প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৫, ০৮:৪৫
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

॥ একত্রিশতম পর্ব ॥
বন্ধু পর্ব-১
অর্ধজীবনের পথ পরিক্রমায় নানারকম মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছে আমাকে। এদের কারও কারও
নৈকট্য পেয়ে কখনও ধন্য হয়েছি আমি স্বয়ং। আর কখনও বিড়ম্বনাতে পড়ে সঙ্গ এড়ানোর পথ খুঁজতে হয়েছে দ্রুত। নির্জন দুপুরে গ্রামের রাস্তায় শৈশবে ছেলেধরার কবলে আরেকটু হলেই পড়ে গিয়েছিলাম। শেষ মুহূর্তে বুঝতে পেরে ভোঁ দৌড় মেরে উল্টোপথে বাড়ি চলে আসি। গ্রামে অর্ধশৈশব কাটানো ছেলে শহরে এসে নানা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে নাশতা কিনে আনার দায়িত্ব পেয়ে বেশ বড়ো হওয়া ভাব নিয়ে ভোলা বাবুর দোকানে যেতাম পুরি বা লুচি আনতে। একদিন আমার চেয়ে বয়সে বছর দুয়েকের বড়ো এক শহুরে ধূর্তের খপ্পরে পড়ি। আমার হাতে কতো টাকা আছে তা জানতে চেয়ে সে টাকাগুলো হাতিয়ে নেয়। তখন বুঝতে পারি, শহর হলো প্রতারকের রাজধানী। শহরে এসে প্রথম যে স্কুলে ভর্তি হই সেখানে স্বপন ছিলো আমার একমাত্র বন্ধু। আমার মতোই সহজ সরল শৈশব তার। ঐ স্কুল ছেড়ে এলে স্বপনের সাথে আমার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। তবে বড়ো হলে জানতে পেরেছি, স্বপনেরা সপরিবারে এখন পশ্চিমবঙ্গে ঠিকানা গেঁড়েছে। ধীরে ধীরে বন্ধুর সংখ্যা বাড়তে থাকে সেন্ট প্ল্যাসিডস্ স্কুলে এসে। খুব দুষ্ট একজন বন্ধু ছিলো বনফুল। তাদের দোকান ছিলো জেল রোডে, সিন্ধু এন্ড সন্স নামে। নানারকম বাদ্যযন্ত্রের দোকান। তার বাবা দুলাল বাবু আমার বাসায় এসে ক্লাসের খাতাপত্র নিয়ে যেতো। যাতে বনফুল ক্লাসে পিছিয়ে না থাকে। কিন্তু বনফুল ছিলো ফটিক টাইপের দুষ্টের হাঁড়ি। একদিন তাকে আমাদের হেড মিস্ট্রেস আবিষ্কার করেন, প্যান্টের বেল্ট খুলে রাস্তার ছেলেদের সাথে মারামারি করছে। পরদিন ক্লাসে এসে বনফুল হয়ে যায় খলনায়ক, আমাদের হেড মিস্ট্রেসের বদৌলতে। বনফুলের পায়ে গতি ছিলো খুব।
আমার আরেক বন্ধু ছিলো মালেক। বাঙালি কিন্তু মাথার চুল ম্যান্ডেলার নাতির মতো কোঁকড়ানো। তার ডজ দেওয়ার ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ। হুজাইফা মান্ডিওয়ালা ছিলো ক্লাসে সবচেয়ে সুন্দর ছেলেটা। তাই তার কদর ছিলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অতিথিকে ফুল দিয়ে বরণকালে। বড়ো হওয়ার পরে মান্ডিওয়ালার মাথার চুল সব পড়ে যায়। সৌমেন পাটোয়ারী ছিলো অতিশয় সুবোধ। তার ভাই দ্বিপেনকে সহ তার বাবা স্কুলে দিয়ে যেতো। দেবাশিস ভট্টাচার্য