সোমবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৫
জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয় অন্যান্য

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ০১:২৫

আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অল্প বয়সী ধূমপায়ীদের সংখ্যা-১

দায়িত্বশীলদের নির্লিপ্ততায় ধ্বংস হচ্ছে সোনালী প্রজন্ম

মুহাম্মদ আরিফ বিল্লাহ
দায়িত্বশীলদের নির্লিপ্ততায় ধ্বংস হচ্ছে সোনালী প্রজন্ম

'ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর' এই স্লোগান যতোটা না প্রচার করা হয় তারচে' আকর্ষণীয়ভাবে এর বাণিজ্যিক প্রসার করা হয়ে থাকে। তরুণ প্রজন্মকে নানাভাবে প্ররোচিত করা হয়ে থাকে ধূমপানে আসক্ত হতে। যার ফলে বর্তমানে অল্প বয়সী তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে, যা আমাদের সমাজ, স্বাস্থ্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে এক ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে করে লাভবান হচ্ছে সিগারেট উৎপাদনকারী বহুজাতিক কোম্পানি, আর ধ্বংস হচ্ছে আমাদের সন্তান, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

প্রকাশ্যে যত্রতত্র পাবলিক প্লেস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কোনো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ধূমপান করে থাকে ছোট এবং বড়োরা। এক সময় ধূমপান কেবল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এই শ্রেণিরও অধিকাংশ আড়ালে আবডালে ধূমপান করতো। সেই ধূমপানের চিত্র এখন আধুনিক হয়েছে। এখন সেটি স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কিশোর-কিশোরীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। তারা প্রকাশ্যে যেখানে সেখানে লজ্জাহীনভাবেই তাদের ধূমপানের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো পরিবেশটা এমন হয়, বয়স্করা অল্প বয়সীদের ধূমপান দেখে মাথা নিচু করে অন্য পথ ধরে পাশ কাটিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাছাড়া প্রকাশ্যে ধূমপানের কারণে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে অধূমপায়ীরা। পরোক্ষ ধূমপায়ীরাও প্রত্যক্ষ ধূমপায়ীদের মতো ক্যানসারসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকে।

ধূমপান নিয়ন্ত্রণে ২০০৫ সালে প্রণীত জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন অনুযায়ী, প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা ধরা হয়েছিলো ৫০ টাকা। কিন্তু পরে ২০১৩ সালে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের সংশোধনী এনে জনসমাগমস্থলে ধূমপানের শাস্তির অর্থ ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা হয়। কিন্তু আইন না জানা ও ভাঙ্গায় অভ্যস্ত লোকজনের অবস্থা তাতে বদলায়নি সামান্যও। এছাড়া আইনপ্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারছে না অজানা কারণে।

ধূমপান প্রতিরোধে শিক্ষার্থী সমাজও সোচ্চার। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছে লালমাটিয়া মহিলা কলেজের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। ৪ আগস্ট ২০২৫ কলেজ প্রাঙ্গণে নারী মৈত্রী ও লালমাটিয়া মহিলা কলেজ রেঞ্জার গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দ্রুত পাসের দাবি’ শিরোনামে দিনব্যাপী স্বাক্ষর কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা আইনটি শক্তিশালী করার পক্ষে নিজেদের দৃঢ় মনোভাব প্রকাশ করে।

ধূমপান শুধু একজন ধূমপায়ীর শারীরিক ক্ষতিই করছে না বরং মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকেও মারাত্মক ক্ষতি সাধন করছে। যে সকল কারণে অল্প বয়সী ধূমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু বিষয় লক্ষ্য করা গেছে। বলা চলে এসব কারণ প্রমোট করছে কর্পোরেট দুনিয়া। যেমন-অল্প বয়সীরা সহজেই নতুন কিছু চেষ্টা করতে আগ্রহী হয়। সিগারেট বা ভ্যাপিং তাদের কাছে বড়ো হয়ে ওঠার প্রতীক মনে হয়। বন্ধুদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেতে গিয়ে অনেকেই ধূমপানের মতো ক্ষতিকর বাজে অভ্যাসে জড়িয়ে পড়ছে।

ইন্টারনেটের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়া ও বিজ্ঞাপন, সিনেমা এবং টিভি সিরিজে ধূমপানকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়, যা তরুণদের মনে ধূমপান সম্পর্কে একটি উচ্চ ধারণা তৈরি করে। এ ধারণা প্রচারে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা রাখছে নামী দামী কোম্পানি, বিনোদন জগতের ব্যক্তিবর্গের স্টাইলিস্ট অঙ্গভঙ্গিসহ কর্পোরেট ক্ষেত্রগুলো। অনেক সময় অভিভাবকরা সন্তানের কার্যক্রমের প্রতি যথাযথ নজর রাখেন না। ফলে তারা কার সঙ্গে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, সেসব বিষয় অজানাই থেকে যায়।

