প্রকাশ : ২৩ জুন ২০২৫, ০৯:৪৫
হৃদয়বতী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

দুই.
প্রতিটি মানুষের কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। যে মানুষের মন নোংরা, কলুষিত তাকে তুমি যতোই ভালোবাসো না কেনো একদিন সে তোমার ক্ষতি করবেই। বসে বসে ভাবছিলো অনন্যা। সে তার জীবনের কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নিয়ে হতাশ। তাই তার মনে হলো তার বোনদের সাথে বিষয়টি আলোচনা করে সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
তাদের তিন বোনেরই মনে হলো পড়াশুনা আর ভালো লাগছে না। বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলেই বাঁচে। তাই তিনবোন একদিন একসাথে মিলিত হলো।
জরুরি বৈঠক।
জায়গাটা বেশ নিরিবিলি একটা জলাধারের পাশে। পুকুরে হাঁসগুলো ডুবছে আবার ভেসে উঠছে। পাড়ে বসে এসবই খেয়াল করছিলো অনন্যা। নীরবতা ভেঙ্গে প্রথমেই কথা বললো রুবিনা। সে বড়ো বোন অনন্যাকে বললো, ‘আসলেই আমার ভালো লাগছে না। মনে হয় দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। যেখানে কোনো বাধা থাকবে না। কোনো শাসন, বারণ, ধমকানি, হয়রানি থাকবে না। এমন একটা জায়গায় চলে যেতে চাই।’
বড়ো বোন অনন্যা কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাশে বসা ছোট বোন তাসফিয়াকে বললো, ‘কিরে তোর কী মত?’
তাসফিয়া উৎফুল্ল হয়ে উঠলো, ‘ওয়াও। তাহলে তো ভালোই হয়। তিন বোন মিলে একসাথে লম্বা লম্বা পা ফেলে দূরে কোথাও পগারপার। কেউ আমাদেরকে আর খুঁজে পাবে না। বিষয়টা ভাবতেই বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে। একটা থ্রিলার, ও না না। রোমাঞ্চ। চলো আমরা তিন বোন মিলে কোথাও হারিয়ে যাই। একসাথেই থাকি। কী বলিস্ অনন্যা আপু?
বড়ো দু বোন অনন্যা রুবিনা ছোট বোন তাসফিয়ার দিকে হেসে তাকিয়ে বললো, ‘আসলে এটা কি ঠিক হবে? একা একা বাড়ি থেকে বিপদে পড়বো না তো? বাবা মায়ের কী হবে? তারা তো চিন্তায় চিন্তায় মারা যাবে?’
ধমকে উঠলো রুবিনা, ‘আরো রাখো তাদের কথা। তারা তো সারাদিনই বক বক করেই যাচ্ছে। এটা করো না, ওটা করো না। নামাজ পড়ো, ভালো হয়ে চলো। আচ্ছা, এই বয়সে এগুলো শুনতে মন চায়? এখন তো হচ্ছে মুক্ত পাখির মতো ডানা মেলে বাইরের জগৎটাকে দেখার সময়। বদ্ধ ঘরে আটকে থেকে বাবা-মায়ের বকবকানি শোনার সময় আছে?’
‘নামাজের কথা ওনারা তো ঠিকই বলছেন।’ উত্তর দিলো অনন্যা। ‘আল্লাহতায়ালা আদেশ তো আমাদেরকে মানতেই হবে সৃষ্টির সেরাজীব হিসেবে।’
‘হ্যাঁ যাই হোক, ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু তারচেয়ে আমরা তিনজন মিলে হারিয়ে যাবো। কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিবো এক অজানায়।’
তাসফিয়া বেশ উৎসাহের সাথে বললো, ‘আমরা আমাদের মতো চলবো। কারণ শাসন-বারণ মানবো না।’
হতাশ কণ্ঠে বললো অনন্যা, ‘আমরা আমাদের জীবনের কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি। এই সিদ্ধান্ত হয়তো ভালোও হতে পারে আবার বুমেরাংও তো হতে পারে। তখন আমরা কী করবো?’
