প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৯
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

(তেতাল্লিশতম পর্ব) খাবারের সংস্কৃতি :
যা খাই তার সব খাদ্য নয় জানি। আবার খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় এমন অনেক কিছুই আমার খাদ্য তালিকায় নেই। আমি বাঁচার জন্যেই খাই। যদিও অনেকেই আছেন খাওয়ার জন্যে বাঁচেন। আমি খাদক না হলেও স্বল্পাহারী নই। তবে মিতাহারী তো বটেই। আমার এক কাকা ছিলেন। আমার বাবার দূর সম্পর্কে কাকাতো ভাই। তিনি আবার বিমান বাহিনীতে চাকরি করতেন। তার বাবার মৃত্যুর পর বলতে গেলে আমাদের বাড়িতেই থাকতেন। আমার এই কাকার আবার খাওয়ার রুচিটা বেশ ছিলো। তিনি যখন ভাত খেতে বসতেন তখন যিনি খাবার পরিবেশন করতেন তাকে বেশ বেগ পেতে হতো। ভাতের পাতিল তলানিতে ঠেকতো। কাকার একটা অভ্যাস ছিলো। তিনি বহুদূর পথও হেঁটে যেতেন। পথ খরচের যে টাকা বাঁচাতেন তা দিয়ে তিনি রেস্টুরেন্টে বসে খেতে পছন্দ করতেন। আমার মামারা তার তালাতো ভাই। তাই তাদের কাছে কাকার খাওয়ার বায়না থাকতো বেশ। আমার বড়ো মামাকে নিয়ে একবার রাতে একটা চায়নিজ রেস্তোরাঁয় গেলেন। বড়ো মামাও খুব উদার হস্তে তার তালাতো ভাইকে আপ্যায়ন করলেন। কিন্তু রেস্তোরাঁ থেকে বাসায় এসে মাকে বললেন, ‘বৌদি আমার জন্যে ভাত রান্না করো। তালাতো যা খাওয়ালো তাতে রাতে খিদে লেগে যাবে।’
আমার ক্ল্যাসিক কোচিংয়ে জাকির ভাই ছিলেন, যিনি খেতে পারতেন ভালো। বন্ধু রাজুর সাথে বেট ধরে মিষ্টি দিয়ে গুণে গুণে সতেরোটা পরোটা খাওয়ার পর বললেন, ‘পীযূষ আজ আর খাবো না রে, বাসায় গিয়ে ভাত খেতে পারবো না তাহলে।’
খাওয়া নিয়ে আমাদের গ্রামে ছোটবেলায় একটা কাহিনী শুনেছিলাম। আমার সমবয়সী বা একটু বড়ো এমন একজনকে গ্রাম সম্পর্কের এক দিদি কোনো এক নিমন্ত্রণে কাছে ডেকে বসিয়ে খেতে দিলেন। ঐ দিদি ছিলেন ভান্ডারি। তো পাত খালি হওয়ার পর দিদি তাকে যাচলেন, ‘আর দুটো দেই?’ যে খায় সে-ও না করে না। এভাবে খেতে খেতে তার পেট টাইট হয়ে ফুলে গেলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হলো। ছোট ভাইয়ের এ ঘটনা দেখে তার আপন দিদি ছুটে এসে ভান্ডারি দিদিকে গালমন্দ করে ভাইয়ের কোমরে থাকা অমঙ্গল তাড়ানোর কালো তাগ্গি কাঁচি দিয়ে কেটে দিলেন। এতে শ্বাস নিতে কিছুটা জায়গা তৈরি হলো। বেঁচে গেলো সে যাত্রায় আমার সমবয়সী ভাইটি। এ কথা এখনও গ্রামে মুখে মুখে জেগে আছে। উপযুক্ত ক্ষেত্রে সবাই এ উদাহরণ দিয়ে তৃপ্তি পায়।