এছাড়া মানসিক চাপ ও হতাশা, শিক্ষার চাপ, পারিবারিক সমস্যা, আত্মবিশ্বাসের অভাব ইত্যাদি কারণে অনেক কিশোর মানসিক শান্তির খোঁজে ধূমপান শুরু করে। সহজলভ্যতা ও আইন প্রয়োগের দুর্বলতার কারণে সিগারেট, ই-সিগারেট, ভ্যাপার প্রভৃতি কিশোর-কিশোরীদের কাছে সহজলভ্য হয়ে গেছে। আবার বিক্রেতাগণ বয়স যাচাই না করেই এসব বিক্রি করে থাকে অনায়াসে। এ সব কারণে অল্প বয়সীদের মাঝে ধূমপানের প্রবণতা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ধূমপানের ফলে মানসিক অস্থিরতা তৈরির পাশাপাশি এর প্রতি আসক্তি তৈরি হয়, যা থেকে বের হওয়া অনেক কঠিন। ধূমপানে আসক্ত ব্যক্তিরা বা কিশোর কিশোরীরা স্বাভাবিক কাজকর্মের প্রতি মনোযোগ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া ধূমপানে আসক্তরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ে। ফুসফুসের ক্ষতি, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি। ধূমপায়ী ব্যক্তি পরিবার ও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, নৈতিক অবক্ষয় ঘটে, অপরাধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহু গুণে।

প্রতিরোধে করণীয় :

ধূমপান প্রতিরোধে প্রথম যে করণীয় তা হলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সিগারেট বা এ জাতীয় বস্তুর উৎপাদন বিশ্বব্যাপী বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। উৎপাদন বন্ধ হলে তামাকজাত পণ্যের ভয়াবহতা থেকে বিশ্ব মানবতা মুক্তি পাবে।

আপনজন, ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী ও মাতা-পিতার কল্যাণ কামনায় ধূমপান বর্জনে নিজ থেকে উদ্যোগী হতে হবে। সরকারি বেসরকারি প্রচার মাধ্যমগুলোকে এ বিষয়ে বাস্তব ভূমিকা পালন করতে হবে। পত্রপত্রিকা ও রেডিও-টিভিতে ধূমপানের প্রচার বন্ধ করতে হবে এবং ধূমপান প্রতিরোধে এর ক্ষতিকর বিষয়গুলো জনসম্মুখে ব্যাপকভাবে তুলে ধরার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

প্রতিরোধের পাশাপাশি তামাক চাষ বন্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তামাকজাত সব পণ্যের আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। তামাক চাষ ও শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অন্য কোনো লাভজনক কৃষিপণ্যের চাষ এবং শিল্প খাতে পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা করা। ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্বন্ধে জনগণকে সজাগ ও সচেতন করে তোলার জন্যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, হাট-বাজারে প্রামাণ্য আলোকচিত্র, অডিও-ভিজুয়াল প্রোগ্রাম ইত্যাদির মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

ধূমপান প্রতিরোধে এর পরেই পরিবারের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটি একজন ধূমপায়ীর সচেতন হওয়ার প্রথম পর্যায়। পরিবারের দায়িত্বশীল বিশেষ করে বাবা-মায়ের সন্তানদের সময় দেয়া, খোলামেলা কথা বলা, আস্থা গড়ে তোলা খুবই জরুরি। তাদের উচিত সন্তানদের সন্দেহজনক আচরণে নজর দেয়া এবং ধৈর্যের সাথে সহায়তা করা। বাবা-মা ধূমপায়ী হলে পরিত্যাগ করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধূমপানের কুফল নিয়ে নিয়মিত ক্লাস বা কর্মশালার আয়োজন করতে হবে। এ কাজের সফল বাস্তবায়নে মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের নেতৃত্বে আনতে হবে।

আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কাছে তামাকজাত পণ্য বিক্রি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধূমপানবিরোধী বিজ্ঞাপন এবং কড়া বার্তা গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে।

ধূমপান প্রতিরোধে মতলব দক্ষিণ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. সালেহ আহমেদ বলেন, অল্প বয়সী ধূমপায়ীরা অধিকাংশই শ্রমিক আর কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী। যারা কিশোর গ্যাং দ্বারা প্রভাবিত। এদের প্রতিরোধে পুলিশ প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে অল্প বয়সী ধূমপায়ীদের এবং কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রকাশ্যে ধূমপান এবং অল্প বয়সী ধূমপায়ীদের প্রতিরোধে মতলব দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে করোনা মহামারী পরবর্তী কিশোর প্রজন্ম অস্বাভাবিকভাবে ধূমপানে আসক্ত হয়ে পড়েছে। যা শুধুমাত্র আইন প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্যে পারিবারিক শিক্ষা, মূল্যবোধের ওপর পরিবারের দায়িত্বশীলদের বিশেষ নজরদারি বৃদ্ধি এবং সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার।

এছাড়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাতীয় তামাক দিবসে যুবকদের সমন্বয়ে শ্রমজীবী, গণমাধ্যমকর্মী ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষদের নিয়ে ধূমপান প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক সেমিনার করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, পাবলিক প্লেসে ধূমপান প্রতিরোধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।

অল্প বয়সীদের মধ্যে ধূমপানের প্রবণতা যে হারে বাড়ছে তা নিঃসন্দেহে আমাদের ভবিষ্যৎ সমাজের জন্যে একটি ভয়াবহ বার্তা। এটি রোধ করতে হলে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকার—সবার একত্রে সচেতন ও সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এখনই যদি আমরা সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যতে এর পরিণতি আরো ভয়াবহ হতে পারে।

ডিসিকে/এমজেডএইচ

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়