প্রকাশ : ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:৫৩
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন

॥ সাতাশতম পর্ব ॥
বিশ্বজুড়ে করোনা আঘাত হানার পূর্বে চাঁদপুরের জনজীবনে সংস্কৃতিকে লালনের মাধ্যমে প্রজন্ম বিনির্মাণের চর্চা বেশ ভালোভাবেই চলমান ছিলো। এর অন্যতম অনুষঙ্গ ছিলো বিতর্ক চর্চা ও প্রশিক্ষণ। চাঁদপুরে বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতা চলমান থাকায় প্রতিযোগীদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে একসময় একটা বিতর্ক একাডেমির অভাব বোধ হতে থাকে। এ কারণে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সময়ে তাদের মেন্টরের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কিন্তু মেন্টরের ভূমিকা নিঃস্বার্থভাবে পালনের মতো যোগ্য বিতার্কিক ব্যক্তিত্বের ঘাটতি থাকায় এক সময় একটা বিতর্ক একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা সময়ের দাবি হয়ে পড়ে। এ দাবিটি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক জনাব কাজী শাহাদাত এবং সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট ইকবাল- বিন-বাশার। আমি নিজেও একটি বিতর্ক একাডেমির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি বার বার। পালবাজার সংলগ্ন বকুলতলা রোডস্থ রেলওয়ে কিন্ডারগার্টেনকে অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে চিন্তা করে চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি যাত্রা শুরু করে। অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার ও অধ্যাপক বিলকিস আজিজকে উপদেষ্টা এবং জনাব কাজী শাহাদাতকে সভাপতি করে যাত্রা শুরু হয় চাঁদপুরের প্রথম বিতর্ক একাডেমির। এটাই এতদ্ অঞ্চলে প্রথম প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিতর্ক শিক্ষাকেন্দ্র হওয়ার গৌরবের অধিকারী হয়। আমার সৌভাগ্য, আমি ছিলাম এ বিতর্ক একাডেমির প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ, যা এখনও বহাল আছে। আরেক তুখোড় চ্যাম্পিয়ান বিতার্কিক, অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় যাকে হানিফ সংকেতের উত্তরসূরি বলা যায়, আমাদের স্নেহের রাসেল ছিলো এর উপাধ্যক্ষ। প্রশিক্ষক হিসেবে শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন সামীম আহমেদ খান, ইসমত আরা সাফী বন্যা প্রমুখ। তার সাথে শিমুল ছিলেন ইংরেজি মাধ্যমে ট্র্যাডিশনাল ডিবেটের প্রশিক্ষকরূপে। পাঞ্জেরি-দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া বিতার্কিক ঐশী এবং ছোঁয়াও প্রশিক্ষক হিসেবে কয়েকটা ক্লাস নিয়েছে। পরবর্তীকালে প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন বাবুরহাট স্কুল এন্ড কলেজের বিতর্ক অন্তঃপ্রাণ বিজ্ঞান শিক্ষক মাসুদুর রহমান, বিশিষ্ট
আবৃত্তি শিল্পী ও শিক্ষক মো. শাহ আলম, ইংরেজির শিক্ষক মো. হানিফ, মুন্সী আব্দুল খালেক, সৈকত অধিকারী, হামানকর্দি পল্লীমঙ্গল স্কুলের শিক্ষক শওকত ইমন এবং কচুয়া টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও শিক্ষক আনাস আল যায়েদ প্রমুখ। বিতর্কে নিবেদিতপ্রাণ রাজন চন্দ্র দে ছিলেন সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এবং তাকে যোগ্য সহযোগিতা করেছেন উজ্জ্বল হোসাইন, আবু ছালেহ, নিরব, আজিজুল হাকিম নাহিন, আরিফ, সাইফুল, শামীম হাসান, নোমানদের মতো বিতর্কযোদ্ধা তরুণেরা। অফিস সহকারী হিসেবে যুক্ত হয় বিমল চন্দ্র দে। নেপথ্যে আরও অনেক ব্যক্তির শ্রম, সময় ও সহযোগিতা ছিলো, যাদের অবদান ভুলবার নয়।