কোনো এক বইতে খাওয়ার বাজি নিয়ে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটার মূল প্রতিপাদ্য ছিলো মধ্যবিত্তের প্রতিযোগিতা মনোভাবকে তুলে ধরা। কিন্তু গল্প শেষে নিম্নবিত্তের ক্ষুধাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। একবার কোনো এক গাঁয়ে একটা হাজারি কাঁঠাল বা খাজা কাঁঠাল নিয়ে একজন উচ্চবিত্ত, একজন মধ্যবিত্ত এবং একজন নিম্নবিত্তের লোকের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়। প্রতিযোগিতার বিষয় ছিলো, কে কতো দ্রুত বেশি কাঁঠালের কোষ খেতে পারে। উচ্চবিত্তের লোকটা আয়েশ করে কাঁঠাল খায়। ধীরে ধীরে কাঁঠালের বতি ছাড়ায়, আঙ্গুল দিয়ে ফেঁড়ে বিচি ছাড়ায় আর তারপর মুখে দেয়। ছাড়ানো বিচিটা পাশে রাখে। মধ্যবিত্ত লোকটা কিছু কাঁঠালের কোষ গিলে ফেলে বিচিসহ, আর কিছু বিচি ছাড়িয়ে খেয়ে বিচিগুলো পাশে জমায়। তাকে তো প্রতিযোগিতায় জিততে হবে। কাজেই বিচি ছাড়াতে গিয়ে সময় অপচয়ের সুযোগ নেই। নিম্নবিত্তের লোকটা জীবনে এতো বড়ো এবং এতো স্বাদের দামি কাঁঠাল খায়নি। তাই সে মনে মনে বললো, প্রতিযোগিতা দূরে থাক, আগে যতো পারি কাঁঠাল খেয়ে নিই। এ চিন্তা করে সে প্রায় কোষই কোঁৎ কোঁৎ গিলতে শুরু করলো বিচি না ছাড়িয়ে। নির্ধারিত সময় শেষে জমানো বিচি গুণে দেখা গেলো, উচ্চবিত্তের লোকটার জমানো বিচির সংখ্যা বেশি, মধ্যবিত্তের জমানো বিচির সংখ্যা দ্বিতীয় আর নিম্নবিত্তের জমানো বিচি গুণে দেখা গেলো, সে প্রায় খায়নি বলা চলে। রাতের বেলা নিম্নবিত্তের লোকটার পেট কামড়ে ভীষণ ব্যথা উঠলো। ব্যথার কথা কাউকে না জানিয়ে সে মলত্যাগ করে আরাম বোধ করলো। পরদিন দুপুরে একপেট খিদে নিয়ে খেতে বসে দেখলো, গিন্নি তার প্রিয় পাটশাক রেঁধেছে কাঁঠাল বিচি দিয়ে। খিদে নিয়ে খেতে বসে কোনোদিকে তার নজর ছিলো না। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বউকে জিজ্ঞেস করলো, ও বউ কাঁঠালের বিচি পাইলি কই? বউ জবাব দেয়, ক্যান্, আমাদের ঘরের পেছনের দাওয়ার কাছে বাগিচায়। বউয়ের জবাব শুনে তৃপ্তিতে খাওয়া লোকটার বমির উদ্রেক হলো। কারণ গতকাল রাতে সে ঐ জায়গাতেই নিজেকে হাল্কা করতে গিয়েছিলো।
শৈশবে আমাদের গ্রামের বৌদ্ধ বিহারে অষ্টশীল বা উপোসকালীন উপাসক-উপাসিকাবৃন্দ সকালে জাউ খেতেন মরিচের চাটনি দিয়ে। দুয়েকবার আমিও সেই স্বাদ পেয়েছি। জাউ খেতে খেতে একসময় থালায় পানির পরিমাণ বাড়তো। তা দেখে বয়োজ্যেষ্ঠরা বলতেন, তুই হলি বর্ষা রাশি। এ ব্যাপারটা আমার লেটকা সেমাই খেতে গেলেও হতো। মায়ের হাতে রান্না করা বাদাম-কিসমিস দেওয়া টলটলে লম্বা সেমাই দু আঙ্গুল দিয়ে খেতাম ফুরুৎ ফুরুৎ করে। এটা চামচ দিয়ে খেতে গেলে সেই মজাটা থাকতো না। গ্রামে হেমন্তে মধুভাত খেতে বেশ মজা হতো। এ ভাত খেলে ঘুম ঘুম ভাব হতো। শহুরে জীবনে একবার আমাদের বাসায় অশোক দাদা নামে এক আত্মীয় এসেছিলেন। তাকে আর আমাকে একসাথে খেতে দেওয়া হলো। তখনকার ভাতগুলো ছিলো আঠা আঠা। অশোকদা এই ভাতকে বিনি বাত মনে করে চিনি দিয়েই খেয়ে ফেলেন। আমার মায়ের রান্না করা বেশ কিছু পদ আমাদের প্রিয়। রোববার সকালে গ্রামজীবনে মা ঘি দিয়ে বাবার জন্যে সুজির হালুয়া বানাতেন। আমি