ছিলো আরেক ছুপা রুস্তম। তার বাবা ছিলেন কলেজের শিক্ষক। দেবাশিসের হাতের লেখা ছিলো চমৎকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে দেবাশিস শেষমেষ বামপন্থী রাজনীতির খাতায় নাম লেখায়। মিহিরের কথা তো আগেই বলেছি। তার দেহের তুলনায় চোখগুলো বড়ো বড়ো। তার বড়োভাইও আমাদের স্কুলে দু ক্লাস ওপরে পড়তেন। মিহিরের মা সালঙ্কারা থাকতে পছন্দ করতেন। সৌরিন আর শান্তনুর কথা বলা বাহুল্য। তারা আমার নিবিড় বন্ধু ছিলো কলেজে পড়াকালীনও। পরে তৃতীয়স্তরের পড়াশোনা করতে গিয়ে তারা আলাদা হয়ে দেশ ছেড়ে যায় সাময়িকভাবে। সৌরিন কিছুটা অস্থির মতিসম্পন্ন। তুলনায় শান্তনু হিসেবি ও ধীরস্থির। মনের মধ্যে সুবিধা-অসুবিধার গণিত না মিলিয়ে সে কিছু করতো না। দুজনের হাতের লেখা ছিলো অসাধারণ। সৌরিন কখন কী করতে চায় তা আঁচ করা কঠিন। তবে তার মাঝে স্বার্থ সংরক্ষণের প্রবণতা পরে পরে দৃশ্যমান হয়ে উঠে। বন্ধু অলক ছিলো আগাগোড়া একই। ভেতরে যা বাইরেও তা। সে সাহসীও ছিল কিছুটা। তার বুকে একটা কালো তিল ছিলো। তাকে দেখেই আমার এ ধারণা পাকা হয়েছিলো, বুকে তিল থাকলে সাহসী হয়। আশরাফ ভালো ফুটবল খেলতো। মুখের কথায় হাল্কা জড়তা ছিলো। এক ক্লাস আগে থাকা হাসান মুরাদ আমাদের সাথে এসে পরে আবার পিছিয়ে যায়। রাজনীতি করে সে কমিশনার হয়ে বেশ পরিচিতি পায়। ইমরানের ডাক নাম ছিলো গুড্ডু। খুব দ্রুত কথা বলতো। সে আর লুৎফুল কবীর ছিলো মানিকজোড়। লুৎফুল এমনভাবে লিখতো যেন তাকে আর বেশি কাগজ কখনো দেওয়া হবে না। এরশাদ, খায়রুল্লাহ, নূরুল্লাহ্ এরা ছিলো জ্যাঠা ছেলে। এরশাদের জোড়া ভুরু আর মায়াময় জোড়া চোখ ছিলো। পৃথ্বীজিৎ ছিলো আমাদের ভালো এক বন্ধু। স্কুলে নানা কমিকসের বই আনতো। আমরা পড়ে পড়ে তার দায়িত্ব কমিয়ে দিতাম। আমার ক্লাসে তিনজন বিশ্বজিৎ ছিলো। একজন ছিলো বিশ্বজিৎ পাল। তার মুখ ছিলো গোলগাল। ফুলকো লুচির মতো ফোলা। আরেক বিশ্বজিৎ ছিলে দেব। গানের গলা ছিলো। এখন মনে হয় কারাওকে দিয়ে গান করে। চিকন বিশ্বজিৎ মিচকা শয়তান। দুনিয়ার খারাপ কথা তার পেটে। তার কথায় হাসির খোরাক প্রচুর। ছৈয়দুল্লাহ ছিলো আরেকজন। মাঝে মাঝে খাস চাটগেঁয়ে ভাষায় কথা বলতো। মোহাম্মদ হোসেন ছিলো সহজ ও বন্ধুসুলভ।
