প্রকাশ : ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:২১
কড়িকাঠ নয়, কড়িপাঠ

সতী-লক্ষ্মী-দীপঙ্কর-ঘোষালদের চরিত্র নিয়ে মহাকাব্যিক পটভূমিতে দুইখণ্ডে রচিত, তেরোশ সত্তর বঙ্গাব্দে রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত বিমল মিত্রের কালজয়ী উপন্যাস 'কড়ি দিয়ে কিনলাম'। উপন্যাসের শিরোনামটি ব্যঙ্গাত্মক বোধ তৈরি করে নিঃসন্দেহে। ব্যাজস্তুতি বা প্রশংসার ছলে নিন্দার কৌশল নিয়ে বিমল মিত্র যা বোঝাতে চেয়েছেন, তার সারমর্ম হলো, কড়ি দিয়ে সবকিছু কেনা যায় না। উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র অঘোর বাবু অহংকার বা তুচ্ছ করে যদিও বলেছিলেন, 'কড়ি দিয়ে সবকিছু কেনা যায়,' কিন্তু দীপঙ্কর তার আদর্শ দিয়ে বুঝিয়ে দেয়, কড়ি দিয়ে জীবনের আনন্দ কিনতে পাওয়া যায় না। তারই ফলস্বরূপ উপন্যাসের রচয়িতা বিমল মিত্র নামকরণে 'কড়ি দিয়ে কিনলাম' বলে অর্থলিপ্সু মানুষের লোভ ও অহংকারের গায়ে ঘাই মেরে উপহাস করেছেন নান্দনিকভাবে।
কড়ি দিয়ে কেনার কথা আসাতে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে যায়, এককালে কড়িও ছিলো বিনিময় মাধ্যম। তবে তা ছিলো ক্ষুদ্র কেনাকাটায়। বাংলার ইতিহাসের প্রাচীনতম লিখিত দলিল 'মহাস্থান শিলালিপি' মোতাবেক জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সম্রাট অশোক দুর্ভিক্ষকালে স্থানীয় গভর্নরকে নির্দেশ দেন, যাতে জনগণকে 'গণ্ডক' ও 'কাকনিক' সাহায্য প্রদান করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, 'গণ্ডক' ও 'কাকনিক' হলো প্রকৃতপক্ষে কড়ি গণনার একক।
মহাযান লিপির 'গণ্ডক' সম্ভবত 'চার কুড়ি' মূল্যমানের সমান।
ইতিহাসসূত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কড়িকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় চার হাজার বছর আগে থেকে কড়ি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলায় ঠিক কবে নাগাদ কড়ি চালু হয় তা স্পষ্ট নয়। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক থেকে শুরু হয়ে পাল-সেন ও মধ্যযুগ শেষে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রায় উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলায় মুদ্রা হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিলো। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদেও বিনিময় কাজে কড়ির গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে।
মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বাংলায় এসে কড়ির ব্যবহার দেখতে পান। সফরনামা কিতাবুর রেহালা'য় তিনি লেখেন, 'এ দ্বীপের (মালদ্বীপের) বাসিন্দারা টাকাপয়সা হিসেবে কড়ি ব্যবহার করেন। তারা বাংলার অধিবাসীদের কাছে চালের বিনিময়ে কড়ি বিক্রি করেন। বাংলায়ও এ জিনিস অর্থ হিসেবে ব্যবহার হয়।' খ্রিস্টিয় পনেরো শতকে চৈনিক রাজদূত মা-হুয়ানের লেখা হতে জানা যায়, বাংলায় সে সময় ছোটখাটো কেনাকাটায় তারা কড়ি ব্যবহার করতো। খ্রিস্টিয় আঠারো শতকে ইংরেজ আমলেও আমাদের দেশে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে কড়ির কদর ছিলো। তারই সূত্র ধরে ইংল্যান্ডে দাস কেনাবেচায় কড়ির প্রচলন জনপ্রিয় হয়।
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে কড়ি সম্পর্কে বিস্তৃত উল্লেখ রয়েছে। মধ্যযুগে গ্রামাঞ্চলে কড়িই ছিল ক্রয়-বিক্রয়ের প্রধান মাধ্যম। মধ্যযুগের ঐতিহাসিক আল মাসুদী ও আবুল ফজল রচিত বিবরণীতে বাজারমূল্য ধরা হয়েছে কড়ির মানদণ্ডে। ভূমিরাজস্ব সংগ্রহে শস্যকর থেকে মুদ্রাকর ধাপে উত্তরণের প্রথম পর্বে কড়ি মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিলো। এর সাক্ষ্য বহন করে মোঘল আমলের রাজস্ব বন্দোবস্ত। মোঘল আমলে প্রজা বা রায়তরা শস্য বা কড়ি, যে কোনো মাধ্যমে রাজকোষে রাজস্ব পরিশোধ করতে পারতো। সুলতানী আমলেও এর ধারাবাহিকতা ছিলো। মোঘল আমলে, বাংলায় যারা বাট্টা বা দস্তুরি নিয়ে কড়ির সঙ্গে সোনা বা রূপোর মুদ্রার বিনিময় করতেন তাদের বলা হতো ‘পোতদার’ যা স্থানীয় উচ্চারণে ক্রমশ ‘পোদ্দার’ হিসেবে পরিবর্তিত হয়েছে। বাংলার সীমান্ত এলাকায়, রংপুর ও সিলেট জেলায় ঊনিশ শতকের শেষনাগাদও কড়ির প্রাধান্য ছিলো। কড়িমুদ্রার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর গণনা-রীতি, যা কড়ি ব্যবহারের শেষদিন পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিলো। কড়ির গণনাবিধি ছিলো নিম্নরূপ :
৪ কড়ি = ১ গন্ডা; ৮০ কড়ি বা ২০ গন্ডায় = ১ পণ; ১৬ পণ = ১ কাহন এবং ৪ কাহন=১ টাকা। ভাস্করাচার্যের লীলাবতী গ্রন্থে উল্লিখিত আছে, ২০ কড়ি = ১ কাকিনি; ৪ কাকিনি = ১ পণ।
কড়ি মূলত মৃত শামুকের খোল যা পোর্সেলিনের মতো শক্ত। আমাদের দেশে সাদাটে-নীলাভ যে কড়ি পাওয়া যায় তার উৎস কিন্তু মালদ্বীপ। এগুলোই আগে টাকা বা মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ভারত মহাসাগর হতে আহরণকৃত এই কড়িগুলো আমদানি করা হতো জাহাজ বোঝাই করে। আমাদের দেশীয় কড়ি দিয়ে বানানো হতো নানারকম অলঙ্কার। কড়ি নিয়ে প্রচলিত আছে নানা কুসংস্কার। আগেকার দিনে কারও প্রতি কুনজর বা কুদৃষ্টি কাটানোর জন্যে বাচ্চাদের কোমরে বা গলায় কালো সুতো দিয়ে কড়ি ফুটো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। এখনও এ চর্চা গ্রামাঞ্চলে অব্যাহত আছে। তবে কমে আসছে ধীরে ধীরে। কুসংস্কারের পাশাপাশি দেশে এখনও কবিরাজি ঔষধ তৈরিতে কড়ির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গেলে স্যুভেনির হিসেবে কড়ি আনেননি এমন লোক বিরল। কড়িতে নাম লিখে কিংবা নামের আদ্যাক্ষর লিখে প্রিয়জনকে উপহারও দিয়েছেন অনেকেই। কড়ি দিয়ে তৈরি করা চাবির রিংও ব্যবহৃত হয় বহুল পরিমাণে। চারটা কড়ি নিয়ে কড়ি খেলা একসময় গ্রামীণ কিশোর-কিশোরীদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলো। চারটা কড়িই উপুড় হয়ে পড়লে দান হতো ষোলো। প্রতিটার মান চার করে। আবার সবকটা কড়ি চিৎ হয়ে পড়লে দান হতো চার ছয়ে চব্বিশ। অর্থাৎ প্রতিটা ছয় করে। কড়ি খেলায় প্রচলিত একটা বোল অত্যন্ত মজার। বোলটি হলো,