তার একজরা পেতাম। স্থানীয় ভাষায় জরা মানে মুঠি। একজরা ভাত মানে একমুঠি ভাত। রোববারে রাতের খাবার শেষে মুখের ভেতর খাসির কলিজা ভুনার টুকরো চেপে রেখে চেটে চেটে খেতাম। এটা কেমন যেন পরিতৃপ্তি এনে দিতো। চট্টগ্রামে কাঁচা শিমের বিচি কিংবা শুকনো শিমের বিচির খোসা ছাড়ানো তরকারিকে বলে খাইস্যা। চাটগাঁইয়ারা এই খাইস্যাকে বিভিন্নভাবে খায়। কই মাছ দিয়ে, মাগুর বা টুইর মাছ দিয়ে খেতে বেশি মজা। তা না পেলে ছুরি শুটকি দিয়েও খাওয়া হয়। আলু-বেগুনের ঝোল-তরকারিতেও অল্পকিছু শিমের খোসা ছাড়ানো বিচি মিশিয়ে দেওয়া হতো। আমার মায়ের হাতে রাঁধা ঘন্ট ছিলো অমৃত। ঘন্ট হলো বিভিন্ন সব্জির মিশেল। তাতে শিমের বিচি ভেজে মিশিয়ে দেওয়া হতো। শুকনো শিমের বিচিকে কড়াইতে ভেজে তারপর সেগুলো ছালার পাতলা বস্তায় ঢুকিয়ে ওপর থেকে পুতা দিয়ে ডলা দেওয়া হতো। এতে বিচির বীজপত্রগুলো আনাম থাকতো কিন্তু ওপরের খোসাটা ছুলে যেতো। তারপর সেগুলো কুলায় ঝেড়ে খোসা আলাদা করে বিচিগুলো ঘন্টে মিশিয়ে দেওয়া হতো। ঘন্টের ঝোলটাকে ঘন ও সান্দ্র করার জন্যে পাটায় পেষা হাল্কা চাউলের গুঁড়ো মিশিয়ে দেওয়া হতো। এতে একটা স্যুপ স্যুপ ফ্লেভার তৈরি হতো। গোটা গোটা খানকতক লাল পোড়া মরিচ ঐ তরকারিতে ছেড়ে দেওয়া হতো। ফলে তরকারিতে হাল্কা পোড়া পোড়া গন্ধ আসতো যা স্বাদকে বাড়িয়ে দিতো। এই চালের তরলিত গুঁড়োকে বলে ‘গাআই’। চট্টগ্রামের এক ঐতিহ্য হলো বিয়ের পরদিন মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে তেলের পিঠা পাঠানো। এ পিঠা বানাতো চালের গুঁড়োর কাঁই দিয়ে। কাঁঠাল পাতায় তেলের ছোঁয়া লাগিয়ে তাতে চালের কাঁইয়ের মোল্ডকে গোলাকার আকৃতিতে চ্যাপ্টা করে বানানো হতো। পরে পাতা থেকে
এই সমতল গোলাকার পিঠের মডেল নিয়ে চুলায় ফুটন্ত ডুবু ডুবু তেলে ছাড়া হতো। তেলের আঁচে বাদামী রং পাওয়া পিঠেগুলো দুস্তরে ফুলতো। পরে ঠাণ্ডা হয়ে গেলে এমন শক্ত হতো যে, কামড়ে খেতে দাঁতের জোর লাগতো। চট্টগ্রামের ভাষায় আমরা ভর্তাকে বলি ‘চান্নি’। আমার মায়ের হাতে থানকুনি সাথে মরিচ ও পেঁয়াজ কচলিয়ে সরিষার তেল মাখা খেতে বড়ো মজার ছিলো। এ দিয়েই একথালা ভাত খাওয়া যেতো।
মা অসুস্থ থাকলে কিংবা বেড়াতে গেলে আমাদের দায়িত্ব পড়তো মেজদির ওপর। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রাতে বেঁচে যাওয়া ভাতকে সকালে পেঁয়াজ-মরিচ-হলুদ সহযোগে ভেজে চিনি ছিটিয়ে খেতে দিতেন। এটা খুবই মজাদার ও পেটভরানো ছিলো। এটাই মনে হয় আজকের ফ্রাইড রাইস। বেঁচে যাওয়া ভাত বেটে পিঠা বানানোতেও মেজদির সৃজনশীলতা ছিলো প্রশংসনীয়। স্কুলের ক্যান্টিনে খাওয়া চার আনার আলুর চপ আর আট আনার স্যান্ডুইচ আমাকে আজও কাছে টানে। হায়! এখন আর সেগুলো নেই।
ভোলাবাবুর দোকানের পুরি আর সুজির রঙ্গিন হালুয়া আমার কাছে ছোটবেলায় অমৃতের সমান ছিলো। মাঝে মাঝে দুপুরবেলা ক্রিকেট খেলে পাড়ার সেলিম হোটেলে দুটো নানরুটি দিয়ে এক পিচ মুরগির মাংস আর আলু-ঝোলে খেয়ে মনে হতো মোগলের হেঁশেলে ঢুকলাম। আমাদের নিউমার্কেটের কাছে সন্ধ্যায় ডিমের কুসুম-রাঙ্গা জামান হোটেলের এককাপ চায়ে তখনকার দুটাকা দামের তেলে ভাজা পরোটা চুবিয়ে খেতে খেতে মনে হতো, হায়! এমন অমৃতও হয়! কলেজে উঠে ফিজিক্স পড়তে গেলে আসার পথে দস্তগীরে খেতাম পরোটা দিয়ে খাসির ফুসফুস রান্না। সেই তারুণ্যে এ ছিলো কিঞ্চিৎ বড়ো হয়ে ওঠার স্বাধীনতা।
স্টাডি ট্যুরে মেডিকেল কলেজ হতে গিয়েছিলাম ভারতে। কোলকাতার সব খাবারে চিনির ছড়াছড়িতে মনটায় তেতোভাব চলে এসেছিলো খাবারের প্রতি। শেষমেষ চন্ডীগড় রেলস্টেশনে এসে গরম গরম ঝাল ঝাল মুরগির মাংস আর ঝোলভাত আমার সেই মিষ্টিজাত মনের তেতো কাটিয়ে নিয়েছিলো। সংসারের কারাগারে যিনি আমার দেখভাল করেন, তিনি একজন দক্ষ ও চটপটে রন্ধন শিল্পী। সন্ধ্যায় এবং কখনও কখনও দুপুরে চল্লিশ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে বাসায় আসতাম ওনার বানানো এককাপ চা চেখে দেখবো বলে। তার বানানো আমের মোরব্বায় এখনও মুগ্ধ প্রিয়তোষ। তার পায়েস খাওয়ার পর আমার ছোট ছেলের মুখে আর কারও পায়েস রোচে না। আমার কথা তো বলাই বাহুল্য। চাঁদপুরের একশো পঞ্চাশ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধনে তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাঁদপুরে এসেছিলেন। চিকিৎসক সমাজের হয়ে সে অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম। আসার সময় একবাটি চিকেন বিরিয়ানি দিয়ে দেয় ব্যাগে করে। বাসায় যখন ঢুকি তখন বড়ো ছেলে প্রত্ন জিজ্ঞেস করে, ‘ প্রধানমন্ত্রী আমার জন্যে কী পাঠিয়েছে?’ তাকে আমি বিরিয়ানির বাটি দিয়ে বললাম, এটা পাঠিয়েছে। সেই থেকে আমার বড়ো ছেলে বিরিয়ানিকে প্রধানমন্ত্রীর ভাত বলেই জেনেছে।
চাঁদপুরে প্রথম এসে কবিতা মাসীর বনাইট্যা ভর্তা খেয়ে আমার নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিলো। প্রথম প্রথম যখন একা ছিলাম মিডল্যান্ডে, তখন সকালের নাশতায় মিন্টু এনে দিতো পরোটা, আলু ভর্তার গোল্লা আর পাতলা ডাল। তাতেও দেখি আমার ভালো লাগা তৈরি হয়ে যায়। দিন যতো যায় মানুষের সাথে আনাগোনা বাড়ে। আমাদের পারিবারিক বন্ধু অরিনের মা আন্তরিকভাবে একবার পাঠালেন বাদামবাটা দিয়ে কৈ মাছ রেঁধে। এরপর কি আর আমাকে কেউ কৈ রেঁধে খাওয়ানোর জো ছিলো! আমার পত্নীর সাথে বোনের সম্পর্ক হলো তান্নির। তার মেয়ে পড়তো আমার বড়ো ছেলের সাথে। মাঝে মাঝে তান্নি রেঁধে নিয়ে আসতো ছোট মাছ। তাতেও বেশ স্বাদ লেগেছিলো। আমার মালিক তার বাপের বাড়ি গেলে আমাদের মাহবুব তখন টিফিন ক্যারিয়ার পাঠাতো খাবারে ঠেসে। তার পাঠানো শাক খেয়ে মনে হতো, আমিষের চেয়ে শাকের স্বাদ অনেক বেশি। মনু