দুহাজার আঠারো সালের এক জানুয়ারি সোমবার আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির যাত্রা শুরু করি। বিকেল চারটায় বকুলতলাস্থ রেলওয়ে কিন্ডারগার্টেনে কেক কেটে আমাদের যাত্রা হলো শুরু। কেক কেটে শুভারম্ভ করেন একাডেমির উপদেষ্টা ও সে বিকেলের প্রধান অতিথি অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার। আমাদের প্রথম ছাত্রী আমরা পেয়ে যাই তার আগেই। সে ছিলো মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সামিয়া বিনতে জাকির, যার পরিচয় বাবুরহাট স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক জাকির হোসেন এবং বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ খোদেজা বেগমের কনিষ্ঠা কন্যা হিসেবে। একইদিন আমি ও কাজী শাহাদাত ভাইয়ের পরিবার বিকেল তিনটায় ঘোড়ামারা মাঠে যাই, স্বামী স্বরূপানন্দের চরিত্রগঠন আন্দোলন দিবসের উদযাপন অনুষ্ঠানে। ওখান থেকেই আমরা তড়িঘড়ি করে বকুলতলায় আসি।
‘যুক্তিতে মুক্তি পাক অবরুদ্ধ তারুণ্য’ এ স্লোগানকে চেতনায় ধারণ করেই শুরু হয় আমাদের যাত্রা। চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি (সিডিএ) মূলত চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন (সিকেডিএফ)-এর আওতায় পরিচালনাধীন একটা স্বেচ্ছাসেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
সিডিএ’র অস্থায়ী ক্যাম্পাস রেলওয়ে কিন্ডারগার্টেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অধ্যক্ষ হিসেবে আমি ছিলাম সভাপতি। চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি (সিডিএ)’র স্বপ্নদ্রষ্টা ও সিকেডিএফ সভাপতি কাজী শাহাদাত একাডেমি প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে সেদিন বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিকেডিএফ-এর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও সিডিএ-র সমন্বয়কারী রাজন চন্দ্র দে। আরও উপস্থিত ছিলেন সিকেডিএফ সহ-সভাপতি ও চাঁদপুর কণ্ঠের বার্তা সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্যাহ, বাবুরহাট হাই স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যাপক রোটা. জাকির হোসেন, রেলওয়ে কিন্ডারগার্টেনের অধ্যক্ষ মাহমুদা খানম, সিকেডিএফ-এর আজীবন সদস্য ইসমত আরা সাফি বন্যা, শাহজাহান সিদ্দিকী, মাসুদুর রহমান, গোফরান হোসেন, সিকেডিএফ-এর সম্পাদক মো. উজ্জ্বল হোসাইন, কোষাধ্যক্ষ সেলিম রেজা, প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মো. আরিফ হোসেন, কার্যকরী সদস্য মো. আবু সালেহ, বিতার্কিক রত্না আক্তার, সজিব হোসেন বিজয়, আজিজুর রহমান ইজাজ, নুসরাত জাহান ওহী, চাঁদপুর সেন্ট্রাল ইনার হুইল ক্লাবের সভাপতি ও সিকেডিএফের আজীবন সদস্য মুক্তা পীযূষ, হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় বিতর্ক ক্লাবের সভাপতি তাওহীদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ইফরান হোসেন, বিতর্ক একাডেমিতে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীবৃন্দ, অভিভাবকবৃন্দ, রেলওয়ে কিন্ডারগার্টেনের উপাধ্যক্ষ রুবিনা মরিয়মসহ অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ। উদ্বোধনী দিনে এগারো জন শিক্ষার্থী ভর্তি ফরম সংগ্রহ করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ঊনিশ জানুয়ারি দুহাজার আঠারো সালের শুক্রবার বিকেল তিনটা থেকে একাডেমির নিয়মিত সাপ্তাহিক ক্লাস শুরু হবে। তার পূর্বে ভর্তি কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।
বিতর্ক একাডেমির প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে অভিভাবক মহলে ব্যাপক সাড়া লক্ষ করা যায়। তাদের শিক্ষার্থী ভর্তির অনুরাগ ও আন্তরিকতা থেকে একথা পরিষ্কার বোধগম্য হয়। অনেকে কমবয়সী বাচ্চাদেরকেও ভর্তি করানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। আমরা বিনয়বিহিতে তা ফিরিয়ে দেই। জানুয়ারির ঊনিশ তারিখ বিকেল তিনটায় প্রশিক্ষণ ক্লাসের সূচনায় এক তারিখের মতো জমকালো না হলেও ছোট একটা অনুষ্ঠান হয়, যাতে প্রধান অতিথি ছিলেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী। সভাপ্রধান ছিলেন চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও প্রকাশক আলহাজ অ্যাড. ইকবাল-বিন-বাশার। চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন (সিকেডিএফ)’র সভাপতি কাজী শাহাদাতের পরিচালনায়
প্রধান আলোচক রাখা হয় আমাকে। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন সিকেডিএফের সাধারণ সম্পাদক রাজন চন্দ্র দে ও সিডিএ’র উপাধ্যক্ষ রাসেল হাসান। প্রশিক্ষণার্থীদের থেকে বক্তব্য রাখেন হাসান আলী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাওহিদুর রহমান। সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন শেষে প্রত্ন পীযূষ বড়ুয়া ও অদিতি সরকার রিয়া সংগীত পরিবেশন করে। এরপর অতিথিবৃন্দ ‘যুক্তি’ ও ‘মুক্তি’ নামে বিতর্কের দুটি প্রশিক্ষণ শ্রেণিকক্ষের দ্বার উদ্ঘাটন করেন। বড়োদের ক্লাসে আমি এবং ছোটদের ক্লাসে রাসেল হাসান মিলে প্রশিক্ষণ প্রদান করি। প্রথম ব্যাচে আটচল্লিশ জন প্রশিক্ষণার্থী নিয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।
প্রশিক্ষণার্থীদের কাছ থেকে নামে মাত্র ফি নিয়ে সমাজ বিনির্মাণের মহতী উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি তরতর করে এগিয়ে যেতে থাকে। ছাত্র-ছাত্রী ও প্রশিক্ষকমণ্ডলী সবাই এক অনির্বচনীয় অপার্থিব আনন্দে মেতে উঠেছিলো বকুলতলার সেই ক্ষুদ্র আঙ্গিনায়। সুন্দর ও সত্যকে লালন ও ধারণের অভিপ্রায়ে এক চিলতে আঙ্গিনা হয়ে উঠেছিল এক বিশাল ময়দানের মতো। এ যেন মলয় মুখরিত স্বর্গোদ্যান। উঠোনে চেয়ার-টেবিল বসিয়ে মুক্ত প্রাঙ্গণে নেয়া হয়েছিল মৌখিক পরীক্ষা। সামীম ভাইয়ের সেই গুম্ফিত সহাস্য মুখখানি হয়ে উঠেছিলো আমাদের উৎসবের পতাকা। লিখিত, মৌখিক, শ্রেণি কার্যক্রম ও ব্যবহারিক বা সরাসরি বিতর্ক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা সমাপ্ত করি মূল্যায়ন অভীক্ষা। যারা এ-প্লাস পেয়ে পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত হলো তাদের নিয়ে তৈরি হলো আলাদা গ্রুপ, যার নাম দেওয়া হলো তুখোড়। মূল পাঠক্রমিক শিক্ষার পাশাপাশি সহপাঠক্রমিক শিক্ষা চালাতে গেলে অনেক বিষয় মাথায় রাখতে হয়। যেমন : অনেকের প্রাইভেট টিউশন থাকে, অনেকের ধর্মীয় শিক্ষক আসেন পড়াতে। আবার এক এক স্কুলে শ্রেণিভিত্তিক পরীক্ষার সময়সূচি এক এক রকম। বছরে কোনো কোনো স্কুলে তিনটে আর কোনো স্কুলে দুটো পরীক্ষা হয়। এসব কিছুর সাথে সমন্বয় করে প্রশিক্ষণ ক্লাস চালাতে হয়। পাশাপাশি পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতরের লম্বা ছুটি থাকে। ফলে নানা অনিবার্য কারণে বিতর্ক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হয়। একবার যদি বিরতি শুরু হয়, তবে এ কার্যক্রমে পুনঃ গতি সঞ্চার করা কঠিন হয়ে পড়ে। লোকাল ট্রেনের মতো চলছে তো চলছে এমন হয়ে যায়। সে রকম সমস্যায় আমরা পড়লেও সাংগঠনিক দক্ষতা ও অভিভাবকদের আন্তরিকতায় তা কাটিয়ে উঠি।
মানুষের তৈরি জট ছাড়াতে পারলেও প্রকৃতির জট ছাড়ানো আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। বর্ষা সমাগমে রেলওয়ে কিন্ডারগার্টেনের আবদ্ধ নিচু ভূমিতে বৃষ্টির পানি জমে প্যাঁক কাদা হয়ে যায়। ফলে শিক্ষার্থীদের জন্যে যাতায়াত-শোভন ব্যবস্থা বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এ সমস্যার সমাধানে আমাদের বর্ষাকালীন অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে গনি মডেল স্কুলকে বেছে নেওয়া হয়। গনি মডেল স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব আব্বাসউদ্দীন নিজেও একজন বিতর্কবান্ধব প্রগতিশীল চর্চার মানুষ। তিনি ও শাহাদাত ভাই কথা বলে আমাদের এ সমস্যার সমাধান করে দিলেন। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরী মাঝে মাঝে সময়মত শ্রেণিকক্ষ তালামুক্ত করতেন না। ফলে যতটুকু মসৃণ গতিতে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালাতে পারতাম, ততটুকু মসৃণ সুযোগ আমরা পেলাম না। একসময় হাসান আলী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ক্লাস চালানোর চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু সকল বিষয়ে স্নিগ্ধ পরিবেশ পাওয়া না যাওয়ায় আমাদের আর সে প্রাঙ্গণে থিতু হওয়া হয়নি। সময় গড়াতে গড়াতে একসময় আমরা সনদ বিতরণের সময়ে উপনীত হলাম। চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির প্রথম ব্যাচের সমাপনী ও দ্বিতীয় ব্যাচের উদ্বোধনী পর্ব অনুষ্ঠিত হয় দুই মার্চ দুহাজার আঠারো সালে। তারপর ছয় এপ্রিল দুহাজার আঠারো সালে দ্বিতীয় ব্যাচের সনদ বিতরণ হয় এবং তৃতীয় ব্যাচের উদ্বোধন হয়। এ উপলক্ষে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়। প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে তাওহিদুর রহমান, সামিয়া বিনতে জাকির ও প্রত্ন পীযূষের অনুভূতি প্রকাশিত হয়। উপাধ্যক্ষ রাসেল হাসানের স্মৃতি চারণের শিরোনাম ছিলো : ‘ঊনিশে জানুয়ারি দুপুর দুইটা বেজে আটান্ন মিনিট’। শিরোনামটি তার কথার মতোই বেশ কৌতূহলোদ্দীপক। এভাবেই একসময় তৃতীয় ব্যাচ পার হয়ে চতুর্থ ব্যাচের সমাপনী ও পঞ্চম ব্যাচের উদ্বোধন হয় চৌদ্দ ডিসেম্বর শুক্রবার বিকেলে, দুহাজার আঠারো