সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৪

খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

(বিয়াল্লিশতম পর্ব)

সংস্কার ও কুসংস্কার : যেহেতু আমার জীবন গ্রাম ও শহরের সংস্কৃতি গায়ে মেখে আমাকে লালন-পালন করে বড় করেছে, সে কারণে নানাবিধ সংস্কার ও কুসংস্কারকে মানুষের জীবনে প্রকট হতে আমি দেখেছি। কোনটা সংস্কার আর কোনটা কুসংস্কার তা বোধ হয় মোটাদাগে বলার কোনো সুযোগ নেই। কারণ অনেক চর্চা কারও কাছে ইতিবাচক বলেই তা সংস্কার আর কারও দৃষ্টিতে সামাজিক অপচর্চা বলেই তা কুসংস্কার। তবে সংস্কার ও কুসংস্কারের সংজ্ঞা নিরূপণ আমার উদ্দেশ্য নয়। খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবনের কথা বলতে গেলে নিজের চোখে দেখা কিছু সংস্কার ও কুসংস্কার প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। বৌদ্ধ ও সনাতনী পল্লিতে মা মগধেশ্বরীর সেবা করা হয় পরম ভক্তি ও বিশ্বাসে। তাঁকে অর্ঘ্য নিবেদনের স্থানকে বলা হয় সেবাখোলা। আমাদের গ্রামেও এমন একটা সেবাখোলা ছিলো। এটি ছিলো মূলত দখিনা বিলে। আমাদের এলাকায় বিল কিন্তু নিম্ন জলাভূমি নয়। আমাদের এলাকায় বিল হচ্ছে চাষযোগ্য জমি। তো, দখিনা বিলের মাঝখানে, কিছুটা নাপিতখালী ( স্থানীয় ভাষায় নাইতখালী) খাল থেকে কয়েকশো গজ দূরে ছিলো সেবাখোলার অবস্থান। নাপিতখালী নামটা কোত্থেকে উদ্ভূত তা নির্ণীত নয়। তবে অনুমান করা যায়, আমাদের স্থানীয় ভাষায় কার্পণ্যকে কটাক্ষ করে অনুভূতি প্রকাশকালে নাপতামি শব্দটার ব্যবহার আছে। যেমন : কেউ কৃপণতা দেখালে আমরা বলি নাপতামি করিস্ না। সেই ব্যবহার থেকেই হয়তোবা নাপিতখালী নামকরণের উৎপত্তি। কেননা, খালটি এমন সরু যে, যে কেউ এক লাফে তা পার হতে পারতো। এ কারণেই হয়তো আমাদের পূর্ব পুরুষেরা রসিকতায় টইটম্বুর হয়ে কটাক্ষ করে নাম রেখেছেন নাইতখালী বা নাপিতখালী। ‘খালী’ শব্দাংশ খালের ক্ষুদ্র রূপ। আমাদের গ্রামে এবং অবশ্যই চট্টগ্রামজুড়ে নদীকে খাল বলে। আমরা নদীর পাড় না বলে বলি ‘খালকূল’। নাপিতখালী কর্ণফুলির সরু সোঁতা বলেই তা ‘খালী’ নামে পরিচিত। জোয়ারের সময় নাপিতখালী উপচে পড়ে। ‘নাপিত’ শব্দের আরও একটা কটাক্ষপূর্ণ কিন্তু রসালো ব্যবহার আছে। গ্রামেগঞ্জে কিছু কবিরাজ বা বৈদ্য আছেন যারা বিদ্যাধারী না হয়েও দেখতে দেখতে বা শুনতে শুনতে কবিরাজ হয়ে যায়। এদেরকে ঠাট্টা করে বলা হয় ‘নাইতা বৈদ্য’। মানে নাপিতের মতো বৈদ্য। অর্থাৎ এরা ঠুনকো