প্রকাশ : ১৯ মে ২০২৫, ০৮:৪৬
আগুনের নদী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ষোলো.
অনন্যাকে তার স্বামী হাসান বাবুর কাছে রেখে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ইরফান বললো, ‘মোনালিসা তোমার জন্যে চমক অপেক্ষা করছে। চলো সেগুনবাগিচা।’
‘বুঝলাম না।’
‘চলো, সেখানে গেলেই বুঝতে পারবে।’
সেগুনবাগিচার অফিসে বসে আছে তুষার। পেছন থেকে প্রথমে বুঝতে পারেনি মোনালিসা। যেইমাত্র সামনে এসে তার পাশে বসলো, তুষারকে দেখেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো।
তুষারকে এভাবে জীবিত দেখতে পাবে তা কখনোই ভাবেনি মোনালিসা। প্রথমে সে ভেবেছিলো, এটা কোনো স্বপ্ন বা যাদুর খেলা। কিন্তু তুষার যখন তার হাত ধরলো এবং বললো, ‘আমি বেঁচে আছি মোনালিসা’ তখন তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলো সে। তারপর প্রশ্ন করলো, ‘তুষার তুমি মরে যাওনি? তাহলে ওরা কার লাশ উদ্ধার করলো?’
‘বলছি, শোনো। সেদিন আমাকে যখন ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো, তখন ছিলো প্রচণ্ড অন্ধকার। আমাকে নদীর পাশে যখন নিয়ে হত্যা করতে উদ্ধত হয় আমি তখন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুবে যাই। কিন্তু সেই স্থানে অজ্ঞাত এক লোক মলত্যাগ করছিলো রাতের আঁধারে। সম্ভবত ইয়াবাখোর হতে পারে। তোমার বাবার লোকেরা ওই লোককেই খুন করে দ্রুত সব করে ফেলে অন্ধকারে। তারা ওই লোকটির মাথা ও গায়ের চামড়া তুলে ফেলে। এরপর তাকে কেটে কেটে স্যুটকেসে ভরে এবং মাথাটা নদীতে ফেলে দেয়। আমি ডুব সাঁতার দিয়ে বহু কষ্টে অপর পাড়ে উঠি। তারপর পরদিন পত্রিকায় দেখতে পাই আমার মৃত্যুর খবর। আমি ভাবলাম, ওরা তো আমাকে জীবিত হাতে পেলে আবারও খুন করবে। তাই আমি সোজা ব্যাগ মোবাইল সবকিছু সেই নদীতেই ফেলে রেখে আত্মগোপন করি। কিন্তু ওরা যে তোমাকে জোর করে ধরে কানাডা পাঠিয়ে দিবো, এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি, তাহলে আমি তোমাকে আসতে দিতাম না।’
‘না তুমি ঠিকই করেছো। তুমি তখন আমাকে ফেরাতে গেলে তারা তোমার অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতো। উনি আমার পিতা হলেও একটা কসাই, কসাইর ঘরে জন্ম নিয়েছি আমি। তুমি কি জানো আমার বাবা ও স্বামী দুজনই টাকার বিনিময়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন জামশেদের কাছে আমাকে বিক্রয় করে দিয়েছিলো?’