ভাবীর আদর আমার জন্যে দিঘির চেয়ে বেশি। তিনিও নানা রকম ভর্তা দিয়ে আমার রসনাকে প্রশ্রয় দিতেন সব সময়। আমাদের ঘরের বেগুন ভর্তা খেয়ে বন্ধু তৌহিদ ভুলতে পারেনি আজও। সে ছিলো আমার মায়ের বানানো। মায়ের শিষ্যা মেজবৌদির হাতে বানানো বেগুন ভর্তা খেয়ে আমি একবার ঢাকা গিয়েছিলাম ট্রেনে চড়ে। ট্রেনযাত্রায় সারারাত আমার জিভে সেই ভর্তার স্বাদ লেগেছিলো বলেই যাত্রাপথে আর কিছু খাওয়ার রুচি হয়নি। বড়বৌদির হাতে কচুরলতি রান্নার একটা বিশেষত্ব আছে বলতেই হবে। আমাদের বাড়ির ছোট বউ মায়ের কাছে থেকে থেকে ঘন্ট রান্নাটা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করেছে বলা যায়। ইন্টার্নশিপ করার সময় ডক্টরস্ ক্যাফেটেরিয়ার গরুর কালা ভুনা আর পাতলা ডালও খেতে বেশ ছিলো। মস্কোতে গিয়ে পাথরের মতো শক্ত আলু গলিয়ে তাতে ফ্রেঞ্চ বিনের বিচি মিশিয়ে রেঁধেছিলো ছোটভাই। সেই শীতের দেশে এটাও ছিলো আমাদের ভালো খাওয়া। রামকৃষ্ণ আশ্রমের খিচুড়ি, কালীবাড়ির রাজভোগ, সুনীলদার বাড়ির খিচুড়ি প্রসাদ আমাদের পরিবারের প্রিয় আহার। গোবিন্দ হোটেলে লুচি দিয়ে চনার ডালের স্বাদও ভোলার নয়। চাঁদপুর বড় স্টেশনে হিলশা কিচেনে বসে দোসা খাওয়া ছিলো আমার প্রিয় মুহূর্তের একটি। কখনও কখনও দুপুরবেলা চেম্বার শেষে বাসায় যাওয়ার সময় নিয়ে যেতাম ক্যাফে কর্নারের স্টাফদের জন্যে বানানো ভর্তা। খেয়ে মনে হতো, এটা বুঝি তারা বিশেষ করে বানায়।
চট্টগ্রামের সংস্কৃতিতে আমরা ডাল খাই শুরুর দিকে। কিন্তু চাঁদপুরে ডাল খাওয়া হয় খাবারের শেষে। অনেকটাই কমপ্লিমেন্টের মতো। অর্থাৎ ডাল পাতে নিয়ে সুরুৎ করে খাওয়া মানেই খাবারের শেষে উপনীত। আমার ছোটবোনের এক দেবর আছে। সে খেতে বসলে মাকে বলতো, মাসী ডাইরেক্ট দিয়ে দেন। আমরা না বুঝে চেয়ে থাকতাম। সে তখন বলতো, ডাইরেক্ট মানে মেইন তরকারি তথা মাংস দিয়ে দেন সরাসরি। সে আর কিছুই খেতো না। শুধু মাংস দিয়ে ভাত। এজন্যেই তাকে ডাইরেক্ট দিতে হতো। অগাজু নামে একজন পার্বত্য চট্টগ্রামের লোক ছিলেন। তিনি আমার ভগ্নিপতির সূত্রে আমাদের বাসায় আসতেন। সত্য কি না জানি না, আমরা শুনলাম, অগাজু নাকি কোনো এক হোটেলে খেয়ে ম্যানেজারের সাথে মেসিয়ারের ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছে। অগাজু খাওয়া শেষে বিল দিতে কাউন্টারে গেলে ম্যানেজার মেসিয়ারকে জিজ্ঞেস করে, ‘কত অইয়ে?’ মেসিয়ার হিসেব দিতে গিয়ে বলে,’আষ্ট পেলেইট চিকেন বিরানি।’ ম্যানেজার এটা শুনে আবার জিজ্ঞেস করে, কতো বিল? আবারও মেসিয়ার বলে, আটত্রিশ পেলেট চিকেন বিরানি! এ রকম তিনবার জিজ্ঞেস করে একই উত্তর পাওয়ায় ম্যানেজার উঠে গিয়ে মেসিয়ারকে কষে চড় লাগিয়ে বললো, ‘মশকারি গরঅর দে না?’ পরে অগাজু নিজেকে বলতে হলো, তিনি আসলেই আটত্রিশ প্লেট চিকেন বিরিয়ানি খেয়েছিলেন। ( চলবে)