কবিরাজ বা ঠুনকো বৈদ্য। এদের ওপর আস্থা রাখা যায় না। একটার চিকিৎসা করতে এসে আরেকটা ঝামেলা পাকিয়ে যায়। এই নাপিতদের নিয়ে গ্রামাঞ্চলে তীব্র একটা কুসংস্কার প্রচলিত আছে। পল্লি অঞ্চলে ধারণা করা হয়, ভোরে নিদ্রা-জাগ্রত হয়ে কেউ নাপিতের মুখ দর্শন করা বা নাম মুখে নেওয়া বা কানে শোনাটাই অশুভের লক্ষণ। তার দিনটা হয় মাটি হবে নইলে কিছু না কিছু অনর্থ ঘটবে বা খারাপ যাবে। এ ধারণার উৎপত্তি কেন হলো তা উদ্ধার করা যায়নি। সকালে নাপিতের নাম নেওয়া নিয়ে একটা ঘটনা আজও মনে আছে। আমার জেঠতুতো দাদা, যাকে আমরা মাইজ্যা বলে ডাকতাম। তিনি ছিলেন শশাঙ্ক জেঠার মেজো ছেলে। তাই মাইজ্যা। তিনি পড়তে বসেছেন ভোরে উঠে। তার পড়ার বিষয় ছিলো ইংরেজি শব্দার্থ। পড়ছিলেন, Barbar নাপিত, Barbar নাপিত। বি এ আর বি এ আর বার বার। বার বার মানে নাপিত। ঐ সময় আমার জেঠিমা মানে মাইজ্যার মা যাচ্ছিলেন পুকুরে, আগের রাতের এঁটো হাঁড়ি-পাতিল মাজতে। তিনি মাইজ্যার মুখে নাপিতের নাম শুনে দিলেন ধমক। ‘ অ্যাই, বেয়ানবেলা এইসব কুসাঁইতের নাম লঅরদ্দে কিল্লাই? বন্ধ গর্। ‘ ( হেই, সকালবেলা এসব কুফার নাম নিচ্ছিস্ কেন? বন্ধ কর্।) অনেকদিন আগের সেই ঘটনা আমার মায়ের মুখে শুনতে শুনতে আজও স্মৃতিতে ঝলমলে হয়ে আছে। আমার বাবাকেও দেখেছি, সকালে যদি কোনো ক্ষৌরকার্য করার জন্যে পাড়ায় নাপিত আসতো তখন বাবা একটু ঘুরিয়ে তা মাকে বলতেন। বাবা সকালে খুব বেশি প্রয়োজন হলে বলতেন, ‘ও পাখি, তোমার চুলের মিস্ত্রি এসেছে।' আমার মায়ের নাম ছিলো পাখি। বাবা মাকে সম্বোধন করে ‘নাপিত এসেছে ‘ কথাটা সরাসরি না বলে ‘চুলের মিস্ত্রি' এসেছে বলতেন। বাবাকে আরও একটা শব্দ সকালবেলায় ঘুরিয়ে বলতে শুনেছি। তা হলো কলা। সকালে কোনো শুভ কাজে কলা প্রয়োজন হলে বাবা বলতেন ‘পত্রগোটা’। গোটা মানে হলো স্থানীয় ভাষায় ফল। পত্র শব্দটা সাধারণত কলাগাছের পাতাকে বুঝানো হতো। চট্টগ্রামের ভাষায় কলাপাতাকে (আংশিক বা পূর্ণ) ‘বরখ’ বলা হয়। এই ‘বরখ’কে ‘পত্র’ সম্বোধন করে কলাকে ঘুরিয়ে ‘পত্রগোটা’ বলতেন বাবা। এটা গাঁয়ের অনেক প্রবীণ আজও বলে থাকেন। সে যাক, সেবাখোলার কথা বলতে গিয়ে নাপিতখালীর স্রোতে একটু দূরে চলে আসলাম। এবার ফিরে যাই সেবাখোলায়। ‘খোলা’ শব্দটা প্রমিত বাংলায় উন্মুক্ত বুঝানো হলেও চট্টগ্রামের ভাষায় এটার আরও তিনটে ব্যবহার আছে। প্রথমত মাটির পাতিল বা হাঁড়িকে খোলা বলে। সাধারণত এসব খোলায় চাল ভাজে, পিঠে বানায় কিংবা