সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১০ নভেম্বর ২০২৫, ০০:৪৭

হৃদয়বতী

মিজানুর রহমান রানা
হৃদয়বতী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বারো.

গভীর একটা ঘুম থেকে জেগে উঠলো অনন্যা। চোখ খুলতেই ইমতিয়াজকে সামনে বসে থাকতে দেখলো সে। ইমতিয়াজ তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।

‘কেমন বোধ করছো অনন্যা?’ সেই হাসি না থামিয়েই ইমতিয়াজ প্রশ্ন করলো।

‘মনে হচ্ছে আমাকে দীর্ঘ সময় ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিলো?’

‘হ্যঁা, এইতো তিন দিন যাবত।’

‘কেন?’

‘আরে ভালোবাসা পাবার জন্যে কতকিছু মানুষকে করতে হয়। তোমাকে তো মাত্র তিনদিন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছি। এর আগে যাকে ভালোবেসেছিলাম তাকে তো মাসের পর মাস ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত রাখতে পারলাম না। আমার মেয়েটা সাগরের জলে ভেসে যাবার পরই সে ধীরে ধীরে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। তাই তাকে দিনের পর দিন ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হয়েছিলো। মাদকের আসক্তির কারণেই কিডনী লিভার নষ্ট হয়ে মরে গেলো। তারপর আমার একাকী জীবন, খুব কষ্টের। তবে তোমাকে পেয়ে আবারও বঁাচতে ইচ্ছে হচ্ছে। অনন্যা, তুমি কি আমায় ভালোবাসবে? ভালো তোমাকে বাসতেই হবে। এছাড়া আর তোমার কোনো উপায় নেই। আমাকে কোনোভাবেই তুমি আমার ইচ্ছের বিপরীতে চালাতে পারবে না।’ অনন্যা কোনো কথা বলছে না। ইমতিয়াজের দীর্ঘ বয়ানের পর সে আবার ধীরে ধীরে ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলো।

নাদের সাহেব বিমর্ষ বদনে বসে আছেন সোফায়। ভাবছেন তার কন্যা অনন্যার কথা। স্বাধীন এই দেশে সে আজ পরাধীন হয়ে বসে আছে। গুণ্ডামি ছেড়ে দেশের জন্যে একাত্তরে লড়েছিলো সে। পাক আর্মি ও তাদের দোসররা তাকে যখন বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়, তখন সে মৃতবৎ ছিলো। তার জ্ঞান ছিলো না বলে তাকে মৃত ভেবেই বুড়িগঙ্গাতে ফেলে দেয়। যখন সে চোখের পাতা খোলে তখন সে নিজকে আবিষ্কার করে বুড়িগঙ্গার পাশে এক বাড়িতে। জেলেরা নাকি তার শরীরটা পেয়েছিলো। তারপর তাকে বহু কষ্টে নৌকায় তুলে সেবাযত্ন করে সুস্থ করেছে। সুস্থ হওয়ার পর সে আবারও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত মরণপণ যুদ্ধ করেছে।

ওই সময় সে এক সাহসী নারীর দেখা পেয়েছিলো। যিনি বীরত্বের সঙ্গে রণাঙ্গনে লড়াই করে সাহসিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

সখিনা বেগম। ১৯৭১ সালে দা দিয়ে কুপিয়ে পঁাচ রাজাকারকে হত্যা করেন তিনি। তঁার এই সাহসিকতার কথা স্বাধীনতার পরও মানুষের মুখে মুখে গল্প আকারে শোনা যায়।

কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার গুরুই গ্রামে বাস করতেন সখিনা বেগম। তঁার বাবার নাম সোনাফর মিয়া। মায়ের নাম দুঃখী বিবি। সখিনা ছিলেন নিঃসন্তান। মুক্তিযুদ্ধের আগেই মারা যান তঁার স্বামী কিতাব আলী। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নেমে পড়েন সশস্ত্র যুদ্ধে। স্থানীয় মানুষ তঁাকে ‘খটকি বেগম’ বলেও ডাকতেন। মুক্তিযুদ্ধে সখিনা বেগমের ভাগ্নে মতিউর রহমান সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে হানাদার পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারদের হাতে শহীদ হন। ভাগ্নের অকালমৃত্যু সখিনাকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। নাদের জেনেছেন মুক্তিযুদ্ধের সময় সখিনা বেগম গুরুই এলাকায় বসু বাহিনীর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রঁাধুনির কাজ করতেন। কাজের ফঁাকে রাজাকারদের গতিবিধির বিভিন্ন খবর সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জানাতেন। নিকলী উপজেলাকে মুক্ত করার সময়ও সখিনা বেগম খবর সংগ্রহে সক্রিয় ছিলেন। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহায়তা করেছেন।