নাসিমউদ্দীন মজুমদার ছিলো আমার খুব প্রিয় সহপাঠী। মাঝে মাঝে তার সাথে কথার দুষ্টুমি করতাম বেশ। টেনিসবল সংক্রান্ত দুষ্টুমি নিয়ে সে আমার হৃদয়ে অম্লান। ছোটখাটো নূরুল আহাদের কথা ভোলার নয়। তাকে দেখে মনে হতো, সে বুঝি সেই ছেলে, যাকে মায়েরা পুতুলের মতো করে সাজিয়ে রাখে। নেইল পিনেরো ছিলো ভিন্নমাত্রিক দুষ্ট ছেলে। কখন কার সাথে সে দুষ্টুমি করলো তা কেউ টের পেতো না। এম এম সাদেক ও তার ভাই দুজনেই একসাথে পড়তো আমাদের সাথে। মহিউদ্দিন সাদেক পিটি ক্লাসে মার্চপাস্ট কিংবা ড্রিল করতে পারতো না। কার্টুনের মতো সে হেঁটে যেতো। বশির ছিলো ছোটখাটো গড়নের। সুনয়ন ছিলো সাদামাটা। অমিত ছিলো লম্বু। হলরুমে সে স্কি করার মতো ছ্যাঁচড়া খেতো জুতোর তলা দিয়ে। গোলাপি ঠোঁট দুটোয় মনে হতো সে পানসেবি ছিলো। পরে অবশ্য মাঝে মাঝেই তাকে পান চিবুতে দেখেছি। মঞ্জুর টিটি খেলা শিখে নিয়েছিলো আমি আর হাশেমের সাথে খেলতে খেলতে। শংকরকে পেয়েছিলাম প্রাইমারি পর্যন্ত। সে ছিলো হরিজন। মাঝে মাঝে দেখতাম, দোকানে-ক্যান্টিনে উপেক্ষিত হতে। শিব শঙ্কর সিকদার ছিলো আরেক দুষ্টের শিরোমণি। তবে ক্লাসের মধ্যে। এর বাইরে নয়। দুজন ইয়াসিন ছিলো। একজন মোহাম্মদ ইয়াসিন। খুব ভালো ছেলে। বিহারি। রাশান মেয়েদের মতো টকটকে ফর্সা। আরেকজন ইয়াসিন চেল ছিলো খুব চাল্লু। সেও বিহারি। তবে তার কথা খুব টনটনে ছিলো। নীল রাসেল সোহার ছিলো একজন। ছোটখাটো। দেখে মনে হতো, যেন মুখে খাবার নিয়ে বসে আছে। আমাদের ইউজিন স্যারের কোনোরকম আত্মীয় ছিলো। আরেক সহপাঠী ছিলো অশোক। মুখে তার কালো মাশ ছিলো। তার বাবা নীতিন মেসোর ক্যাসেটের দোকান ছিলো নিউমার্কেটের চারতলায়। অশোকের বড়ো ভাই জুয়েলও আমাদের স্কুলে দুই ক্লাস ওপরে পড়তো। সহপাঠী বিপুল ছিলো কড়াকণ্ঠী ছেলে। গলার পিচ্ খুব তীক্ষ্ণ। টিকলু ছিলো বন্ধু বৎসল। পরে তাকে কলেজিয়েট স্কুলে গিয়ে পাই। পণ্ডিত স্যার তাকে টিকোলু নামে ডাকতেন। ফর্সা ডমিনিক সালগাদো ছিলো নায়কের ছোটবেলার চরিত্রের মতো সুন্দর। বিহারী আমির ফখরীকে আমরা ডাকতাম আমীর ফকির নামে। তাদের জুবিলী রোডে হার্ডওয়ারের দোকান ছিলো। ফ্রান্সিস খুব একটা ডাকাবুকো ছিলো না, কিন্তু নিরীহও ছিলো না। বয়সের সাথে তার জীবনাচরণ তাল মেলানো ছিলো। বন্ধু আতিফ-উল হক ছিলো একটু অন্য রকম। তার বচনে-চলনে মাধুর্য ছিলো। ছোটবেলা হতেই অ্যালোপেশিয়ার অজানা কারণে মাথার চুলগুলো স্থানে স্থানে নাই হয়ে গিয়েছিলো। বুয়েট হতে পাস করা ইঞ্জিনিয়ার আতিফ এখন আমেরিকায়, ট্রাম্পের প্রজা। এনামুল হক আমার সাথে সিক্স পর্যন্ত পড়ে ক্যাডেট কলেজে চলে যায়। মুখের কথায় হাল্কা একটু আটকাতো তার। রুবাইয়াতের বাসা ছিলো দামপাড়া। তারা দুভাই আমাদের স্কুলে পড়তো। রুবাইয়াত ছিলো আমাদের সাথে। গাব্দাগোব্দা। পাথরঘাটার চিরঞ্জীব, যাকে সবাই সাদা বিজু নামে চিনতাম, সেও আমাদের সতীর্থ ছিলো একই সেকশনে। ওদের জায়গায় আমরা একসময় কোর্ট বানিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলেছি। আমি যদিও ব্যাডমিন্টন