মুড়ি ভাজে। আরেকটা ‘খোলা’ হলো টলটলে ঝোল বা রসা দিয়ে বানানো তরকারি। যেমন : মরিচখোলা। মরিচখোলা বলতে মাটির হাঁড়িতে টলটলে পানি ও বেশি মরিচের গুঁড়ো দিয়ে দুয়েকটা ‘ফাতরা শুঁটকি’ এবং রসুন সহযোগে ঝোল তরকারি তৈরি করা। অর্থাৎ ‘খোলা’ বলতে এই মরিচের ঝোল তরকারিকেও বুঝায়। তৃতীয় ‘খোলা’ হলো মাঠ বা ক্ষেত্র। যেমন : ময়দানখোলা। তেমনি সেবাখোলা বলতে মা মগধেশ্বরীর অর্ঘ্যক্ষেত্রকে বোঝায়। ছোটবেলায় এই সেবাখোলার দিকে কেউ যদি সরাসরি আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করতো তবে বড়োরা বলতো, ‘এভাবে দেখায় না।’ কেন দেখায় না তা বলতো না। কিন্তু কেউ যদি কখনও সরাসরি আঙুল দিয়ে সেবাখোলাকে নির্দেশ করতো তবে তাকে বলা হতো, তার দুহাতের আঙ্গুল ভাতের গ্রাস ধরার মতো ধরে ভাঁজ করে মুখে পুরে তাতে হাল্কা কামড় দিতে। এটাই ছিলো তার প্রায়শ্চিত্ত। কেন এটা করা হতো তার কোনো ব্যাখ্যা কারও কাছে পাইনি। ঠিক তেমনি করে চিতা বা শ্মশানের দিকে সরাসরি আঙ্গুল নির্দেশ করলেও তা করতে হতো। এগুলো বাধ্যতামূলক ছিলো না, তবে কারও কারও চর্চা ছিলো। এগুলো প্রগাঢ় ভক্তি বা সমীহজাত লোকাচারই বটে। আমাদের গ্রাম হলো নদীবর্তী। তাই গ্রাম হতে শহরে আমাদের শৈশব-যাতায়াত ছিলো নৌযান নির্ভর। আমাদের প্রধান বাহন ছিলো সাম্পান। গ্রামের মানুষকে দেখতাম, সাম্পানে করে গ্রাম হতে শহরে গেলে যাত্রার শুরুতে হাতে অল্প নদীর পানি নিয়ে সব যাত্রীর মাথার উদ্দেশ্যে ছিটিয়ে দিতে। এটা নাকি নদী মাতানো বলে। মাতানো বলতে নদীর আশীর্বাদ কামনা করা। যাতে নৌযাত্রা নিরাপদ হয়। এটা করতো যে সাম্পানের মাথির দিকে বসতো সে। এরকম আমাদের মাথাতেও মাঝে মাঝে নদীর আশীর্বাদের জলবিন্দু এসে পৌঁছাতো। আমরা যখন এক সাম্পান বোঝাই হয়ে একেবারে গ্রামের পাট চুকিয়ে শহরে আসি, তখন আমার বাবাকেও এরকম জল ছিটাতে দেখেছি। এই জলের মধ্যে মিশে থাকতো গ্রামের মমতা আর নদীর প্রতি ভালোবাসার অদ্ভুত আর্দ্রতা।

মায়ের একটা অভ্যাস ছিলো, কারও জন্মদিনে তার মাথার চুল কাটতে দিতেন না। বলতেন, এতে নাকি অমঙ্গল হয়। বুঝতাম না, কেন অমঙ্গল হবে। কিন্তু মা বলেছেন, তাই মাতৃআজ্ঞা শিরোধার্য। মায়ের আরও একটি চর্চা ছিলো, শনি-মঙ্গলবারে কোনো শুভ কাজ না করা এবং মাথার চুল না কাটা। কারণ তাঁর ভাষ্যে এ দুটো দিন অপয়া। এটা শুধু মায়ের চর্চা ছিলো না, গ্রামে আজও অনেকেরই চর্চা হিসেবে চালু আছে। আমাদের ঘরে নখ কাটা নিষেধ ছিলো। নখ কাটতে হতো ঘরের দাওয়ায় বসে। স্নানের পরে নখ কাটতে দিতেন না। নখ কাটতে হতো স্নানের আগে। গ্রামে সাঁঝের বেলায় কোনো দোকানে সুঁই কিনতে পাওয়া যেতো না। এমনকি দোকানে থাকলেও নাই বলে দিতো। কেন রাতে সুঁই বিক্রি করতো না তা বুঝতাম না। এ চর্চাটা শহরে এসেও পেয়েছি, দুলালের (দুইল্যা) দোকানে। কখনও কাউকে গ্রামে স্যান্ডো গেঞ্জি সেলাই করে পরতে দেখিনি। গেঞ্জি নাকি সেলাই করে পরে না। এতে অমঙ্গল হয়। কাউকে পয়সা দিয়ে কড়ি খেলতে দিতো না গুরুজনেরা। এতে নাকি ঐ পরিবার দরিদ্র হয়ে পড়ে। ঘরের পুরুষদের পাতে মায়েদের কখনও পোড়া লাগা ভাত বা হাল্কা বাদামী হওয়া ভাত দিতে দেখি নাই। তবে মেয়েদের পাতে এ রকম ভাতের বেশ চাহিদা ছিলো। ভাঙ্গা থালায় ভাত, ভাঙ্গা কাপে চা কিংবা ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখতেও কাউকে দেওয়া হয়নি অমঙ্গলের ভয়ে। এটা কি আদতে দেখতে খারাপ দেখায় তাই, নাকি সত্যিই কোনো অমঙ্গল হতো তা বুঝার অবকাশ ছিলো না। পাতিলের ঢাকনায় বা হাঁড়ির বরুণায় কোনো ছেলেকে খাবার খেতে দেওয়া হতো না গ্রামে। এখনও কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে এ লোকবিশ্বাস। যুক্তি ছিলো, এতে নাকি ছেলেদের দাড়ি উঠে না। আদৌ সেরকম কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না তা বলা মুশকিল। ফুলের ঝাড়ু রাখতে হতো হাতল নিচে দিয়ে। এর উল্টো হলে কথা শুনতো যে রেখেছে সে। দুটো ঝাড়ু মুখোমুখি রাখতেই দিতো না মুরুব্বিরা। কারণ এতে নাকি গায়ে পড়ে ঝগড়া হয়। নতুন শলার ঝাড়ু প্রথম ব্যবহার করতে গেলে বড়োদের দেখেছি একটা শলাকে ভেঙে ফেলতে। তারপর শুরু হতো ঝাড়ুকর্ম। তেমনি নতুন শাড়ি প্রথমবার পরতে গেলে মা-বোনদের দেখতাম, ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে আঁচলের দিকটা হাল্কা করে পুড়িয়ে নিতে। এতে নাকি কুনজর লাগার ভয় থাকতো না। খালি কলসি দেখে বের হতে না দেওয়া কিংবা যাত্রা শুরু করলে পেছন হতে না ডাকা, এসবই সব জায়গায় সব যুগে চালু ছিলো এবং আছে। শুধু যে আমাদের গাঁয়ে ছিলো তা নয়।

গ্রামের হাট থেকে সন্ধ্যায় মাছ কিনে আনাটা ছিলো কষ্টকর। আনা বারণ ছিলো। আর আনলেও সাথে একটা লোহা জাতীয় কিছু রাখতে হতো। মা-দাদীদের ধারণা, মাছের পেত্নী পিছু নিতে পারে। তেমনি গর্ভবতী মায়েদেরও শাড়ির আঁচলে একটা ম্যাচ বা লাইটার বেঁধে রাখতে হতো শুধু আলগা বাতাসের ভয়ে। এই আলগাটা যে কী জিনিস তা কে বলবে! এইতো সেদিনও