এ কীর্তি হলো বিতর্ক শিল্পকে তৃণমূল পর্যায়ে দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দেওয়ার নিরলস সাধনার নাম। এ এক মহান ব্রত। এর সূচনা ঘটে দুহাজার নয় সালে। সময়টা এমন যখন দেশ যাচ্ছিলো এক ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে। এ সময় প্রজন্মের খেই হারানোর দশা। সেই তিমিরাবৃত সময়ে একটা নান্দনিক বাতিঘরের প্রয়োজন হয়েছিলো, যার ধ্রুব আলোয় খেই হারা প্রজন্ম পাবে জীবনের আলোর দিশা। এই দূরদর্শী চিন্তা থেকে বিতর্ক শিল্পের চর্চাকে ইলিশের বাড়িজুড়ে প্রসারিত ও প্রচারিত করার অভিপ্রায়ে জন্ম নিলো এক অভিনব আন্দোলন। এর নাম বিতর্ক আন্দোলন। বুদ্ধির মুক্তি ঘটানোর আন্দোলনে যুক্ত হলো আপন দায়বদ্ধতা হতে উৎসারিত চেতনার শক্তিতে বলীয়ান পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স, যা শক্তি পেলো চাঁদপুরের আদৃত সন্তান শায়ক কামরুল হাসানের বরাভয়ে। পাঞ্জেরীকে সারথি পেয়ে সেনাপতি হয়ে উঠলো দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ, যার জেলাজুড়ে আছে ঘরে ঘরে পৌঁছানোর আলোকবর্তিকা। এসএসসি ও বৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধাবী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা জানানোর অনুষ্ঠান পরিণত পেলো আলোকিত প্রজন্ম বিনির্মাণের অলাভজনক প্রকল্পে। বিতর্ক উৎসবের মধ্য দিয়ে যে আলো জ্বলে উঠলো তা পরিবর্ধিত হলো পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার অমৃত মন্থনে। অন্যূন দুশো ছেষট্টিটা দলের সমাহারে প্রতিযোগিতা এক সময় হয়ে উঠলো মুক্তিযুদ্ধের নান্দনিক রণক্ষেত্র, যেখানে রক্তপাত নেই, ঢাল-তরোয়াল নেই, আছে শুধু শাণিত কথার ক্ষুরধার দীপ্তি এবং প্রতিটি চোখের মণির জ্বলজ্বলে স্বপ্ন সম্ভাবনা। কথাকে যুক্তির হাতিয়ার করে তাতে জ্ঞানের সম্মিলন ঘটিয়ে আমরা পেয়ে গেলাম ভাবীকালের নক্ষত্রমেলা, যার ভিত প্রোথিত হয়ে যায় প্রতিটি কোমল ও কমলিত মননের গভীরে। ফলে বিরতি দেওয়া আর সম্ভব হয়নি। তাকে টেনে নিতে হয়েছে একটানা এগার বছর। এরপরে করোনার করুণায় বিশ্ব পেলো স্থবিরতা আর পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতাও তিনবছরের জন্যে অচেতন হয়ে চলে গেল শীতনিদ্রায়। দেড় দশকের পথ পরিক্রমায় এক যুগপূর্তির উৎসবকে বাস্তবায়ন করতে আবারও শীতনিদ্রা কাটিয়ে ফিরে আসতে হলো আগ্রহী বিতার্কিক ও তাদের অভিভাবকদের মহা উৎসাহে। ফলে দুহাজার কুড়ি সালের অর্জনকে বাস্তবায়ন করতে হলো দুহাজার তেইশ-চব্বিশে এসে। অর্থাৎ পনর বছর শেষে বারো বছরের উৎসব। দেড় দশকে যুগপূর্তি।
দেড় দশকের যাত্রা শেষে যুগপূর্তির মহামিলনে উপনীত হয়ে আজ ব্যবচ্ছেদের সময় হয়েছে অতিক্রান্ত কালের পিছুটানে। সেই ব্যবচ্ছেদের ফলাফল আমাদের সামনে কতিপয় সত্যগুচ্ছকে জ্বলজ্বলে জ্যোতির্ময়তায় তুলে ধরে। যেমন :
ক. এ বিতর্ক প্রতিযোগিতা চাঁদপুর জেলার আনাচে-কানাচে সচেতন অভিভাবকদের মধ্যে বিতর্ক বিষয়ে জাগরণ তৈরি করেছে।
খ. এর মাধ্যমে এতদ্ অঞ্চলের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সহশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিতর্ক চর্চাকে গুরুত্ব দিতে শিখেছে।
গ. প্রতিযোগিতাটি সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতার্কিক হওয়ার স্বপ্নকে উস্কে দিয়েছে।
ঘ. এ বিতর্ক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সময়ানুবর্তিতা অনুশীলন করতে পেরেছে। কেননা এ প্রতিযোগিতাটি ঠিক ঠিক ঘড়ি ধরে শুরু হয় এবং বিলম্বে আসা দল বা প্রতিষ্ঠানের পাঁচ নম্বর করে কাটা হয়। পরন্তু আয়োজক কর্তৃক বণ্টনকৃত পোশাক না পরার কারণেও পাঁচ নম্বর কাটা যায়।
ঙ. এ প্রতিযোগিতার কারণে চাঁদপুরে অন্যান্য অনুষ্ঠান যেমন : জেলা প্রশাসন আয়োজিত মাসব্যাপী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক উৎসব, মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা, চতুরঙ্গের সপ্তাহব্যাপী ইলিশ উৎসব, টিআইবি-সনাকের আন্তর্জাতিক দুর্নীতি বিরোধী দিবস উদযাপন ইত্যাদিতে বিতর্ক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
চ. এই বিতর্ক প্রতিযোগিতা শিক্ষার্থীদের দরকারি বইয়ের পাশাপাশি মন-মানস গঠনকারী বই পাঠের চর্চা তৈরি করেছে।