'খুশুর খুশুর দুর্গা মাসুর
তিন তালিয়া মার কেলিয়া
কুমড়ার চাক ধাপ্পা দিয়া
হাতের কড়ি হাতে থাক'।
কড়ি খেলাকে ধর্মচর্চার অংশ মনে করে আসামের ডিব্রুগড়ের মটক উপজাতি। এরা মূলত অসমের তিনসুকিয়া এবং ডিব্ৰুগড় জেলায় বসবাস করে। তারা প্রাচীনকাল থেকেই বিহু পরবের শেষে ঐতিহ্যগতভাবে মুদ্রা খেলা বা কড়ি খেলা খেলে আসছে। বোহাগ বিহুর সময় মটক সম্প্রদায়ের যুবকরা হুচোরি গান শেষ হওয়ার ছয়-সাতদিন পর কড়ি খেলার আয়োজন করে থাকে।
আগেকার দিনে কড়ি নিয়ে খেললে গুরুজনরা বলতেন, ঘরে টাকা-পয়সার অভাব হবে শীগগির। জানি না, এ কথার উৎস কোথায়। তবে নেপালে কড়ি এখনও জুয়া খেলায় ব্যবহৃত হয়। হতে পারে, জুয়া খেলায় কড়ির ব্যবহার থেকেই কড়ির সাথে টাকা-পয়সার অভাবকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলায় কড়ি শব্দের উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ 'কপর্দক' হতে। আজকাল কপর্দক শব্দের অর্থ বিস্তৃত হয়ে তা আর্থিক অবস্থাকেও প্রকাশ করে। কেউ কপর্দকহীন বললে আমরা বুঝি তিনি আর্থিক সংকটে আছেন। কপর্দকহীন ব্যক্তি নিজের করুণ অবস্থা বুঝাতে বলে থাকে, 'আমার কাছে কানা কড়িও নেই।' অর্থাৎ, তিনি এমনই অর্থ-সামর্থ্যহীন যে, কোনো অচল কড়ি বা মুদ্রাও তার পকেটে নেই। এমনকি কোমরে বাঁধার জন্যে ফুটো করা কড়িটিও তার সাথে নেই। কানা কড়ি এখানে চমৎকার উপমা হিসেবে ব্যহৃত হয়েছে।
বাংলা কড়িকে হিন্দিতে বলা হয় কৌড়ি। কড়ি দিয়ে লেনদেন হতো বলেই 'গাঁটের কড়ি' কথাটির বহুল প্রচলন আছে। কেউ গাঁটের কড়ি খরচ করে অদরকারি কাজ করতে চায় না। অর্থাৎ নিজের কষ্টার্জিত সঞ্চয় কেউ অকাজে নষ্ট করতে চায় না। গাঁটের কড়ির মতো টাকাকড়িও একটা অভেদ্য শব্দবন্ধ হয়ে আছে বহুকাল আগে থেকেই। শত বছর ধরে বাংলা প্রবাদ-প্রবচনে কড়ি এক উল্লেখযোগ্য জায়গা দখল করে আছে। ফেলো কড়ি মাখো তেল বললে আমরা বুঝি, জগতে টাকা ছাড়া কিছুই মেলে না। তাই টাকাকড়ির বিনিময়েই অর্থাৎ উপযুক্ত মূল্যেই গায়ে মাখার তেল তথা কাঙ্ক্ষিত বস্তু পাওয়া যায়। কেউ কাউকে ফাও বা মাগনা কিছুই দেয় না। আবার টাকার জোর বা দৌড় বুঝাতে আমরা বলি, ' কড়ি হলে বাঘের দুধও মিলে।' এটার আরেকটা ধরন হলো, ' কড়ি হলে বাঘের চোখ মেলে।' অর্থাৎ টাকা বা কড়ি হলে আসলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়। কড়ি বা টাকার জোরে বাঘের দুধ বা বাঘের চোখের মতো দুষ্প্রাপ্য বস্তুও জোগাড় করে আনা সম্ভব। পাশাপাশি, টাকাকড়ি নিয়ে সঠিক হিসেব থাকলে তা নষ্ট হওয়ার বা অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাই হিসাবের কড়ি কখনও বাঘে খায় না। হিসাব না থাকলে যে কোনো সম্পদ বা অর্থ চোরে চুরি করতে পারে বা অপচয় হয়ে যেতে পারে। এ প্রবাদের কাছাকাছি আরেকটা প্রবাদ হলো,' কড়ি লবে গুণে, পথ চলবে জেনে'। অর্থাৎ টাকা-পয়সা গুণে নেওয়াই উত্তম। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঝুট-ঝামেলা এড়ানো যায়। যেমন : হিসাবে টাকা কমবেশি হওয়া, ছেঁড়া বা নকল টাকার বিড়ম্বনা হতে রেহাই পাওয়া ইত্যাদি। আবার বলা হয়, 'কড়ি থাকলে বেয়াইয়ের বাপেরও শ্রাদ্ধ হয়, না থাকলে নিজের বাপের শ্রাদ্ধও হয় না।' অর্থাৎ জগতে টাকাই সব। যার টাকা আছে সে তুচ্ছ বা অদরকারি কাজকেও বড়ো করে উদযাপন করতে পারে। যার টাকা নেই সে দরকারি কাজটুকু করতে গিয়েই হিমশিম খায়। অনেকক্ষেত্রে তা-ও করা যায় না। আসলে জগতে টাকার গুণেই উৎসবের আড়ম্বরতা বাড়ে এবং টাকা থাকলেই উৎসবের আবহ তৈরি হয়। নিজের জন্মদাতা মা-বাবার চেয়ে বড়ো আর কেউ এ নশ্বর দুনিয়ায় হয় না। কিন্তু টাকা বা কড়ি না থাকলে তাদের শ্রাদ্ধও সম্ভব নয়। যার অঢেল টাকাকড়ি আছে, তার পক্ষে অপচয়কেও অপচয় মনে হয় না। বেয়াইয়ের বাপের শ্রাদ্ধের ব্যয়ও নিজের কাঁধে নিতে অসুবিধা হয় না। এ রকম করতে গিয়ে অনেক সময় অর্থ ব্যয় করে অযোগ্য জিনিসকেও মানুষ ঘরে নিয়ে আসে। আর এ কারণেই বলে ' কড়ি দিয়ে কানা গরু কেনা'র কথা। বিশেষ করে বাজার হতে পচা মাছ কিনে ঘরে ঢুকলে গিন্নীর কাছে এরকম সূঁচালো কথাই শুনতে হয়। এক্ষেত্রে গিন্নীদেরকেই বলতে শুনি, 'কড়ি দিয়ে কিনব দই, গোয়ালিনী মোর কীসের সই?' আসলেই তাই। নগদ টাকার যেখানে বিনিময়, সেখানে খাতির কীসের। কে বন্ধু, কে সই তা বিবেচ্য নয়, আসল ব্যাপার হলো পণ্যটা ভালো কি না। এই প্রবচনের আবার অন্য একটি প্রকাশ হলো, ' কড়ি দিয়ে খাই দই, কি করবে মোর গোয়ালা সই?' দুটোই একই অর্থ প্রকাশ করে। কারও যখন ঘুম আসে না তখন সবাই কড়িকাঠ গুণতে বলে। কড়িকাঠ হলো ঘরের ছাদ বা ছাউনিকে ধরে রাখতে আড়াআড়ি পাতানো কাঠ। কিন্তু যখন তা বাগধারা অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন তার অর্থ আর কাঠে সীমাবদ্ধ থাকে না। তার অর্থ পরিবর্তিত হয়ে অনর্থক সময়ক্ষেপণকে বোঝায়। অনেককেই দেখা যায়, টাকা খরচ করেও নিজেকে বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। নৌকা ভাড়া করেও দেখা যায়, হেঁটে পথ পাড়ি দিতে হয়। ব্যাপারটা তখন 'কড়ি দিয়ে হেঁটে নদী পার হওয়া'র শামিল হয়৷ টাকাও গেল, কষ্টও করতে হলো। অনেক গুরুজনকে বলতে শোনা যায়, কড়ির জিনিস পরিস না। কথাটার অর্থ অতি সময়োপযোগী আজকাল। কারণ দামি জিনিস বা অলঙ্কার গায়ে থাকলে ছিনতাই হওয়ার ভয় থাকে।