‘না, জানি না। তোমার মুখে বিষয়টা শুনে মনে হচ্ছে, কিছু কিছু বাবা আসলেই বাবা নন। বাবা হচ্ছে একটা বটবৃক্ষের মতো, সন্তানকে ছায়া দিয়ে আগলে রাখেন। কিন্তু তোমার বাবা ইলিয়াছ মণ্ডল সেটা হতে পারেননি। তিনি ও তার বাহিনী যেভাবে লোকটাকে আমি ভেবে গায়ের চামড়া ছিলে খণ্ড খণ্ড করে কেটে কেটে গুম করতে চেয়েছে, তাতে একটা কসাইকেও হার মানাবে। ওহ, সেই কথাগুলো আমি আর ভাবতেই পারছি না।’
‘আর ভাবার দরকার নেই। তাদের শাস্তি হয়েছে। ইরফান সাহেব তাদেরকে আমার সামনেই গুলি করে মেরেছে। কুকুরের মতো গুলি খেয়ে তারা যন্ত্রণা ভোগ করে মরেছে। যেমন পাপ তেমন শাস্তি।’
ইরফান ও অধরা পাশে বসে বসে কথাগুলো শুনছিলো। ইরফান বললো, ‘তুমি বুদ্ধিমানের কাজ করেছো তুষার। ওরা তোমাকে পেলে আসলেই ছেড়ে দিতো না। তবে এখন আমাদের কাজ হচ্ছে তোমার পরিবর্তে তারা কাকে খুন করেছে, তার পরিচয় উদ্ঘাটন করা।’
অধরা ইরফানের কথায় সায় দিলো। তারপর ইরফানকে বললো, ‘এখন তো সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। আর কোনো জামশেদের জন্ম হবে না।’
‘জামশেদরা কখনোই মরে না। আলোর পাশাপাশি অন্ধকার থাকবেই। যুগে যুগে নতুন নতুন জামশেদের জন্ম হবে। তারপর তারাও নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যে মানুষকে খুন করার এমন প্রচেষ্টা করবেই। আর আমার মতো অফিসাররাও তাদের প্রতিহত করার জন্যে যুগে যুগে জন্ম নিবে। শয়তান কিয়ামতের আগে কখনো মরবেই না। আর শয়তানদের কার্যকলাপ থামানোর জন্যে কিছু কিছু মানুষের অবিচল প্রচেষ্টা থাকবেই।’
‘তা ঠিক। তাহলে এবার আমি আমার আসল ঠিকানায় যেতে পারি আগামীকালের ফ্লাইটে?’
‘তোমার আসল ঠিকানা কোথায়?’ জানতে চাইলো ইরফান।
‘জানি না, তবে যে আগুনের নদীর পাশে আমাদের পরিচয় হয়েছিলো হয়তো সেখানেই অথবা হয়তো তোমার বুকের স্পন্দনেই আমার আসল ঠিকানা হতে পারে।’ ঈষৎ হেসে জবাব দিলো অধরা।
ইরফান অধরার কথায় নিজেও হেসে দিলো। তারপর তার চেয়ার থেকে উঠে অধরার হাতটি ধরলো। বললো, ‘চলো তুষার, মোনালিসা আমি আর তুমি--চারজন মিলে আমাদের খুশি ও সাফল্যের সেলিব্রেট করি। আজকের দিনটা আমাদের জন্যে নতুন সূর্যোদয়, আমরা এই দিনটাকে স্মরণ করার জন্যে কুয়াকাটা সী-বীচ থেকে ঘুরে আসি।
অধরা হাততালি দিলো, সেই সাথে মোনালিসাও অংশগ্রহণ করলো। জীবনের এই জয়যাত্রার খুশিতে সবাই বলে উঠলো, ‘জয় হোক এএসপি ইরফানের’।
ঠিক এ সময়েই ইরফানের মুঠোফোনে একটা কল এলো। ইরফান রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে ডিআইজি আজহারুল ইসলামের কণ্ঠ শোনা গেলো, ‘তোমার জন্যে খুশির খবর আছে ইরফান।’
‘জ্বি স্যার বলুন।’
‘আদালতের নির্দেশে নজির আহমেদের স্থাবর অবস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি ক্রোক করা হয়েছে। তবে তিনি ব্যাংক থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকা নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেছেন। এখন তোমার প্রতি নির্দেশ হচ্ছে, তুমি আগামীকালই সিঙ্গাপুর চলে যাবে এবং তাকে খুঁজে বের করবে। কি পারবে তো?’
‘ইয়েস স্যার।’
ডিআইজি আজহারুল ইসলামের সাথে কথা শেষ হতেই অধরা প্রশ্ন করলো, ‘কী হয়েছে?’