‘এই পৃথিবী হায়, কেউ কারো নয়, মানুষের মৃত্যু ঘটে অনাদর আর অবহেলায়।’ উদাস কণ্ঠে আবৃত্তি করলো তাসফিয়া।
ওর কথা শুনে বাকি দু বোন হেসে উঠলো। তারপর রুবিনা বললো, ‘কথাটা মন্দ নয়। আসলেই তাই। এখানে আমরা আসলেই অসহায়। মানুষ শুধু ভালোবাসার অভাবে মরে, ক্ষিধের যন্ত্রণায়ও মরে, তবে বর্তমানকালে ক্ষিধের যন্ত্রণার চাইতে ভালোবাসার অভাববোধের কারণে অনেক ছাত্র-ছাত্রী, গৃহবধূও আত্মহত্যা করে, ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেয়। আমরা তার চেয়ে ভালোই সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। মরবো না, তবে জীবনকে ভিন্নভাবে উপভোগ করবো। দেখতে চাই, মরার চাইতে জীবনে বেঁচে থেকে কী ঘটে।’
‘হতে পারে আমরা হতাশ। হতে পারে আমরা আমাদের জীবনের বেড়াজালে আটকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তবে আসলেই আমাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে আসলে আমরা কী চাই।’
রুবিনার কথার উত্তর দিলো অনন্যা।
‘আসলে আমরা শান্তি চাই। পরিবার আমাদেরকে কিছুই দিতে পারেনি অথর্ব শাসন ও শোষণ ছাড়া। তারা চায় আমরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হই। কিন্তু তারা আমাদের মেধার প্রতি দৃষ্টিপাত করে না। আমরা কী পারবো, না পারবো না, সেটা তাদের লক্ষ্যবস্তু নয়। তাদের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে যেভাবেই পারো সবাইকে ডিঙ্গিয়ে সামনে এগিয়ে যাও। কিন্তু তাদের এটাই চিন্তায়ই আসে না যে, একটা মেয়ে এক মণ ভার বহন করতে পারে না, সে দশ মণ বয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে যাবে কীভাবে? আর না পারলে কটূক্তি ও লাঞ্ছনার ভার বহন করতে হয়। এটা কি ঠিক?’ রুবিনার দিকে চেয়ে চেয়ে হতাশ কণ্ঠে প্রশ্ন করলো তাসফিয়া।কিন্তু রুবিনা ও অনন্যা নির্বাক। মনে মনে তারা ভাবছে, আসলেই কথাগুলো সত্য। সন্তানের জন্যে বাবা-মা সবকিছুই করতে পারে, কিন্তু তাদের মানসিক যন্ত্রণা কোথায় তা কেউ কেউ অনুধাবন করতে পারে না! সন্তান এক প্রজন্মের আর বাবা মা আরেক প্রজন্মের। বাবা-মায়ের চাওয়া পাওয়া, চাহিদা, লক্ষ্যের সাথে নতুন প্রজন্মের সম্মিলন যখন হয় না, তখনই দু জনের পথ যায় বেঁকে, পথে অথবা মহাসাগরের পানে।
রাতে বাসায় ফিরে রুবিনা চুপচাপ জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে, “পিতার চোখের নিচের কালি কি কেবল নিদ্রাহীন রাতের চিহ্ন? নাকি হৃদয়ের নিঃশব্দ কান্না?”
অনন্যা মায়ের হাতে ধরা চায়ের কাপের কাঁপন দেখতে পায়। ভেবেও ওঠে না--এ কাঁপুনিটা বয়সের, নাকি দীর্ঘদিনের বোঝা বয়ে আনার ক্লান্তি?
এ সময় তাসপিয়া দু বোনের কাছে আসে, তারপর বলে, ‘পথ বেঁকে যায়, কখনো কাঁকরি রাস্তায়, কখনো গহীন সাগরের ধারে। সেখানে শুধু শব্দহীনতা, আর দু’টি হৃদয়ের অলিখিত বোঝাপড়া।’
তিন বোন একে অপরের দিকে তাকায়, তারা জানে যতো কিছুই হোক, তাদের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। এ সিদ্ধান্ত থেকে তারা ফিরবে না। তাসফিয়া ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত দশটা। কিন্তু একি? চারপাশে যেন সময়ও থমকে দাঁড়ায়।
ছাদে রাখা বাতিটা মৃদু ঝিমিয়ে জ্বলে, আর দেয়ালের ঘড়ির কাঁটা একেকটা টিক শব্দে যেন বলে দেয়--সময় শেষ।
(চলবে)