প্রকাশ : ১৪ অক্টোবর ২০২৫, ০২:২৯
আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অল্প বয়সী ধূমপায়ীদের সংখ্যা-৩
বিড়ি-সিগারেটের হাত ধরেই প্রবেশ হয় মাদকের অন্ধকার জগতে

অল্প বয়সী ধূমপায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদকসেবীদের সংখ্যা। পেশার ভিত্তিতে মাদক ব্যবহারকারীর হার শ্রমিকদের মধ্যে সবচে' বেশি। এক জরিপ অনুযায়ী এরা মোট মাদকসেবীর ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর ৭ শতাংশ বেকার জনগোষ্ঠী। ব্যবসায়ী ৪ দশমিক ৩ শতাংশ, কৃষক ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং চাকুরিজীবী ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থনৈতিক অবস্থা অনুসারে বেশি আয়ের মানুষের মধ্যে মাদক সেবনকারীর সংখ্যা বেশি। ২০১৩ সালে দেশের স্বনামধন্য চিকিৎসক ডা. নাহিদুজ্জামান সাজ্জাদসহ একদল গবেষক মাদকসেবীদের নিয়ে করা এক গবেষণায় উল্লেখ করেছেন যে, ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ মাদকসেবী বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়।
|আরো খবর
এছাড়া গ্রামাঞ্চলের রাস্তার মোড়ে গড়ে ওঠা দোকানপাট, যেখানে স্কুল-কলেজগামী ছেলেরা সন্ধ্যার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডায় মজে থাকে। এ সময় তারা সিগারেটে সুখ টান দিয়ে মোবাইল গেমে ব্যস্ত থাকে। যা মাদকের চেয়েও ভয়াবহ নেশায় পরিণত হয়েছে। যাদের কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছে তাদের অভিভাবকগণ। সুস্থ, সুন্দর ও আদর্শ নাগরিক তৈরিতে মাদক এবং মোবাইল আসক্তিতে মগ্ন হওয়া ছেলেদের সুস্থ ধারার পরিবেশে ফিরিয়ে আনতে দায়িত্বশীল নাগরিকের ভূমিকা পালন করা একান্ত আবশ্যক। তাছাড়া উঠতি বয়সী ছেলেদের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরাও ধূমপান ও মাদকে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে।
মাদক ব্যবসায়ের আঞ্চলিক প্রভাব, ক্ষেত্রবিশেষে ভাগ-বাঁটোয়ারা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মারামারি খুনাখুনির খবর প্রায়ই দেখা যায়। এমনই একটি ঘটনা চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার। স্থানীয় এবং জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, চলতি বছরের ৩০ জুন সন্ধ্যায় মতলব দক্ষিণে সীমানা অতিক্রম করে মাদক বিক্রি করাকে কেন্দ্র করে দু পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে একজন। আবার এই বিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে মামলাও হয়েছে থানায়। যাকে কেন্দ্র করে ২ জুলাই উপজেলা সদরে সুশীল সমাজ, প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিগণ, বিভিন্ন সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠন প্রতিবাদ সমাবেশ এবং মানববন্ধন করেছেন।
এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছে শান্তিপ্রিয় মানুষ। কিন্তু এতে কি মাদক বিক্রি বন্ধ হয়েছে? কারণ এই ঘটনাটি নিছক দু পক্ষের বিরোধ নয়, বরং মাদক কারবারিদের বেপরোয়া অবস্থান এবং প্রশাসনিক ও সামাজিক ব্যর্থতার নগ্ন চিত্র। এই চিত্র মতলব দক্ষিণসহ সারা দেশের। এতো বড়ো বড়ো নেতা জনপ্রতিনিধি, দেশহিতৈষী এবং রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিদের নাকের ডগায় প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে হরেকরকম মাদক বিক্রি হচ্ছে । এটি কেবল লজ্জাজনক নয়, এটি সমাজের শান্তি, নিরাপত্তা ও মূল্যবোধের ওপর সরাসরি আঘাত।
মাদকাসক্তির সংখ্যা জানতে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষার ফলাফল পাওয়া যায় ২০১৮ সালে। তখনকার হিসেব অনুযায়ী দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ছিলো ৩৬ লাখের উপরে। দেশে প্রথম বারের মতো করা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঐ সমীক্ষার হিসাবের ধারাবাহিকতায় ধরে নেয়া যায়, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা ১ কোটির উপরে।