ভালো খেলতে পারি না। নাজাত বাবর শুরু থেকে না থাকলেও মনে হয় দুয়েক ক্লাস পরে যোগ দিয়েছিলো। ভদ্র ছেলেদের একজন ছিলো বাবর। ফসিউদ্দৌলাও হাস্যোজ্জ্বল মুখে বন্ধুপ্রতিম ছিলো। আরেক দুষ্টমতি ছিলো অভীক সরকার। সে ভারতের মুম্বাইতে শুনেছি ছবি নির্মাতা হয়েছে। তার সাথে চলাফেরা ছিলো লিপন সাহার। অভীক খাটো ছিলো, কিন্তু লিপন ছিলো লম্বা। স্কুলের পাশেই থাকতো আজিজুল গণি চৌধুরী। তার ডাক নাম বিপুল। সে এখন ব্যাংকার এবং রোটারিয়ান। তাদের পাশেই থাকতো নিউটন ও মিল্টন দুভাই। তারা আচার্যী ছিলো। দুজনেই আমার সতীর্থ ছিলো। অসীম কুমার বণিক ছিলো আরেকজন সুবোধ বালক। তবে সুধন সম্পদ বণিককে যত সুবোধ দেখাতো, সে আসলে তত সুবোধ ছিলো না। সেও বুয়েটিয়ান হয়ে অবশেষে আমেরিকান। নূরু নামে ডাকলেও তার পুরো নাম ছিলো নূরুদ্দিন জাবেদ। তার বাসা স্কুলের পেছনে হওয়ায় তাদের গৃহসহযোগী ব্যাগ মাথায় নিয়ে নূরুকে পৌঁছে দিতো স্কুলে। নূরু এখন চট্টগ্রাম ক্লাবের চ্যাম্পিয়ন বিলিয়ার্ড খেলোয়াড়। রায়হান আমার ক্লাসে ছিলো। বাকপটু। সে এখন বিলেত কাঁপানো ব্যারিস্টার। বন্ধু আবেদ ইব্রাহিমের গলার স্বর ছিলো ঘুঘুর ডাকের মতো। সুদূর হতে তার কথাগুলো কানে আসতো বলে মনে হতো। বনফুল কী কারণে তাকে সিমেন্টের মানুষ নামে ডাকতো তা আজ মনে নেই। সে এখন মেরিনার। ভালো বাস্কেটবল খেলতো আবেদ। মোঃ জাভেদ আরেকজন বিহারী ছাত্র ছিলো। তার মুখে বাংলা আমাদের মতো আসতো না। কোনো বিহারী আমার ক্লাসে শ্যামবর্ণ ছিলো না। কিন্তু জাভেদ কী কারণে অসিত বরণ হলো তা বোধগম্য ছিলো না। শেষের দিকে সঞ্চয় দাশ এসেছিলো জাভেদের বিপরীত গাত্রবর্ণে। তার মুখের ভাষাও ছিলো প্রমিত বাংলা। আরেকজন ছিলো রিংকু ভৌমিক। মায়াময় চেহারা। স্টিলের স্যুটকেস-ব্যাগে বই আনতো, বিশ্বজিৎ পালের মতো। আমাদের দুজন আব্দুল্লাহ্ আল মামুন ছিলো। একজন লম্বা আর একজন একটু ছোটখাটো। ছোটজনের মুখের হাসি মিষ্টি ছিলো। তার মুখের আদলের মতো দেখতে আজকাল একজন অভিনেত্রী ইউটিউব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। লম্বা আব্দুল্লাহ আল মামুন কথা দ্রুত বলতো। একটা অস্থানিক বাকশৈলী ছিলো তার। গুলুমুলু ইমরোজ জাহেদ ফারুকীর জোড়া ভুরু ও মা-বরণ মুখ ছিলো মায়াময়। সে এখন বৃটিশের অন্ন ধ্বংস করছে বসে বসে।
কলেজিয়েট স্কুলের বন্ধুগুলো তুলনামূলক শয়তান ছিলো বেশি। তাদেরকে দুষ্ট বললে পোষায় না। তাদের শয়তানি উৎপাদনের ক্ষমতা অসাধারণ। আরও অসাধারণ হলো নামকরণের প্রক্রিয়া। শান-এ-খুদা ছিলো তার বাবার মতো খাটো উচ্চতার। তার বাবা কলেজে আমাদের স্যার ছিলেন। বাংলা পড়াতেন। তিনি বলেছিলেন ক্লাসে, ‘নিরেট সত্য দিয়ে সাহিত্য হয় না, হয় ইতিহাস।’ কথাটা খুবই মূল্যবান। শান-এ-খুদার হাতের লেখা ছিলো অদ্ভুত। মনে হতো পাটা খোদাইয়ের শিল্পী কর্তৃক হাতুড়ি-বাটাল ছেনে ছেনে লেখা। আরাফাত ছিলো তুলনামূলক সপ্রতিভ। সামনের দিকের চুলগুলো কোঁকড়ানো। প্রথমদিকে একবছর ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের ফার্মেসিতে পড়ে সে আবার মেডিকেলে আমার একবছর পরের সেশনে ভর্তি হয়। শিব্বির ছেলেটা সিধেসাদা হলেও কী কারণে পরে আত্মবিসর্জন দেয় বলতে পারি না। তখন অবশ্য আমরা কলেজ ছাড়িয়ে তৃতীয়স্তরের শিক্ষায় ঢুকে পড়েছি। আমাদের নূরুল হুদাকে সবাই নূরানী নামে ডাকতো। সে ভালো ফুটবল খেলতো। পাপ্পু আর মৃদুল ছিলো চাচাতো-জেঠাতো ভাই। পাপ্পু ছিলো মাহমুদুল হাসান আর মৃদুল ছিলো মাজহারুল হক। পাপ্পু বুয়েটিয়ান আর মৃদুল এখন ব্যাংকার হয়ে ট্রাম্পের টাকা সামলায়। ডাব্বু ডাক নাম হলেও আসল নাম ছিলো মোহাম্মদ মোস্তফা। সে মাঝে মাঝে বলতো, তার বাবা জোর করে সবাইকে সকালে খাওয়ার টেবিলে চিরতার পানি খাওয়াতো। ডাব্বু এখন নিউজিল্যান্ডে। কী জানি, এখন সে নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞাপনে দেখা গরুর দুধে চা খায় কি না। তানভীর জহির বেশ বুদ্ধিদীপ্ত করিৎকর্মা। বুয়েটিয়ান এবং এমবিএ করে এখন অ্যালিকো সামলায়। সাজ্জাদকে বজ্জাত ডাকাটা স্বাভাবিক ছিলো আমাদের জন্যে। কিন্তু সে অতটা বজ্জাত ছিলো না। শুধু অনুপ্রাস আর অন্ত্যমিলের খাতিরে সে বজ্জাত হয়েছিলো আমাদের কাছে। সে-ও বুয়েটিয়ান। আবু নাসেরও মনে হয় ডাব্বুর মতো নিউজিল্যান্ডের গরুর দুধে চা খায় ছবির চেয়ে সুন্দর সবুজের দেশে। বেলাল ফুটবল টিমে ডিফেন্সে খেলে বলে না মেরে কতজনের পায়ে মেরেছিলো তার হদিস নেই। আমাদের এক মামুন ছিলো এ সেকশনে আমার সাথে। শয়তানের লাঠি যাকে বলে। জিয়াউল হায়দার দেখতে ছোটখাটো ছিলো, কিন্তু ধাইন্যা মরিচ। ফরহাদকে আহমদ হোসেন স্যার কেন যে ঝনঝইন্যা পোলা ডাকতো তা মালুম হতো না। ক্যায়াও নিয়ান ওহন ছিলো আমাদের সাথে, পরিচ্ছন্ন, পরিমিত। রুমি পেস বল করতো ভালোই। তবে কথা জড়িয়ে বলতো। সালাউদ্দিনের ডাক নাম মিজান। পরে কলেজে উঠলে সবাই তাকে নাম দিয়েছিলো ইলিয়াস কাঞ্চন। ক্রিকেটটা সে ভালো খেলতো। গোলাম মোস্তফা ও করিম দুভাই একসাথে পড়তো আমার ক্লাসে। গোলাম হৃষ্টপুষ্ট হলেও করিম ছিলো ক্ষীণকায়া। এইটে আমার রোল নাম্বারের পরে ছিলো আবুল হাসানের রোল নম্বর। তখন তাকে আমি ডাকতাম আবুল হাসান বনিসদর বলে। এ নামে ঐসময় ইরানের একজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ব্রণের আদরে আবুল হাসানের