কড়ি দিয়ে আগেকার দিনে মানুষের নামও রাখা হতো। যেমন এককড়ি, দুকড়ি, পাঁচকড়ি, সাতকড়ি ইত্যাদি। বাংলাদেশে থিযেটারের একটা নাটকও আছে 'সাতঘাটের কানাকড়ি' শিরোনামে। নাটকটি অধ্যাপক মমতাজউদ্দিন আহমদের লেখা। 'কড়ি ও কোমল ' শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের একটা বই আছে, কাব্যগ্রন্থ। এখানে এই কড়ি টাকা বা কপর্দক অর্থে নয়, বরং সংগীতের স্বরের ধরণ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। 'পাঁচবোন' শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আছে ছোটদের জন্যে। এই পাঁচবোনের কাজকর্ম সব অদ্ভুত। তারই নমুনা তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
'ক্ষান্তবুড়ির দিদিশাশুড়ির পাঁচবোন থাকে কালনায়
শাড়িগুলো তারা উনুনে বিছায় হাঁড়িগুলো রাখে আলনায়।
নুন দিয়ে তারা ছাঁচি পান সাজে চুন দেয় তারা ডালনায়
টাকাকড়িগুলো হাওয়া খাবে বলে রেখে দেয় খোলা জানলায়।'
ছড়াকবি দীপ্তি রায়ের লেখায় আমরা পাই,
'দোলায় আছে ছ'পন কড়ি, গুণতে গুণতে যাব'।
'হাটে যাব' শিরোনামে শিশুতোষ ছড়ায় কবি আহসান হাবীব লিখেছেন,
'হাটে যাব হাটে যাব ঘাটে নেই নাও
নি-ঘাটা নায়ের মাঝি আমায় নিয়ে যাও।
নিয়ে যাব নিয়ে যাব কত কড়ি দেবে?
কড়ি নেই কড়া নেই আর কিবা নেবে?'
কবি জীবনানন্দ দাশের ভাবনায় কড়ি ধরা পড়েছে ভিন্নভাবে। তিনি তাঁর সংবেদী মন নিয়ে কড়ির বেদনাকে ক্রূর ব্যথার সাথে তুলনা করে লিখেছেন,
'কড়ির মতন ক্রূর ব্যথা শুধু মানুষের
প্রবীণ পৃথিবী তাহা জানে।'
(পাণ্ডুলিপির কবিতা-৪৪০)
আবার 'শঙ্খমালা' শিরোনামের কবিতাতেও জীবনানন্দ কড়িকে স্মরণ করেছেন। শঙ্খমালার মুখের আদল ও রূপের বর্ণনায় তিনি কড়ির উপমা ব্যবহার করেছেন। তাঁর মোহনীয় চিত্রকল্পে শঙ্খমালা আমাদের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠে এইভাবে,
'কড়ির মতন সাদা মুখ তার;
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে : দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।'( শঙ্খমালা, বনলতা সেন)
বিদুষী খনাও থেমে ছিলেন না কড়ি নিয়ে। তাঁর বচনে তিনি বলেছেন,
'সকাল শোয় সকাল ওঠে
তার কড়ি না বৈদ্য লুটে'।
অর্থাৎ যে ব্যক্তি অধিক রাত না জেগে ঘুমায় আর ভোরে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে জেগে সচল হয়, তার স্বাস্থ্যহানি ঘটে না এবং তার টাকা-পয়সা ডাক্তার-বৈদ্যকেও সম্মানী স্বরূপ দিতে হয় না।
জ্যোতিষশাস্ত্রে কড়িকে সৌভাগ্যের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। পূজার ঘরে কড়ি রাখার কায়দা হতে ঘরে লক্ষ্মীর আশীর্বাদ ফল্গুধারার মতো আসতে থাকে। হাতে যারা একটা কড়ি ধারণ করে তাদের অহিতের কোনো সম্ভাবনাই নেই। অতএব, কড়িকে উপেক্ষা করার কোনো কারণ নেই।