এ ছাড়া ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলা, চাঁদপুর সদর উপজেলা এবং লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলায় ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির উৎপাদিত সিগারেট বিপণনের ওপর একটি জরিপ চালানো হয়। তখনকার জরিপ অনুযায়ী ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির উৎপাদিত সিগারেট বিপণনের জন্যে উল্লেখিত তিন উপজেলায় মোট ৫৩ জন বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলো। উক্ত কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি মাসুদ মিয়াজির সাথে কথা বলে জানা গেছে, তাদের প্রত্যেক প্রতিনিধির সাপ্তাহিক গড় বিক্রয় ৬ লাখ টাকা।
সে হিসেবে ৫৩ জনের সাপ্তাহিক গড় বিক্রয় ৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা। এটা মাসের হিসেবে ১২ কোটি ৭২ লক্ষ টাকা। এই তিন উপজেলায় একটি কোম্পানির দৃশ্যমান সিগারেট বিক্রয়ের পরিসংখ্যান যদি এমন হয়, তাহলে সিগারেটের অন্যান্য কোম্পানি এবং গাঁজা, ইয়াবা, মদসহ সারা দেশে মাদক বিক্রয়ের পরিসংখ্যান কেমন হতে পারে সেটা সহজে অনুমান করা যায়।
দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে গত ১৮ আগস্ট ২০২৫ তারিখে ১ম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা উত্তর ইউনিয়নের দিনমজুর মো. বাবুল হোসেনের মাদকাসক্ত ছেলে মো. হাছানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পিতা-মাতা উভয়ে ছেলেকে পুলিশে দিয়েছেন। হাছানের মা আম্বিয়া বেগম বলেন, বাবা, আর পারি না, অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। ছেলেমেয়েরা খুনি হলেও বাবা-মা সন্তানের পক্ষ নেয়। এই ছেলে আমাদের পুরো পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমার এই ছেলের হাতে যারা মাদক তুলে দিয়েছে, তারা আমার পরিবারটাকে ধ্বংস করেছে। এটা ছিলো মাদকের করাল গ্রাসে নিপতিত একজন ভুক্তভোগী বাবা-মায়ের করুণ আর্তনাদের বাস্তব চিত্র।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চাঁদপুর-এর সহকারী পরিচালক মু. মিজানুর রহমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বলেন, তামাক গ্রহণের মাধ্যমে একজন ধূমপায়ী মাদকের জগতে প্রবেশ করে। বাংলাদেশে মাদক একটি সামাজিক ব্যাধি। এটা কেবলমাত্র আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করা সম্ভব নয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করতে সমাজের শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, মসজিদের ইমাম এবং জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা একান্ত জরুরি। প্রয়োজনে মাদকসেবী এবং মাদক কারবারিদের সামাজিকভাবে কার্যকর প্রতিরোধের ব্যবস্থা করে তাদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে সংশোধনীমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবেই আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ আগামী প্রজন্মের জন্যে বাসযোগ্য একটি ভূমি হবে।
অ্যাটর্নি জেনারেল ফর বাংলাদেশ অ্যাডভোকেট সাইফুল ইসলাম মিয়াজী বলেন, ধূমপান প্রতিরোধে আইন রয়েছে। তবে তা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের পাশাপাশি স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এগিয়ে আসতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশে ধূমপান আইন দ্বারা নিষিদ্ধ নয়, সেহেতু জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় তা প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন।
ডিসিকে /এমজেডএইস