বুধবার, ০৮ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ১৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   ফরিদগঞ্জের লক্ষ্মীপুরে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় গুরুতর আহত ৩ : এলাকায় আতঙ্ক
  •   শিক্ষা খাতে নজিরবিহীন রদবদল: একযোগে চার বোর্ড চেয়ারম্যানকে ওএসডি
  •   মধ্যরাতের আতঙ্ক
  •   চীনা সেনাদের ভারতের অরুণাচলে অনুপ্রবেশ: বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে
  •   আপনার টাকা কোথায় গেল?

প্রকাশ : ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:৩৩

বারোয়ারি বারো

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
বারোয়ারি বারো

বারো নিয়ে বাড়াবাড়ি বাঙালি জীবনে কম নয়। এতো বেশি বাড়াবাড়ির কারণে বারো যেন তার নিজস্বতা আর বজায় রাখতে পারেনি। হয়ে গেছে বারোয়ারি। বারো নিয়ে ভাবতে গেলে মনে পড়ে যায় শৈশবের বুদ্ধি মাপার সেই ধাঁধাটি। স্কুল ফেরত ক্ষুধার্ত বালকটিকে মা জিজ্ঞেস করলেন, ভাত দিবেন কি না। বাবার জিজ্ঞাসা গণিতের পরীক্ষায় ছেলে কতো নম্বর পেলো। ধাঁধাঁ ছিলো, এক শব্দে উভয়ের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার উপায় কী? অনেকে অনেক কিছু ভেবে নিলেও শেষমেষ বারোর কাছে হাত পেতেই উত্তরটা মিলাতে হতো। ছেলে বারো বলতেই মা বুঝে নিলেন ভাত বাড়তে হবে এবং বাবা বুঝে নিলেন, ছেলে গণিতে বারো নম্বর পেয়েছে। গণিতে বারো পাওয়ায় বাবার মেজাজ হয়ে গেলো ফর্টি নাইন। মা ও ছেলে বুঝতে পারলেন, আজ রাশি খারাপ। রাশি বলতে জ্যোতিষবিদরা যে বারোটি রাশির কথা বলে গেছেন তার কথা বলছি। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, কুম্ভ, মকর ও মীন এই বারোটি রাশির পাকচক্রে পড়ে ঘুরছে মানুষ। মানুষের এই দুঃখের কথা বলে গেছেন কুমার সিদ্ধার্থ বোধি লাভের পর। বুদ্ধ ভবচক্রের দ্বাদশ নিদানের কথা বলেছেন, যেখানে জন্ম দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মৃত্যু দুঃখ। দুঃখ হলো অপ্রিয় সংয়োগ, দুঃখ হলো প্রিয় বিচ্ছেদ। ভবচক্র নামের একটি দুঃখ-চক্রের রিমের চারপাশে বারোটি নিদান বা অস্তিত্বকে আন্তঃসম্পর্কিত রূপক বা প্রতীকের সাহায্যে দেখানো হয়েছে, যাতে ১. অবিদ্যা বা অজ্ঞতা ২. সংস্কার বা কর্ম ৩. চেতনা বা বিজ্ঞান ৫. নামরূপ বা শরীর ও মন ৬. ষড়ায়তন বা ইন্দ্রিয় ৭. স্পর্শ বা যোগাযোগ ৭. বেদনা বা অনুভূতি ৮. তৃষ্ণা বা আসব্ ৯. উপাদান বা বিষয় ১০. ভব বা উৎপত্তি হওয়া ১১. জাতি বা জন্ম এবং ১২. জরা বা বার্ধক্য ও মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আবার বারো রাশির নয় গ্রহের একটি হলো গ্রহরাজ বৃহস্পতি। প্রতি বারো বছরে বৃহস্পতি একবার নিজ কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে ঘুরে আসে। পাশাপাশি একথাও বলতে হয়, বৃহস্পতির উপগ্রহের সংখ্যাও কিন্তু বারোটি। বারো ভূঁইয়াদের দেশে বারো আউলিয়ার শহর চট্টগ্রাম যেখানে ষোলশহর এবং হালিশহর নামের দুটো এলাকার বিয়োগফল গাণিতিক মতে বারো শহর হলেও বাস্তবে তা হওয়ার জো নেই। যে বারো ভূঁইয়া মোগল আমলে দিল্লির সম্রাটদের সাথে মাথা উঁচু করে চলতেন এবং বাংলার সম্মান সমুন্নত রেখেছিলেন তাঁরা হলেন : ঈসা খাঁ, মাসুম খাঁ কাবুলী, মুসা খাঁ, ফজল গাজী, বাহাদুর গাজী, খাজা উসমান খাঁ লোহানী, বায়েজিদ কররানী, প্রতাপাদিত্য, বীর হাম্বীর, চাঁদ রায়, কেদার রায় ও মুকুন্দরাম রায়। আবার সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি গ্রামে যে বারো আউলিয়ার মাজার আছে, তাঁরা হলেন : ১. হযরত সুলতান বায়োজিদ বোস্তামী (রহ.), ২. হযরত শাইখ ফরিদ (রহ.), ৩. হযরত বদর শাহ (রহ.), ৪. হযরত কাতাল শাহ (রহ.), ৫. হযরত শাহ মোহসেন আউলিয়া (রহ.), ৬. হযরত সাহপির (রহ.), ৭. হযরত শাহ ওমর (রহ.), ৮. হযরত শাহ বাদল (রহ.), ৯. হযরত শাহচান্দ আউলিয়া (রহ.), ১০. হযরত শাহ জায়েদ (রহ.), ১১. হযরত শাহ আমানত (রহ.) এবং ১২. হযরত শাহ মাস্তান (রহ.)। বারো আউলিয়ার শহরে ঢুকতে গেলে রেল যাত্রায় মীরশ্বরাই এলে পার হতে হয় বারোতাকিয়া নামে একটা ছোট্ট স্টেশন।