ছ. এই বিতর্ক প্রতিযোগিতা জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের প্রশংসা অর্জন করেছে এবং তাদের পক্ষ থেকে এই প্রতিযোগিতার পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে।
জ. পৌরসভার মেয়র মহোদয় এই বিতর্ক প্রতিযোগিতাকে সৃজনশীল কাজ বলে অভিহিত করে আয়োজকদের সহযোগিতা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ঞ. পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে চাঁদপুরে প্রথম বিতর্কের একাডেমিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে দুহাজার আঠারো সালের জানুয়ারিতে চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা বাংলাদেশে প্রথম।
ট. পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার কারণে বিতর্ক সাহিত্য নামে সাহিত্যের আলাদা একটা শাখা জন্ম লাভ করেছে, যা ‘বিতর্কায়ন’-এর মাধ্যমে পূর্ণতা পেয়েছে।
ঠ. এই বিতর্ক প্রতিযোগিতার কারণে বিতর্ক বিষয়ক তিনটি মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো বিতর্ক বিধান, বিতর্ক বীক্ষণ ও বিতর্ক সমগ্র নামে জেলা ও জেলার বাইরে সমাদৃত হয়েছে।
ড. পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার কারণে চাঁদপুরে বেশ কিছু সংখ্যক বিতর্কের মডারেটর, বিচারকম-লী, স্পিকার ও সভাপ্রধান তৈরি হয়েছে, যারা দক্ষতার সাথে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেছেন।
ঢ. 'এক জেলা এক পণ্য ' স্লোগানে জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের কার্যক্রমে পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা বেশ গুরুত্বের সাথে স্থান পেয়েছে। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের দ্বিভাষিক (ইংরেজি ও বাংলা) প্রকাশনায় এটি স্থান পাওয়ার মাধ্যমে চাঁদপুরে বিতর্কের চর্চা আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
ণ. তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব প্রিয়তোষ সাহা রচিত ‘চাঁদপুর পরিক্রমা’ গ্রন্থেও পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিধৃত আছে।
ত. যুগপূর্তির উৎসবে পদার্পণকারী এ বিতর্ক প্রতিযোগিতার কারণে ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরে দেশ বরেণ্য বিতার্কিক ও লেখকের পদধূলি পড়েছে। এই বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও বিতর্ক উৎসবকে কেন্দ্র করে দুহাজার নয় সালে চাঁপুরে আসেন ডাঃ আব্দুন নূর তুষার, দুহাজার ঊনিশ সালে আসেন কথাশিল্পী অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মইনুল আহসান সাবের, কবি মারুফুল ইসলাম, দুহাজার আঠার সালে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মফিজুর রহমান। এবারের ফাইনালে আসতে চলেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় সংস্কৃতি বিষয়ক সচিব জনাব খলিল আহমদ, একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি মিনার মনসুর, সাবেক চ্যাম্পিয়ন বিতার্কিক ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রাজীব সরকার প্রমুখ।
থ. এই বিতর্ক প্রতিযোগিতার আগের ফাইনালে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি। তিনি একজন তুখোড় সাবেক জাতীয় টেলিভিশন বিতার্কিক। তাঁকে পেয়ে বিতার্কিকদের মধ্যে নতুন স্বপ্নের সম্ভাবনা তৈরি হয়। তিনি তাদের আত্মনির্মাণের ধ্রুবতারা হয়ে দীপ্তি বিলিয়ে চলেন মননে-মানসে।
পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা আজ আর কোনো প্রতিযোগিতা মাত্র নয়। এটি একটি জেলার ব্র্যান্ড এবং চাঁদপুরে বিতার্কিক তৈরির সূতিকাগার। এটি মূলত একটি সমাজ সংস্কারমূলক অমর কৃত্য। এর আর্থিক লাভ না থাকলেও প্রজন্মকেন্দ্রিক মানব সম্পদ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে এটি অতুলনীয় ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এটির কারণেই আজ জন্ম হয়েছে এক অনন্য উজ্জীবনী বাণীর, যা আমাদের বিতার্কিকদের মনে টিমটিমে জ্বলতে থাকা আলোক শিখাকে শক্তি অর্জনে সাহস যোগায়। সেই অতুলনীয় অমর বাণীটি হলো : যে আসে বিতর্কে সে হারে না। পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতা অমর হোক, চির শাশ্বত হোক।
লেখক : অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি ও গ্রন্থকার, বিতর্ক সমগ্র।