সালে। চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল হোসাইনের সঞ্চালনায় এবং চাঁদপুর কণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক ও প্রকাশক রোটা. আলহাজ্ব অ্যাড. ইকবাল-বিন-বাশারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানের শুরুতেই দিবসের ভাব গাম্ভীর্যতায় শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করা হয় এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নৌ-কমান্ডো মমিনউল্লা পাটওয়ারী বীর প্রতীকের সহধর্মিণীর মৃত্যুতে শোক জানানো হয়।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা রোটা. কাজী শাহাদাত এবং প্রধান বক্তা হিসেবে আমি কিছু কথা বলার সুযোগ পাই। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন লেডী দেহলভী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইলিয়াস মিয়া ও পুরাণবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মজিবর রহমান। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির প্রশিক্ষক ও হাসান আলী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক ইসমত আরা সাফি বন্যা, প্রশিক্ষক সামীম আহমেদ খান, গ্রামীণ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক গোলাম মোস্তফা খান, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমির উপাধ্যক্ষ রাসেল হাসান, ইংরেজি বিতর্কের প্রশিক্ষক শিমুল, চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আরিফ হোসেন, সদস্য রবিউল আউয়াল, সদস্য জায়েদুর রহমান নীরব, চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশনের সদর উপজেলা কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক কাজী আজিজুল হাকিম নাহিন, প্রশিক্ষণার্থী ও অভিভাবকবৃন্দ। সবশেষে চতুর্থ ব্যাচে উত্তীর্ণদের নাম ঘোষণা করেন একাডেমির প্রধান সমন্বয়কারী রাজন চন্দ্র দে। পরবর্তী স্তরে উত্তীর্ণদের অতিথিদের মাধ্যমে সনদপত্র প্রদান করা হয়।
আমরা যখন চলতে চলতে একটা গতি অর্জন করলাম তখন হানা দিলো করোনা অতিমারি। চাঁদপুর জেলা এসে গেলো লক ডাউনের আওতায়। ফলে বিতর্ক একাডেমির কার্যক্রমও সঙ্গত কারণে স্থগিত হয়ে গেলো। একটানা দুহাজার কুড়ি সালের মধ্য মার্চ থেকে শুরু করে বিরতি পড়লো দুহাজার তেইশ পুরোটা। দুহাজার কুড়ি সালের সতের মার্চ থেকে একটানা পাঁচশো তেতাল্লিশ দিন বন্ধ থাকার পর সীমিত সময়ের জন্যে সপ্তাহে কয়েকদিন করে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হলো। কিন্তু জনমনে তখনও করোনাভীতি রয়ে যায়। দীর্ঘ বিরতির কারণে একদিকে চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন বা সিকেডিএফের জনবলে যেমন ঘাটতি দেখা দেয়, তেমনি বিতর্ক একাডেমির ক্ষেত্রেও একই সমস্যা তৈরি হয়। নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা সবাই কর্মস্থলে সচল হয়ে গেছে কেউ কেউ, কারও কারও অভিবাসন হয়েছে অন্যত্র। ফলে নতুন করে শুরু করার ঝক্কি পোহানোর মতো মানসিক শক্তি আমাদের ছিলো না। এরমধ্যে অবশ্য অভিভাবক ও আগ্রহী শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ ও তাগাদার কমতি ছিলো না। আমাকে যেমন তাগাদা দিয়েছে, আক্ষেপ করেছে, তেমনি কাজী শাহাদাত ভাইকেও বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে, যাতে বিতর্ক একাডেমির কার্যক্রম পুনরুদ্যমে শুরু করি। কিন্তু করতে বললেই তো আর করা যায় না। মান বজায় রেখে ধারাবাহিকতা চালু রাখা বড়ো কঠিন। পবনপুত্রের গন্ধমাদন পর্বতের হাজার হাজার ঔষধির মধ্যে বিশল্যকরণী খোঁজার চেয়েও কঠিন মনে হয় বাস্তবতায়। এতো চাপের ভিড়ে হঠাৎ একজন উদয় হলেন। তিনি মোহাম্মদ হানিফ, যিনি মতলব উত্তরের আচলছিলা মাধ্যমিক স্কুলের ইংরেজি শিক্ষক। আগে ছিলেন আল-আমিন একাডেমির বিতর্ক দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক। তার তাগাদা ও অঙ্গীকারের কারণে কাজী শাহাদাত ভাই সম্মত হলেন নতুন করে বিতর্ক একাডেমির ক্লাস শুরু করার জন্যে। পাঞ্জেরী-দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার যুগপূর্তি উদযাপনকল্পে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আগে বিতর্ক কর্মশালা করবো, তারপর ঐ কর্মশালা শেষে বিতর্ক একাডেমির পুনরুত্থান ঘটাবো। সিদ্ধান্ত মোতাবেক দুহাজার তেইশ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আমরা ইংরেজি ও বাংলা উভয় মাধ্যমে বিতর্ক কর্মশালা সম্পন্ন করি। প্রতিটি কর্মশালায় ছিলো উপচেপড়া ভিড়। দুটো গ্রুপে ভাগ করে চাঁদপুর প্রেসক্লাবে ও এলিট চায়নিজে আমরা কর্মশালা সফলভাবে সম্পন্ন করি। জেলা প্রশাসক, চাঁদপুর; এসপি, চাঁদপুর, চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, চাঁদপুর দুশো পঞ্চাশ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রশিক্ষণার্থীদের অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। কর্মশালায় প্রশিক্ষক হিসেবে আমার সাথে আরও ছিলেন রাসেল হাসান, সামীম আহমেদ খান, আফরোজা খাতুন মেরি, মাসুদুর রহমান, অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা ও শাহ আলম। প্রশিক্ষণের ফাঁকে ফাঁকে আবৃত্তি ও সংগীত পরিবেশন করা হয়, যাতে দীর্ঘক্ষণ বকবক শুনতে শুনতে একঘেঁয়েমি না লাগে। মাঝে মাঝে হানিফ সাহেবের হাতে মাইক্রোফোন দেওয়া হতো, যাতে তিনি বিতর্ক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মনোবাঞ্ছা জানতে পারেন এবং তাদের অভিব্যক্তি বুঝতে পারেন। তিনি এর ফাঁকে ফাঁকে বিতর্ক একাডেমির পুনরুত্থানের বিষয়টিও শিক্ষার্থীদের অবহিত করেন।
দুহাজার আঠারো সালে যখন বিতর্ক একাডেমি শুরু হয়, তখন প্রশিক্ষণার্থীদের জন্যে আমরা বিনামূল্যে আমার লিখিত ‘বিতর্ক বীক্ষণ’ পুস্তিকাটি পাঠ্য হিসেবে বিতরণ করি। ঐ বছরের শেষে কাজী শাহাদাত ভাইয়ের তাগাদায় আমি বৃহৎ পরিসরে সনাতনী বিতর্কের একটা নূতন বইয়ের পান্ডুলিপি তৈরি করে তার কাছে জমা দিই। পান্ডুলিপির নাম দেই ‘বিতর্ক সমগ্র’। পাঞ্জেরি কর্তৃপক্ষ বইটি ছাপে ছাপে করে দীর্ঘ পাঁচ বছর আটকে রেখেছিলো। দুহাজার চব্বিশের পুনরুত্থানকে কেন্দ্র করে পাঞ্জেরীকে তাগাদা দেয়া হলো। এবার বরফ গলতে শুরু করে। বিতর্ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা শেষে সেপ্টেম্বরে আবারও পাণ্ডুলিপিটি তারা চেয়ে বসে। প্রথমবার রাজন চন্দ্র দে পেন ড্রাইভে করে পাণ্ডুলিপিটি জমা দিয়েছিলো। ওটা হারিয়ে যাওয়ায় আবারও পাণ্ডুলিপিটি তারা চেয়ে বসে। কিন্তু আমাদের কারও কাছে এর কোমল কপি নেই। সৌভাগ্যবশত দায়িত্বপ্রাপ্ত নিলয় নন্দী জানান, পাণ্ডুলিপিটির ই-মেইল কপিটি তারা খুঁজে পেয়েছেন। ষোলই ডিসেম্বরে বইটি প্রকাশ করার কথা বলে তা ছুঁয়ে গেলো ছাব্বিশে জানুয়ারি, দুহাজার চব্বিশ।