আমাদের জীবনে সচেতন ও পরিশ্রমী না হলে যে কোনো সময় যে কারো বারোটা বেজে যেতে পারে। এই বারোটা বাজা অর্থ গোল্লায় যাওয়া বা নষ্ট হয়ে যাওয়া কিংবা সময় শেষ হয়ে আসা। এমনিতেই ঘড়িতে এক হতে বারো সংখ্যা লিপিবদ্ধ থাকে এবং চব্বিশ ঘন্টায় ঘণ্টার কাঁটা দুবার বারোটা অতিক্রম করে। দিনের বেলায় বারোটা বেজে গেলে তখনকার দিনে ধরে নেওয়া হতো বেলা শেষ। অর্থাৎ সূর্যোদয়ের আগে আগে ঘুম হতে জাগা মানুষ বারোটার আগেই নিজেদের কাজকর্ম ও রান্নাবান্না সেরে প্রস্তুত থাকতো মধ্যাহ্নের আহার গ্রহণে। এই বারোটা ছিলো একটা বেলা পরিমাপক সময়। এটা বেজে গেলেই মনে হতো সকাল বেলা শেষ, পড়ন্ত বেলার শুরু।

বাংলা লোকসাহিত্য এবং লোকসংস্কৃতিতে আমরা বারো ভূতের সন্ধান পাই। এরা হলো : রাক্ষস, খোক্ষস, পেত্নী (অবিবাহিতা নারী), শাকচুন্নী (বিবাহিতা নারী), মামদো ভূত ( পুরানো কবরস্থানের ভূত), স্কন্ধকাটা ( মাথা কাটা), ব্রহ্মদৈত্য ( ব্রাহ্মণের আত্মাজাত), যক্ষ ( লুকায়িত সম্পদের রক্ষক), পিশাচ ( মানুষের হবহু নকলকারী), নিশি (প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মা), আলেয়া ( মাছ ধরতে গিয়ে পথ ভুলে মৃত জেলেদের আত্মা), মেছো ভূত ( বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করে, মাছের গন্ধ পেলে ছুটে যায়)। এই বারো ভূতকে নিয়েই বাংলা সাহিত্যে কয়েকটি বাগধারা ও প্রবাদ-প্রবচন প্রচলিত হয়েছে। আমরা অপচয়ের বড়ো ঘটনাকে বারো ভূতের শ্রাদ্ধ বা বারো ভূতে লুটেপুটে খাওয়ার মাধ্যমে প্রকাশ করি।

আমাদের সমাজে নারী চরিত্রের প্রতি মানুষ যেন অণুবীক্ষণ যন্ত্র তাক করে রাখে। তাই তাদের চরিত্রে কলঙ্ক লেপনার্থে বলে থাকে বারো ভাতারি। ভাতার মানে হলো যে ভাতের যোগান দেয়, তথা স্বামী। কিন্তু যে সকল নারীর একাধিক প্রণয় থাকে কিংবা যাদের রঙ্গলীলায় সমাজ কলুষিত হয়, তাদেরকে বলা হয় বারো ভাতারি। এর পাশাপাশি আরও একটা কথা আছে, বারো বৈতাল নামে। আরবী বতাল মানে হলো দুরাচার বা অনাচার। এ থেকেই বাংলা শব্দের উৎপত্তি হলো বৈতাল। অর্থাৎ পাপিষ্ঠা, দুশ্চরিত্রা। বারো বৈতাল মানে হলো যে নারী বহুগামী, পতিতা। অনেকক্ষেত্রে কলঙ্ক রটাতেই বারো বৈতাল গাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তেমনি বারো ঘাটের পানি খাওয়ার অর্থও অনেকটা এমনই। যে নারী কোনো একজন পুরুষে স্থির না থেকে জনে জনে প্রেমের সুধা বিলায় সে তো বারো ঘাটের পানি খাওয়া নারী বটেই। আবার যে নারী পাড়া বেড়ানি, যে এ ঘর ও ঘর করে বেড়ায়, এর কথা ও কে এবং ওর কথা এ কে বলে বেড়ায় তাকে বলা হয় বারো হাটের বাছ কলই। এরা অনেকটাই পাড়ার সিএনএন-বিবিসি। এ ঘরের গোপন কথা ও ঘরে এবং ও ঘরের গোপন কথা এ ঘরে করাই এদের কাজ। নারীদের লজ্জার আভরণরূপে শাড়ি বাঙালি জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বস্ত্র বয়নের সূচনা লগ্নে অধোবাস বা নিম্নাঙ্গের বস্ত্র, সেওটা বা মাথা ঢাকার বস্ত্র এবং ঊর্ধাঙ্গ ঢাকার জন্যে ব্যবহৃত হতো আধনাই। আধুনিককালে একটা বারোহাত দৈর্ঘ্যের শাড়ি দিয়েই আস্ত নারীদেহকে আবৃত করে রাখা যায়। এই বারো হাত শাড়ি নিয়েই রচিত হয়েছে হায়দারের গানের কথা, 'পাঁচ ফুটের শরীরে বারো হাত শাড়ি।' এর পাশাপাশি আরো একটা প্রবাদ বা প্রবচন আমরা পাই যা হলো, বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি। অর্থাৎ সাধ্যের চেয়ে আয়োজন বড়। কিংবা যে যা ধারণযোগ্য নয় তার চেয়ে বেশি তার প্রদর্শন করা। এটি একটি নেতিবাচক প্রকাশ নিঃসন্দেহে।

যাদের কথার ঠিক নেই, সকালে একরকম আর বিকেলে একরকম বলে তাদের কথাকে বারোরকম কথা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় একে বলে বারো বঅইত্যা কথা। অর্থাৎ চুদুর বুদুর করা। বারো রকম কথার পাশাপাশি আমরা বারো রকম মানুষও পাই সমাজে। পেশা, আবেগ ও চরিত্রের ধরন অনুযায়ী মানুষের এই বিভিন্নতাই আমাদের জীবনকে বর্ণিল করে তুলেছে। বারো রকম মানুষ নিয়ে কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের একটি ধারাবাহিক নাটকও প্রচারিত হয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে। গণনার কাজে সংখ্যাবাচক বিশেষণরূপে বারোকে আমরা ব্যবহৃত হতে দেখি। যেমন : কোনো জিনিসের বারোটিতে এক ডজন এবং বারো ডজনে এক গ্রোস। তেমনি দৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রেও বারো ইঞ্চিতে গণনা করা হয় এক ফুট। আবার বারো মাসে একবছর যেমন, তেমনি বারো বছরে হয় একযুগ। দিন যদি হয় বারো ঘন্টার, তেমনি রাতকেও আমরা গড়পড়তায় বারো ঘন্টার হিসেবে ধরি। যদিও সবসময় বারো ঘণ্টা দিন কিংবা বারো ঘণ্টা রাত থাকে না। ইংরেজি বারো মাসের নাম গ্রীক ও রোমান দেবদেবী থেকে এলেও বাংলা বারো মাসের নাম এসেছে বারোটি নক্ষত্র থেকে। নক্ষত্রগুলো হলো : বিশাখা, জ্যেষ্ঠা, উত্তরাষাঢ়া, শ্রবণা, পূর্বভাদ্রপদ, অশ্বিনী, কৃত্তিকা, মৃগশিরা, পুষ্যা, উত্তরফাল্গুনী এবং চিত্রা।

উৎসবপ্রবণ সনাতনী সম্প্রদায়ের বারো মাসে তের পার্বনের সমাহার। এই পর্বগুলো হলো :

১। বৈশাখে নববর্ষ (১), ২। জ্যৈষ্ঠে জামাই ষষ্ঠী (২), ৩। আষাঢ়ে রথযাত্রা (৩), ৪। শ্রাবণে মনসা পূজা (৪), ৫। ভাদ্রে জন্মাষ্টমী (৫) ও বিশ্বকর্মা পূজা (৬),

৬। আশ্বিনে দুর্গা পূজা (৭), ৭। কার্তিকে ভাই ফোঁটা (৮), ৮। অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব (৯), ৯। পৌষে পৌষ সংক্রান্তি (১০),

১০। মাঘে সরস্বতী পূজা (১১), ১১। ফাল্গুনে দোল উৎসব (১২) এবং

১২। চৈত্রে চড়ক পূজা (১৩)।

বারো বছরে মানবশিশু যেমন বালকত্ব ছেড়ে সাবালকত্ব অর্জন করে কৈশোরে পদার্পণ করে, তেমনি বারো ক্লাস পাস করে তবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পে আমরা বারো বছরের ফটিককে পাই। রবীন্দ্রনাথ বারো বছর বয়সী ফটিকের সূত্র ধরে এ বয়সী ছেলেদের একটা দারুণ সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন। তারা ভাইয়ে ভাইয়ে বা ভাইয়ে-বোনে কিছু খুনসুঁটি করতে গেলে মায়ে বকে আর ছোট নেই বলে। আবার ঝুঁকিপূর্ণ আরও কিছু করতে গেলে বাবায় বলে, এখনও বড় হওনি। নিজ উদ্যোগে বড়ো কিছু করতে গেলে সমাজ বলে ইঁচড়ে পাকা। কিছু কিছু ঔষধ আছে বারো ঘন্টা পর পর সেবন করতে হয়। আবার কিছু কিছু ফুল আছে বারো বছর পরে ফোটে। কিছু কিছু ফল সারা বছর ফলে। এ ধরনের ফলকে বারো মাইস্যা বা বারোমাসী বলা হয়। আবার কিছু সব্জি বা মসলাও বারো মাস ফলে। এরকম একটা সব্জি বা মসলা হলো বারো মাইস্যা মরিচ।

দুহাজার বারো সালের বারোতম মাসের বারো তারিখকে অনেকেই মনে রাখবেন এক বিরল দিন হিসেবে। বিশ্বসেরা বাংলাদেশের ক্রিকেট অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানও বিয়ে করেছেন এই বারো-বারো-বারো তারিখে। রামায়ণে যেমন মন্থরার কুপরামর্শে রানি কৈকেয়ী রামের বারো বছর বনবাস চেয়েছিলেন, তেমনি রূপবান নামের লোককাহিনীতেও বারো দিনের রাজকুমারকে বাঁচাতে বারো বছরের রূপবানের সাথে বিয়ে দিতে হয়।

চিরদিন কারো সমান যায় না। এ চিরন্তন সত্যকে চোখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতেই আমরা বলি, বাঘের বল বারো বছর। স্বপ্নে পাওয়া ঔষধ, তাবিজ-কবজ নিতে আজও লোকায়ত বাংলায় টিনের বাক্সে বারো টাকা হাদিয়া নেওয়ার কথা প্রচলিত আছে। বারো টাকার কথা আসাতে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং চাঁদপুরের গান্ধী নামে পরিচিত হরদয়াল গান্ধীর কথা মনে পড়ে যায়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঊনিশশো একুশ সালে জুলাই মাসের সতের তারিখ বন্ধু মুজফ্ফর আহমদসহ কুমিল্লা হতে চাঁদপুর আসেন কোলকাতা যাওয়ার জন্যে। কিন্তু চা বাগানের কুলিদের ঘটনায় ধর্মঘট চলাকালে তিনি ভাড়া সংকটে ভোগেন, যা কোলকাতা-কুমিল্লার আফজাল-আশরাফ হয়ে চাঁদপুরের হরদয়াল নাগের কাছে এসে পৌঁছায়। তিনি কুলদা রায়ের মাধ্যমে ঠিক বারোটি টাকা কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিকট তখনকার ডাকবাংলোতে পাঠান।

বাংলাদেশের সাবেক সামরিক শাসক এরশাদের আমলে পুলিশ আন্দোলনকারী ছাত্রদের রুদ্ররূপে নির্যাতন করতো। ছাত্ররা তখন পুলিশকে ঠেকানোর জন্যে স্লোগান বেঁধেছিলো, পুলিশ তুমি যতই মারো তোমার বেতন চারশো বারো। পুলিশ রেশন পেলেও এ সময় পুলিশের কনস্টেবলদের বেতন ছিলো মাত্র চারশো বারো টাকা। মানবদেহের কথা বলতে গেলেই বারো জোড়া পঞ্জরাস্থি ও বারো জোড়া ক্রেনিয়াল নার্ভ বা কেন্দ্রীয় স্নায়ুর কথা উল্লেখ করতে হয়। মানবদেহে এমনকি বক্ষদেশীয় কশেরুকার সংখ্যাও বারোটি। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যীশুর জন্মদিনকে বলা হয় বড়দিন বা ক্রিসমাস। পঁচিশে ডিসেম্বর ক্রিসমাস থেকে ছয় জানুয়ারি এপিফ্যানি বা বাপ্তিস্ম গ্রহণ পর্যন্ত মোট বারোদিনব্যাপী বড়দিনের উৎসব পালিত হয়। তাঁর বারোজন শিষ্য ছিলেন, যথাক্রমে : পিটার, জেমস, জন, অ্যান্ড্রু, ফিলিপ, জুডাস ইসকারিওট, ম্যাথু, টমাস, জেমস, বার্থোলোমিউ, জুডাস থাডিউস এবং সাইমন জেলোটস । খ্রিস্টধর্মের চর্চা হতে আমরা বারোটি বোতামের কথা জানতে পেরেছি। ষোলশো শতকের সূচনা দশকে বারোটি বোতামকে পবিত্র বলে বিবেচনা করা হতো। তাই অনেক ক্যাথলিক প্রতি রোববার গির্জায় বারোটি বোতামের পোশাক পরিধান করতেন। আবার মাতা মেরির মুকুটে শোভা পেতো বারোটি তারা, যা দ্বারা ইসরাইলের বারোটি উপজাতি সম্প্রদায়কে বোঝানো হতো।

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে সূর্যদেবের আছে বারো নাম। তাঁর নামগুলো হলো আদিত্য, অর্ক, ভানু, সাবিত্র, পূষণ, রবি, মার্তন্ড, মিত্র, ভাস্কর, প্রভাকর, কাঠিরবন এবং বিভাসবন । আবার রামভক্ত হনুমান তথা বজরং বলীরও আছে বারোটি নাম। যথা : হনুমান, অঞ্জনী সূত, বায়ুপুত্র, মহাবল, রামেষ্ঠ, ফাল্গুনসখা, পিঙ্গাক্ষ, অমিত বিক্রম, উদধিক্রমণ, সীতা শোক বিনাশন, লক্ষ্মণ প্রাণদাতা এবং দশগ্রীব দর্পহা। সূর্যের পরে আসে চাঁদ। চাঁদে এ পর্যন্ত পদচারণা করেছেন মোট বারোজন। এরা হলেন : ১. নিল আর্মস্ট্রং ২. এডউইন অলড্রিন ৩. পিট কনরাড ৪. অ্যালান বিন ৫. অ্যালান শেপার্ড ৬. এডগার মিচেল ৭. ডেভিড স্কট ৮. জেমস আরউইন ৯. জন ইয়ং (মহাকাশচারী) ১০. চার্লস ডিউক ১১. জিন সার্নান এবং ১২. হ্যারিসন স্মিথ।

ডোডেকাগন হলো বারোভুজ বিশিষ্ট এক বহুভুজ। আবার ডোডেকাপলিস হলো গ্রীসের বারোটা শহরের একটা কনফেডারেশন।

বারো ঘর এক উঠোন শিরোনামে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর লেখা একটা জীবনঘনিষ্ঠ উপন্যাসের কথা আমরা জানি, যেখানে বস্তির বারো ঘরের মানুষের জন্যে বরাদ্দ মাত্র একটা উঠোন। বারো নিয়ে বিদুষী খনাও বলে গেছেন অনেক কিছু।

খনা বলেছেন, দাতার নারিকেল, বখিলের বাঁশ, কমে না বাড়ে বারো মাস। অর্থাৎ নারিকেল দান করলে বা মাঝে মাঝে পেড়ে খেলে নারিকেলের ফলন ভালো হয়। তেমনি কৃপণের বাঁশ অর্থাৎ যে কখনও বাঁশ কাটে না, তার বাঁশঝাড় সারা বছর বা বারো মাসই আকারে বাড়ে। আবার খনার মতে তাল গাছ লাগালে ফলন হতে বারো বছর লাগে। তবে তার আগে নিশ্চিত করতে হবে যাতে ঐ তাল গরুতে খেয়ে না ফেলে। আমাদের দেহের সুস্থতার জন্যে খনা পরামর্শ দিয়েছেন, বারোমাসে বারো ফল, না খেলে যায় রসাতল। অর্থাৎ দরিদ্র গ্রামীণ মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকল্পে বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন ফল নিয়মিত খাওয়ার কথা তিনি বলেছেন।

'বারো' বাঙালি জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। একদিকে যেমন পাঠ্যে, তেমনি অন্যদিকে পরিমাপেও। ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন ও বিজ্ঞানে বারো এক নান্দনিক স্বরূপ নির্মাণ করেছে। বারোকে জানতে গেলে জীবনকে অনেকটুকুই জানা হয়ে যায়। তাই বারো বারোয়ারি রূপে কালজয়ী হয়ে আছে মানব সভ্যতায়।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়