‘আবার নতুন মিশন। এবার সিঙ্গাপুর।’
উল্লাসে ফেটে পড়লো অধরা। তারপর বললো, ‘দারুণ হয়েছে। আমিও তোমার সাথে দেশের কাজে নিজকে নিয়োজিত করতে পারবো তো?’
ইরফান অধরার উল্লাস দেখে নিজেও খুশি হলো। সে ভাবছে, এই মেয়েটার ডর-ভয় বলতে কিছুই নেই। সে চিকিৎসক না হয়ে মহিলা গোয়েন্দা হলে ভালো হতো।
‘উত্তর দাও।’ অধরা অধীর আগ্রহে ইরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
‘আমার দায়িত্বের সাথে তোমার জীবনটা জড়িয়ে কেনো নিজকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছো অধরা?’
‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়’-- একটা প্রবাদ আছে না? নারীরা এখন আর ভীতু নয়, তারা বাঁচতে শিখেছে, বিপদের সাথে লড়তে শিখেছে, লড়ে লড়ে জীবনযুদ্ধে জয়ী হতে শিখেছে। ঘরের কোণে বসে থাকলেও মরবো, কিন্তু দেশের জন্যে কাজ করে মরতে পারলে সেটাই তো জীবনের আসল অর্থ বয়ে আনবে। তাই না?’
অধরার কথায় ইরফান নতুন এক শক্তি পেলো। তারপর অধরার হাত ধরে তাকে বসা থেকে উঠিয়ে বললো, ‘কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাহলে ঠিকই বলেছেন : কোন কালে একা হয়নি ক’ জয়ী পুরুষের তরবারি, প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।’
পরদিনই অধরাকে সঙ্গে করে ইরফান বাংলাদেশ বিমানে উঠলো। তারপর প্রথমে আইসল্যান্ডের সেই আগ্নেয়গিরির পাশে বসে আগুনের নদীর দৃশ্য উপভোগ করলো। এ সময় অধরা ইরফানের হাত ধরে বললো, ‘এই যে আগুনের নদীটা দেখছো, এটা আসলে একটা প্রতীকী নদী। হাজার মানুষের মনে এমন দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার আগুন বয়ে যায়, কেউ কেউ পরিত্রাণ পায় আর কেউবা ডুবে যায় সেই আগুনের নদীতে।’
‘মানুষের জীবনটা আসলেই একটা পরীক্ষাক্ষেত্র। আল্লাহতায়ালা মানুষকে বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। এজন্যেই বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে। এটা অনেক মানুষই জানে না। তাই তারা পরীক্ষা পাস করতে পারে না। আমি কষ্ট করে অন্যের চাইতে বেশি কাজ করি কেনো জানো? অন্যের চেয়ে বেশি মার্কস পাবার জন্যে। আমার সেই বেশি মার্কসই আমাকে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্যে আমাকে অন্যের চেয়ে বেশি এগিয়ে নিয়ে জীবনের পথ সহজ করে দেবে।’
‘ঠিক তাই। তুমি বেশি মার্কস পেয়েছো বলেই আজ আমি তোমার জীবনসঙ্গী হতে পেরেছি।’ হাসলো অধরা।
‘জীবনসঙ্গী মানে?’
অধরার হাসি আরো উথলে উঠলো। তারপর বললো, ‘সরি, জীবনসঙ্গী নয়, কাজের সঙ্গী।’
‘ওহ, তাই বলো। আমি তো ভাবছি ..।’
‘কি?’
‘বলবো না। সেটা সময় হলেই দেখা যাবে। উঠো, আমাদেরকে আগামীকালের ফ্লাইটেই সিঙ্গাপুর রওয়ানা করতে হবে।’
‘হ্যাঁ, একজন কর্তব্যপরায়ণ অফিসারের জন্যে এটাই তো অভীষ্ট লক্ষ্য।’
এ কথা বলে এবার অধরাই ইরফানের হাত ধরলো, তারপর দুজনে পরবর্তী মিশনের জন্যে এগিয়ে যেতে থাকলো।
(সমাপ্ত)