আমাদের বিতর্ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা সকলের মনে এতো রেখাপাত করেছিলো যে, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, স্টেডিয়াম রোড কর্তৃপক্ষ নিজেরাই প্রস্তাব দিলো, তাদের প্রতিষ্ঠানে যাতে আমরা বিতর্ক একাডেমির কার্যক্রম চালু করি। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সমঝোতা অনুযায়ী আমরা স্কুল ভবনের দোতলায় তিনটা কক্ষে আমাদের ক্লাস নেওয়া শুরু করলাম।
ছাব্বিশে জানুয়ারি দুহাজার চব্বিশ সালে ড্যাফোডিল স্কুলের মাঠে সামিয়ানা টাঙিয়ে শুরু হয় আমাদের নব পর্যায়ের বিতর্ক একাডেমির কার্যক্রম। এদিন একদিকে ছিলো অরিয়েন্টেশন আর অন্যদিকে ‘বিতর্ক-সমগ্র’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন আলহাজ্ব ওচমান গনি পাটোয়ারী এবং বিশেষ অতিথি ছিলেন উক্ত স্কুলের অধ্যক্ষ নূর খান। ফেব্রুয়ারি দুই তারিখে আমরা ক্লাসের কার্যক্রম শুরু করি। প্রথমে সনাতনী বাংলায় বড়োদের ও ছোটদের আলাদা গ্রুপ এবং ট্র্যাডিশনাল ইংলিশ ডিবেটে একটি কমন গ্রুপ তৈরি করি। পরে, কমন গ্রুপটাকে দুভাগে ভাগ করি, ছোটদের এবং বড়োদের। ভর্তির নির্ধারিত সময়সীমা পার হলেও অনেক অভিভাবক আব্দার করেন তাদের সন্তানকে ভর্তি করিয়ে নিতে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা সবাইকে বিনয়ের সাথে পরবর্তী ব্যাচে ভর্তি হতে আহ্বান জানাই। বিতর্ক একাডেমির নব পর্যায়ের প্রথম সেমিস্টারের কার্যক্রম সফলভাবে শেষ করে পবিত্র মাহে রমজান ও ঈদুল ফিতরের বন্ধ পড়ে যায়। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় সেমিস্টারের কার্যক্রম। কিন্তু এই কার্যক্রম শুরু করতে না করতেই কোটাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন চরম পরিণতি ধারণ করায় আমাদের কার্যক্রম পূর্ণদমে বন্ধ হয়ে যায়। চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি সেই থেকে শীতনিদ্রায় দিনযাপন শুরু করেছে বলা যায়। হয়তো নূতন একদল বিতর্ক শ্রমিকের হাত ধরে বিতর্ক একাডেমি তৃতীয় দফায় নবজীবনে সক্রিয় হয়ে উঠবে।
বিতর্ক একাডেমি চালাতে গিয়ে বুঝতে পেরেছি, অভিভাবকরা পারলে একদিন বয়সী বাচ্চাকেও প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে দেন। অনেকেই মনে করেন, বিতর্ক একাডেমি তার না বলতে পারা শিশুর মুখে বোল ফুটাবে। কারো কারো ধারণায়, কোনো জ্ঞান অর্জন ব্যতিরেকে তার সন্তান গড়গড় করে যুক্তিতর্ক পেশ করতে শিখে যাবে। আসলে কাউকে বিতার্কিক হিসেবে নির্মাণ করা যায় না। শুধু তাকে ঘষেমেজে নেয়া যায় যাতে ক্ষুরধার যুক্তি হয়। কোনো কথা যাতে চটুল ও আলটপকা না হয়। অথচ অভিভাবকরা মনে করেন, পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বই না পড়া সন্তানটি বিতর্ক একাডেমিতে গিয়ে কথার খই ফোটাবে। আসলে বিতর্ক একাডেমি কেবল কারও বলার ধরনে পরিবর্তন আনে, পরিবর্তন আনে বাচনভঙ্গিতে। আমূল কোনো বিতার্কিক তৈরি করে না, কেবল পূর্বের আনাড়ি বিতার্কিককে ভবিষ্যতের কুশলী যুক্তিযোদ্ধায় রূপান্তরিত করে। (চলবে)