কড়ির ইতিহাস আস্তে আস্তে হারিয়ে গেলেও এখনও মাটি খুঁড়লে কড়ি ভর্তি মটকা পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এর নজির বেশ কয়েকবার দেখা গেছে। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার কাজলী উত্তরপাড়া গ্রামে গত দুহাজার ষোলো সালে জুলাই মাসের মাঝামাঝি বিপুল পরিমাণ কড়ির সন্ধান মিলেছে। গ্রামের
তৌহিদ জোয়ার্দারের স্ত্রী জেসমিন বেগম বাড়ির সামনে ক্যানেল হতে মাটি কাটার সময় পুরনো একটি কলসের মধ্যে কড়ি দেখতে পান। এর আগেও একই
জেলার মহম্মদপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পুকুর বা কূপ খননকালে মাটির নিচে মৃত্তিকাপাত্রে রক্ষিত কড়ি পাওয়া গেছে। এই কড়িগুলো অনেক অনেক বছরের পুরানো বলে ধারণা করা হয়।
জগৎ মায়াময়। এ মায়া যেমন প্রেমের মায়া, ভাবের মায়া, তেমনি জগতে টাকাকড়ির মায়াও কম নয়। কড়ির মোহে জীবন কাটে, কড়ির খোঁজে যৌবনও বিগত হয়। কড়ি যে কেবল পার্থিব জগতের বিষয় ছিলো তা নয়। আধ্যাত্মিক জগতের মানুষদের কাছেও কড়ি নিয়ে ভাবনা কম ছিলো না। ভাবের মানুষ লালন সাঁইজি গান বেঁধেছেন কড়ি নিয়েও। লালনগীতি শুনতে শুনতে তাঁর সাথে আমরাও একাত্ম হয়ে যাই,
'দেখিলাম এ সংসার ভোজবাজি প্রকার
দেখিতে দেখিতে অমনি কে বা কোথা যায়।
মিছে এ ঘরবাড়ি মিছে ধন টাকাকড়ি
মিছে দৌড়াদৌড়ি করি কার মায়ায়।'
তথ্যসূত্র :
১. সাদিকুর রহমান, মুদ্রা দেখে যায় জানা, দৈনিক প্রথম আলো, ২২ ডিসেম্বর ২০১৭
২. এস এ এইচ ওয়ালিউল্লাহ, কড়ির সাতকাহন, দৈনিক সমকাল, ১১ মার্চ ২০২২
৩. প্রণব কুমার ভট্টাচার্য, ইতিহাসে মুদ্রার উপাদান : প্রসঙ্গ প্রাচীন বঙ্গদেশ
( একটি আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা)4. Bin Yang, ÒThe Rise and Fall of Cowrie Shells : The Asian StoryÓ in ÔJournal of World History, Vol. 22, No. 1
5. C.A. Gregory, ÒCowries and Conquest : Towards a Subalternate Quality Theory of Money' in ÔComparative Studies in Society and History, Vol. 38, No. 2
6. Mahdi Husain translated, ÔThe Reḥla of Ibn Battuta (India, Maldive Islands and Ceylon)Õ; Baroda: Oriental Institute, 2nd edition, 1976
7. James Heimann, 'Small Change and Ballast : Cowry Trade and Usage as An Example of Indian Ocean Economic History' in ÔSouth Asia : Journal of South Asian Studies, Volume 3, Issue 1
8. James Legge translated, ÔA Record of Buddhist Kingdoms : Being An Account by The Chinese Monk Fā-Hien of His Travels in India and Ceylon (A.D. 399-414) in Search of The Buddhist Books of DisciplineÕ; Oxford৯. জয়ন্ত ভট্টাচার্য, কড়ি কাহিনী, জেগে আছি
১০. Hogendorn and Marion Johnson (1986)| The Shell Money of the Slave Trade| Cambridge : Cambridge University Press|'
১১. মাগুরাতে 'কড়ি' দিয়ে কেনাকাটা- গল্প নয় সত্যি। মাগুরা নিউজ, ১৮ জুলাই ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ।