প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৭
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
(চব্বিশতম পর্ব)
চাঁদপুর জেলা সাহিত্য সম্মেলন ২০১৭
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব দোনাগাজীর জন্মজনপদ চাঁদপুরে সত্যিকার অর্থে সাহিত্য সম্মেলন বলতে যা বুঝায় তা আগে কখনও হয়নি। তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব আবদুস সবুর মন্ডল মহোদয়ের ঐকান্তিক ইচ্ছা ও চেষ্টায় দুহাজার সতের সালের মে মাসের ছয় তারিখে দিনব্যাপী আনন্দঘন উৎসবের আমেজে প্রথমবারের মতো সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। জেলা ব্র্যান্ডিং পরিকল্পনার আওতায় আয়োজিত এ সাহিত্য সম্মেলনের নাম ছিল ‘চাঁদপুর সাহিত্য সম্মেলন ২০১৭’। সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমি, চাঁদপুর যৌথভাবে দায়িত্ব পালন করে। জেলা প্রশাসন পৃষ্ঠপোষক হিসেবে অভিভাবকের ভূমিকা নেয়। পদাধিকারবলে সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুর-এর তৎকালীন মহাপরিচালক কাজী শাহাদাত সাহিত্য সম্মেলনের আহ্বায়ক এবং জেলা কালচারাল অফিসার আবু ছালেহ মো. আব্দুল্লাহ্ তথা কবি সৌম্য সালেক সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ কমিটি তাদের প্রথম সভায় বসে কর্মসূচি নির্ধারণ করে। সম্মেলনে সেমিনার পর্বে দুটো প্রবন্ধ উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একটি কবিতার ওপর আর অন্যটি কথাসাহিত্যের ওপর। কথাসাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধটি লেখা ও উপস্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয় জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারকে। তিনি অবশ্য প্রবন্ধটি ই-মেইলে পাঠিয়ে দেন, নিজে সশরীরে সম্মেলনে আসেননি। তার হয়ে প্রবন্ধটির চুম্বক অংশ পাঠ করেন আবৃত্তিকার ও ব্যাংক কর্মকর্তা সামীম আহমেদ খান। তাঁর প্রবন্ধের বিষয় ছিল 'বাংলাদেশের ছোটগল্প'। যেহেতু প্রাবন্ধিক সরাসরি আসেননি, সেহেতু এর প্রতি মনোযোগ অনেকটাই হ্রাস পায়। তবে পঠিত প্রবন্ধের ওপর বেশ চিত্তাকর্ষক ও নান্দনিক আলোচনা করেন বরেণ্য কথাশিল্পী হরিশংকর জলদাস। তাঁর আলোচনায় মুগ্ধ হয়ে থাকে পূর্ণ মিলনায়তন। সম্মেলনে কবিতার ওপরে প্রবন্ধ রচনা ও উপস্থাপনের জন্যে সর্বসম্মতিক্রমে নির্বাচন করা হয় অধ্যাপক মনোহর আলীকে, যিনি বাংলা বিষয়ে দীর্ঘকাল ধরে অধ্যাপনা করেছেন এবং চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন বেশ কয়েক বছর আগেই। কিন্তু তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন তাঁর বয়স ও সময় বিবেচনায়। যেদিন প্রথম প্রস্তুতি সভা হয়, সেদিন বিকেলে আমি ফরিদগঞ্জ যাই প্রবীণ হিতৈষী সংঘের পক্ষে চিকিৎসা ক্যাম্পে অংশগ্রহণ করতে। মনোহর আলী স্যার নাকচ করে দেওয়ায় বিকল্প হিসেবে কমিটি আমার নাম নির্ধারণ করে। আমি ফরিদগঞ্জ থেকে ফেরার পথে এ বিষয়ে অবহিত হই। দুয়েকজন তরুণ লেখক ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার মিলে তাদের পরিচিত বলয়ের কবি ও সাহিত্যিকদের আমন্ত্রণের দায়িত্ব নেন। আমন্ত্রণকারীরা তরুণ ছিলেন বিধায় আমন্ত্রিত কবিদের অধিকাংশই ছিলেন তরুণ।
এ সম্মেলনের কর্মযজ্ঞে আমি কোনো নীতি নির্ধারণী কমিটিতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলাম না। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ যখন যা করতে বলেছিলেন তখন তা সাধ্যমত করার চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলা কবিতা বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার দায়িত্ব দিয়ে সৌম্য সালেক চিন্তায় ছিলেন, আদৌ পারি কি না। কারণ বিষয়টি সত্যিকার অর্থেই বেশ শ্রমসাধ্য ছিল। বাংলা কবিতা বিষয়ে পঠিত প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন কবি আমিনুল ইসলাম, যিনি তখন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বেশ নির্মমভাবে প্রবন্ধের ওপর আলোচনা করেন। যদিও নিয়ম থাকে যে, প্রাবন্ধিক উত্থাপিত প্রশ্নের জবাবে উত্তর দিতে দ্বিতীয়বার সুযোগ পান, কিন্তু সেদিন প্রাবন্ধিক হিসেবে আমি আর সুযোগ পাইনি। তবে আমার হয়ে কিছুটা উত্তর সেদিন হরিশংকর জলদাস দিয়েছিলেন তাঁর বক্তব্যে।
প্রথম চাঁদপুর সাহিত্য সম্মেলন ২০১৭-এর স্লোগান নির্ধারিত হয় 'সৃজনে মননে সাহিত্য' যার উদ্গাতা সৌম্য সালেক। সম্মেলন উপলক্ষে সাহিত্য একাডেমী, চাঁদপুরের পক্ষ থেকে 'উছল' নামক ছোট কাগজের একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সম্মেলনে পঠিত প্রবন্ধ দুটি ঐ স্মারক প্রকাশনায় পত্রস্থ হয়। আমার ওপর আরেকটি গুরু দায়িত্ব অর্পিত হয়। তা হলো সম্মেলন উপলক্ষে একটি ক্রোড়পত্র সম্পাদনা করা। সাহিত্য সম্মেলনে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা হতে মোট পঁয়ত্রিশজন কবি-সাহিত্যিকসহ চাঁদপুরের স্থানীয় সাহিত্যপ্রেমীরা অংশ নেয়। বিশিষ্ট শিশু সংগঠক ও নাট্যজন শহীদ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি শপথ চত্বর পরিক্রমা করে শিল্পকলা একাডেমির প্রবেশপথে এসে সমাপ্ত হয়। মঙ্গলদীপ প্রজ্বালিত করে সম্মেলন উদ্বোধন করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রকর, ছবির কবি হাশেম খান। উদ্বোধনী সংগীতে রবীন্দ্রনাথের সুরের সাথে সাথে মঙ্গলদীপের শিখা পরিবেশকে একদিকে যেমন উৎসবমুখর করে তোলে, তেমনি পবিত্রতায় ভরিয়ে তোলে শিল্পকলা চত্বর। অনুষ্ঠানের শুরুতেই দশ মিনিটের একটা ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়, যাতে বরেণ্য অতিথিবর্গকে স্বাগত জানিয়ে চাঁদপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সংক্ষিপ্তভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়। স্লাইড তৈরিতে উজ্জ্বলের পারদর্শিতার কারণে আমি ধারাবর্ণনা দিয়ে কোনোমতে উৎরে যাই। আমন্ত্রিত অতিথিবর্গের পাশাপাশি প্রবন্ধের উপস্থাপক হিসেবে আমার গলাতেও একটা উত্তরীয় জুটে যায়। দৈনিক চাঁদপুর প্রতিদিনের সম্পাদক ইকবাল হোসেন পাটোয়ারী ভাই এবং অধ্যক্ষ জালাল চৌধুরী পরম মমতা ও স্নেহে আমাকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন। সম্মেলনের স্মারক প্রকাশনা 'উছল'-এর মোড়ক উন্মোচনের পাশাপাশি জেলা ব্র্যান্ডিংকে তুলে ধরে রচিত আমার ছড়াগ্রন্থ ‘ইলিশের বাড়ি'রও মোড়ক উন্মোচন করা হয়। উদ্বোধক হাশেম খান আমার ছড়াগ্রন্থটি হাতে নিয়ে প্রসন্নতার হাসি দেন। মোড়ক উন্মোচন পর্বটি অতি দ্রুততায় সম্পন্ন করায় কেন জানি মনে অতৃপ্তি তৈরি হয়। অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক জনাব আবদুস সবুর মন্ডল আয়োজক হিসেবে সভাপতিত্ব করেন এবং জনাব কাজী শাহাদাত স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. শামসুজ্জামান খান সন্তোষ প্রকাশ করে চাঁদপুরকে বাংলা সাহিত্যের রাজধানীরূপে গড়ে তোলার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি পরবর্তীতে বাংলা একাডেমির পৃষ্ঠপোষকতায় দুবছর পরপর দুদিনব্যাপী চাঁদপুর জেলা সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
আমার লিখিত ও পঠিত প্রবন্ধে বাংলা কবিতাকে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়কাল থেকে পর্যালোচনা করে তার বাঁক বদলের প্রবণতাগুলো তুলে ধরার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি এবং দশকভিত্তিক কবিদের কাব্যচর্চার ধারাগুলো তুলে ধরেছি। হয়তো সব কবির নাম আনা সম্ভব হয়নি, হয়তোবা কবিদের ধারাক্রম আগে পরে হয়ে গেছে। তবুও স্বল্প সময়ে বড় ক্যানভাসের পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধোত্তর পালাবদলের হাওয়া নিয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা একটা দুঃসাহসের কর্মই বটে। তবে সেদিন কবিতার আলোচক হিসেবে আমিনুল ইসলামের উপস্থিতিতে কবির সুঘ্রাণের চেয়ে আমলার ঝাঁজের প্রবণতা অধিক অনুভব করা গেছে। কথাসাহিত্যের আলোচনায় সেই তুলনায় হরিশংকর জলদাস অধিক প্রাণবন্ত ও শ্রোতা-আদৃত ছিলেন।
উদ্বোধনী ও সেমিনার পর্বের পরে কবিকণ্ঠে কবিতা পাঠ ছিল মূলত সাহিত্যের চেয়ে সম্মিলনের সংরাগমাখা। সাধারণ শ্রোতাহীন আসরে লিখিয়ের লেখা শুনেছে কেবল লিখিয়েরাই। কয়েকটি পর্বে ভাগ করে কবিদের কবিতা পাঠের আসরকে পূর্ণতা দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যায় বিশিষ্ট আবৃত্তিকার কাজী মাহতাব সুমনের নির্দেশনায় তাঁর দলের বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে চমৎকার করে তাঁরা মহাভারতের কাহিনীকে শ্রুতিনাটকের আঙ্গিকে পরিবেশন করেন। এতো প্রাণবন্ত ছিলো সে পরিবেশনা, মনে হয়েছিলো এ যেন কুরুক্ষেত্রের লাইট এন্ড সাউন্ড। সম্মেলনে নিবন্ধিত অংশগ্রহণকারী কবিদের স্যুভেনির হিসেবে একটা করে পাটের ব্যাগ ও একটা করে চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনা ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’ উপহার দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় একটি হোটেলে দুপুরের আহারের ব্যবস্থা করা হয় এবং যারা রাতে ছিলেন তাদেরকে সার্কিট হাউজে আপ্যায়ন করা হয়। কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস পরেরদিন সকালে মেঘনা ভ্রমণে বের হন এবং ইলিশ নিয়ে তাঁর পরিকল্পিত উপন্যাসের মাল-মশলা সংগ্রহে তৎপর হন। তিনি নিজ চোখে ইলিশ জেলেদের ইলিশ ধরার দৃশ্য অবলোকন করেন। যদিও নিজেই কৈশোর-তারুণ্যে বাবাকে মাছ আহরণে সহযোগিতা করতেন।
সবার সার্বিক সহযোগিতায় এবং জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথম চাঁদপুর জেলা সাহিত্য সম্মেলন ২০১৭ সর্বাঙ্গীণ সফল হয়। এ সম্মেলনকে সফল করতে একদিকে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন, চাঁদপুর পৌরসভা যেমন তৎপর ছিলো তেমনি অন্যদিকে সাহিত্য একাডেমী ও জেলা শিল্পকলা একাডেমীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাবৃন্দ নিজেদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা প্রয়োগ করেছেন। চাঁদপুরের তরুণ সাহিত্যিকদের উদ্যোগও ছিলো প্রশংসনীয়। অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে শিল্পকলার বারান্দায় স্থানীয় লেখকদের বইয়ের প্রদর্শনীও ছিলো উল্লেখযোগ্য।
সাহিত্য সম্মেলনের একটা উল্লেখযোগ্য দিক ছিলো কার্ডে, ব্যানারে ও ফেস্টুনে কথাসাহিত্য বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপনকারীর নাম থাকলেও কবিতা বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপনকারীর নাম কোথাও ছিলো না। ফলে কারও কারও নজরে বিষয়টি প্রশ্নের উদ্রেক করে। এ কথা অস্বীকার করার কোনো জো নেই, এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে চাঁদপুরের বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের মধ্যে সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের হিড়িক তৈরি হয় এবং সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তনেরও উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়। একটা ভালো ও মহৎ আয়োজন যে আরও অনেক ভালো আয়োজনের পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়াতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো চাঁদপুর জেলা সাহিত্য সম্মেলন ২০১৭।