চালু ছিলো রেওয়াজটা। কারও হাতের আঙ্গুলে মাছের কাঁটা ফুটে কলাগাছ হয়ে গেলে বেড়ালের পা ধরে মাফ চাইতে হতো। ক্ষেত্র বিশেষে বেড়ালের মূত্র লাগাতে হতো। যুক্তি ছিলো, মাছের কাঁটায় বেড়ালের হক। তার হক নষ্ট করার একটা খেসারত তো আক্রান্ত ব্যক্তিকে দিতে হবে। ছোটকাল থেকেই নবজাতককে কোমরে কালো রেশম বা তাগ্গি পরানো হতো। এটা পরানো হতো কারণ, মানুষ সুতো ছাড়া আসে, সুতো ছাড়া যায়। সুতরাং যতক্ষণ দুনিয়ায় আছে, গায়ে তার নিদেনপক্ষে একটা সুতো হলেও থাকতে হবে। গ্রামে কারও ঘন ঘন বাচ্চা মারা গেলে তার সদ্যোজাত জীবিত বাচ্চাকে পোষ্য দেওয়ার রীতি চালু আছে। আমার ছোট ভাইকেও এক পয়সার বিনিময়ে আমার মা গ্রামীণ এক পিসির কাছে পোষ্য দিয়েছিলেন। তখন সে ঘন ঘন মারাত্মক অসুখে পড়তো। এটাকে আমাদের গ্রামে বলতো পোষ্যণ দেওয়া। আবার যাদের ছেলেমেয়ে ঘন ঘন মারা যেতো, তারা তাদের পরবর্তী বাচ্চার নামও রাখতো সেরকম করে। আমাদের পাড়াতে এরকম কয়েকজন ছিলো। পুরুষ একজনের নাম ছিলো ‘পেডাইন্যা’। গ্রামীণ ভাষায় ‘পেডাইন্যা’ মানে হলো কুড়িয়ে পাওয়া। মানে পেডাই পাওয়া। নারী একজনকে নাম দেওয়া হয়েছিলো ‘মাইট্যা পুতলা’। অর্থাৎ মাটির তৈরি পুতুল যা ক্ষণভঙ্গুর। এরকম তুচ্ছ নাম দিয়ে তাতে নাকি যমের অরুচি তৈরি করা হতো। হায়রে! কী বিশ্বাস! তবে এ ধরনের নাম দেওয়ার পর আর মরেনি। রাতের বেলায় একবার জংলী কোকিলের ডাক শুনতে পেয়েছিলাম শৈশবে। আমার পাশে থাকা মাকে বলতে শুনি, তিনি ঐ জংলী কোকিলকে শাপ শাপান্ত করে বলছেন, কাদের ঘরে কে মরে আজ বলা যায় না। আদতে জংলী কোকিলের ডাকের সাথে মানুষের মৃত্যু পরোয়ানার কোনো সম্পর্ক আছে কি না তা কেউ বুঝিয়ে বলেনি কখনও।

আমার বাবার এক খুড়ো ছিলেন। তিনি বেশ দশাসই ছিলেন। হাত-পা দেখেই বোঝা যেতো তাঁর শক্তিমত্তা। তাঁকে নিয়ে একটা কিংবদন্তি গল্প আছে। একবার নাকি তাঁদের যৌবনকালে মলবায়ু ছেড়ে ধুলোর স্তূপ বা পাহাড় ওড়ানোর প্রতিযোগিতা হয়েছিলো। তিনি তাতে বিজয়ী হয়েছিলেন। এরকম অদ্ভুত শক্তি যাচাইয়ের প্রতিযোগিতা সেসময় গ্রামে হতো অহরহ। তখন তো আর এতো চ্যানেল বা বিনোদন ছিলো না। যাই হোক, আমার এই ঠাকুরদার উঠোনে একটা নারকেল গাছ ছিলো। তাতে নাকি পাতার চেয়ে বেশি ডাব ফলতো। একবার তাঁর কাছে ফেঁদু নামে একজন পাঠান পাড়া থেকে লোক আসলেন দেখা করতে। উঠোনে এসে ফেঁদুর চোখ যায় নারকেল গাছের দিকে। তিনি তা দেখেই নাকি বলেছিলেন, ওম্মারে মা! কত্ত নারিকেল! তার