এক সময় তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে আসেন। আসার সময় সেখান থেকে নিয়ে আসেন একটি ধারালো দা। পরে সেই দা দিয়েই নিকলীর পঁাচ রাজাকারকে কুপিয়ে হত্যা করেন। সখিনার ওই দা ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে এবং নামফলকে সখিনা বেগমের নাম উল্লেখ আছে। সখিনার ভাগ্নে মতিউর রহমানকে যে রাজাকাররা হত্যা করেছিলো, তঁাদের মধ্যে একজনকে বসু বাহিনী ধরে নিয়ে সখিনার হাতে তুলে দেয়। সখিনা তঁাকে বঁটি ও দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছেন। তবে স্থানীয় লোকজন নাদেরকে জানিয়েছেন, সেই সময় সখিনা পঁাচ রাজাকারকে কুপিয়ে হত্যা করেছিলেন।

নাদের কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই একটা আশার চিহ্ন খুঁজে পান। হঠাৎ করেই বসা থেকে উঠে পড়েন। তারপর ভাবেন, আমার কন্যা অনন্যাও বেশ সাহসী। সে যে কোনো দুঃসময়ে নিজকে সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কঠিন বিপদকে পাশ কাটিয়ে যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে একজন হৃদয়বতী কন্যা হলেও সময় মতো নিজকে ঝলসে নিতে পারবে আগুনের অঁাচে। যে কোনো মানুষ বিপদে না পড়লে সাহসী হয় না। আগুনে না পুড়লে সোনা খঁাটি হয় না। একজন হৃদয়বতী নারীও নির্যাতিত হলে সাপের মতো ফণা বিস্তার করতে দ্বিধাবোধ করে না। সে মনে মনে ভাবে, আমার কন্যা পারবে, নাদের গুণ্ডার কন্যা কখনও নিজকে পরাজিত করবে না। পরাজয় তার কাছে মৃত্যুর সমান। আমি নাদের। আমি ছিলাম তরুণ-যুবককালের বেপরোয়া ছেলে। আমার রক্ত আমার কন্যাদের শরীরে। তাদেরকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না, এটা নিঃসন্দেহে। ছলেবলে কৌশলে নিজকে সে রাহুমুক্ত করবেই।

কথাগুলো ভেবে আনন্দে তার মন ভরে উঠে। তারপর সে সোফায় শুয়ে লম্বা একটা নিঃশ্বাস নেয়। এ সময় তার হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেলো মিরপুরের শামসু ওরফে চেঙ্গিস খানের কথা। সে যুদ্ধের পর এখনও আগের মতোই একটা দল চালায়। সেই দলে সারাদেশে বহু সদস্য আছে। তারা কোথায় কখন কী হয় তার খবর রাখে। চেঙ্গিস খানের নাম্বারে কল করে নাদের। একটু পরই কথা বলে উঠে চেঙ্গিস। তারপর সালাম দিয়ে প্রশ্ন করে, ‘কী হয়েছে ভাই ছাহেব। বহুদিন পর মনে পড়লো বুঝি?’

‘হ। তোরে আমার খুব দরকার। আমার মেয়েটা অপহরণ হয়েছে। তার কি খবর আছে?’

‘খুঁইজ্জা নিতে অইবো ভাই ছাহেব। আমি জানামুনে আপনারে। সময় ৫ মিনিট।’

ঠিক ৫ মিনিট পরই চেঙ্গিস খানের কল আসে নাদেরের মুঠোফোনে। তারপর গমগম করে আওয়াজ করে বলে, ‘তারে মাফিয়া ডন ইমতিয়াজ কানাডায় নিয়া গেছে। আমাগো কোনো সাহায্য লাগবে বস?’

‘লাগতে পারে, রেডি থাইকো দলবল নিয়া।’ উত্তর দিলো নাদের। তারপর বললো, ‘হাতিয়ার কিন্তু জমা দিছি চেঙ্গিস, কিন্তু ট্রেনিংটা তো জমা দেই না। কী বলো?’

‘হ। খঁাটি কথা। সময় হলে ট্রেনিংটা তো আবারও কাজে লাগতে পারে।’

দুজনই হেসে উঠলো। তারপর কলটা কেটে দিলো। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়