মুখমণ্ডল গোলগাল ছিলো বেশ। বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষক অরবিন্দ স্যারের ছেলে ক্লাস এইটে পড়েছিলো এক বছর। সুমেধ তাপস নাম। নাইনে উঠে চলে যায়। সোহেল মাহমুদ জাহিদুজ্জামান মিষ্টি হাসির বালক ছিলো। গালে টোল পড়তো হয়তো। এখন ব্যাংকে বসে অর্থনীতির বারোটাই বাজাচ্ছে নিশ্চয়ই। শফিকুল ইসলাম নাইনে এসেছিলো। ভালো ছেলে, চিকিৎসক হয়েছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে। তার বাসা ছিলো মনে হয় পাথরঘাটায়। এসএসসির রেজাল্ট দেওয়ার দুদিন আগে তার বাসায় আমাদের উদ্বেগ-সভা হয়। সুমন কুমার দাশ আমার প্রিয় ছিলো। তার বাবার নাম ছিলো অজিত কুমার দাশ। সংক্ষেপে তাকে ডাকতাম অকু দাশের ছেলে সুকু দাশ। সেও প্রকৌশলবিদ্যা রপ্ত করে ব্যাংকার এখন। আমি বুঝি, এদের কারণেই আসলে ব্যাংকগুলো শয়তান হয়ে গেছে। কায়সার ইমতিয়াজ ছিলো অবাঙালি। আটকে পড়া পাকিস্তানি মনে হয়। ইউএসটিসি হতে পাস করে সে ডাক্তার হয়েছে। এখন কবিও বটে। তাদের দোকানের নাম ছিলো ইকবাল সুইটস্। দেওয়ান বাজার দিদার মার্কেট এলাকায়। আমাদের কবিবন্ধু গোফরান তার বইয়ের প্রকাশক। গোফরান স্কুলজীবন থেকেই ‘কচিহাত’ নামে ছড়ার ছোটকাগজ ছাপাতো। গোফরান এখন বাংলা পড়ায় এমইএস কলেজে। আজকের আবৃত্তি শিল্পী রাজিউর রহমান ছিলো আমার সাথে ‘এ’ সেকশনে। তার ডাকনাম বিতান। সুন্দর নাম, সুন্দর চেহারাও। নাসিম ধীর স্থির। তবে ঝাঁঝালো মন্তব্যে সে পিছিয়ে থাকতো না। আমার ক্লাসে সব সময় টর্নেডো আসতো। মানে তার নাম ছিলো আশরাফুল। তার দশাসই দেহের জন্যে নাম দেওয়া হয়েছিলো টর্নেডো। তুহিন চন্দ্র ভৌমিক ছিলো একজন। খাটো কিন্তু কড়কড়ে গলার স্বর৷ পিকেসেন সাততলা বাসা ছিলো। পিকেসেন মাঠে ফুটবল খেলতে গেলে তার সাথে আমার দেখা হতো। আখতার, সাইফুদ্দিন এরাও ছিলো বেশ। সাইফুদ্দিন সোনালী ব্যাংক সামলায়। আখতার কী সামলায় জানি না। আরও কিছু কিছু মুখ এখন মনে নেই। হয়তো কিছুক্ষণ পরে আবার মনে পড়বে। যেমন আল মনসুর। চিকনা। সাইতামা হয়ে অস্ট্রেলিয়া কি আমেরিকায় আছে। আল মনসুরের হাতের লেখাও বেশ দেখতে ছিলো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ তাকে ধন্য করেছে। অথবা সেও পদার্থবিজ্ঞানকে ধন্য করেছে বলা যায়। মুনিরের ডাক নাম ছিলো আলভী। একটু স্বাস্থ্যবান। তাকে দেখতাম যতসব আঠারোর্ধ্ব বিষয় নিয়ে ট্রান্সলেশন তৈরি করতে। যেমন : মেয়েটা ধর্ষিতা হওয়ার পরও কোনো আলামত পাওয়া যায়নি, এ ধরনের। মুনিরও বুয়েটিয়ান। তবে ঠিক কার আমলে সে মার্কিনে যায় তা বলতে পারি না। তাকে কি বুশ টেনেছে নাকি ওবামা টেনেছে জানি না। ( চলবে)