এ কথা শুনে আমার ঠাকুরদা-দাদী নাকি বেশ চিন্তিত ছিলেন। কী না কী হয়! কারণ ফেঁদুর নাকি মুখদোষ সর্বজন বিদিত। তিনি কোনো কিছুর দিকে চেয়ে কিছু একটা বললেই নাকি তৎ নগদ ফলাফল পাওয়া যেত। স্বয়ং তার বউও নাকি তার সামনে তার ছেলেমেয়েদের ভাত খেতে দিতো না, কখন না আবার তার বদনজর বা মুখ পড়ে যায়। তো ঘটনা কিন্তু তারপরদিন ঘটেই গিয়েছিলো। আমার দাদুর সেই অগণন নারকেলের গাছটা অকারণে একরাতেই ফলশূন্য হয়ে ভারমুক্ত হয়ে গেছিলো। অপরিণত ফলগুলো টুপ টুপ করে সারারাত ধরে পড়ে গাছ পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেদিন থেকে সারাগাঁয়ের নারকেল ও কাঁঠালের গাছগুলোতে ফেঁদু আতঙ্কে চুনের দাগ লাগানোর হিড়িক পড়ে গেছে। সবার ধারণা ও বিশ্বাস, চুন লাগালে মুখ পড়ে না বা বদনজর আছর করে না।

কোথাও বেড়াতে গেলে ঘর হতে বের হওয়ার সময় গ্রামের কাউকে কখনও তিনজন নিয়ে বের হতে দেখিনি। তিনজন যদি কোথাও যাওয়াই লাগতো, তবে একজন আগে বের হয়ে যেতো এবং পরে আর দুজন বের হয়ে রাস্তায় একত্র হয়ে যাত্রা করতো। প্রথম যখন টিউবওয়েল লাগানো হলো আমাদের বাড়িতে, দেখলাম, মিস্ত্রিরা ডাব খেতে চাইছে। ঘটনা কী? জিজ্ঞেস করে জানলাম, টিউবওয়েল লাগানোর সময় মিস্ত্রিরা ডাব খেলে নাকি নলকূপ দিয়ে ডাবের পানির মতো মিষ্টি জল আসবে। আহারে! বাঙালির কতো সংস্কার আর কতো কুসংস্কার! নতুন শাড়ি পরলে আবার বাড়ির গুরুজনকে প্রণাম করতে হতো মায়েদের। বেছে বেছে রবিবারেই মা নতুন শাড়ি পরতেন। এটাই নাকি শুভ। চিতই পিঠা বানাতে গেলে আমাদের গ্রামের নারীদের দেখতাম তারা মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন। কারণ কী? এরকম করলে নাকি পিঠা ফুলে উঠে। আহা! বিপুলদা নামে আমাদের গ্রামে এক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি ভিন্ন পাড়ায় গৃহশিক্ষকতা করতেন। আমাদের কারও দাঁত নড়লে তিনি ডেকে ডেকে আঙ্গুল দিয়ে ঠেলে ফেলে দিতেন। তারপর সেই দাঁত নিয়ে মায়ের কাছে এলে মা বলতেন ইঁদুরের গর্তে ফেলতে। কেন? কারণ তাতে নাকি নতুন দাঁত যেটা উঠবে তা ধারাল হবে এবং মজবুত হবে। ছড়াও কাটতে হতো দাঁত ফেলে, ‘আঁর দাঁত তুই ল, তোর দাঁত আঁরে দে।’ অর্থাৎ, আমার দাঁত তুই নে আর তোর দাঁত আমাকে দে। কিন্তু দাঁত উঠলে দেখা যেতো, নতুন গজানো দাঁত যেন শাবলের মতো চ্যাপ্টা হয়ে উঠেছে, ইঁদুরের দাঁতের মতো সরু নয়। (চলবে)

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়