প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৭
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
(তেইশতম পর্ব)
জেলা ব্র্যান্ডিং বিষয়টি মুখ্যত একটা বিমূর্ত ধারণা, যা একটি সুনির্দিষ্ট পণ্যকে কেন্দ্র করে একটা জেলার সামগ্রিক উন্নয়নকে বাস্তবায়নযোগ্য করে তোলে। যে কোনো মহৎ কর্মযজ্ঞকে দালিলিকভাবে উপস্থাপন করতে হলে একটা প্রকাশনা জরুরি। উপযুক্ত প্রকাশনা না হলে সকল উদ্যোগ কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে পারে। তা ছাড়া দূরের কারও কাছে জেলা ব্র্যান্ডিং বিষয়কে সহজে দৃশ্যমান করে তুলতেও একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রকাশনা অপরিহার্য। সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই জেলা ব্র্যান্ডিং কমিটির অতিরিক্ত একটা কমিটি করতে হলো, যার নাম দেওয়া হলো জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনা কমিটি। গুরুত্ব বিচারে এটা উপ-কমিটি ছিলো না, এটা ছিলো স্বতন্ত্র একটা কমিটি। জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের মূল কমিটি ছিলো অনেক বড়ো। এতে সর্বস্তরের মানুষের অন্তর্ভুক্তি ছিলো। তবে আমি অন্তর্ভুক্ত ছিলাম না। জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনা কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ, চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ, পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ও সাহিত্য একাডেমী,চাঁদপুরের তৎকালীন মহাপরিচালক জনাব কাজী শাহাদাত, চাঁদপুর সরকারি কলেজের ইংরেজি বিভাগের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা। কম্পিউটার গ্রাফিক্স ও কম্পোজের জন্যে ছিলেন উজ্জ্বল হোসাইন, আলোকচিত্রী হিসেবে ছিলেন সাইফুল আজম। এ কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন মান্যবর জেলা প্রশাসক, চাঁদপুর। আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যক্ষ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ ড. এএসএম দেলোয়ার হোসেন এবং সদস্য সচিব ছিলেন কাজী শাহাদাত।
এনডিসির সহায়তায় জেলা প্রশাসনের গাড়ি নিয়ে জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনা কমিটি বিভিন্ন উপজেলায় ঘুরে ঘুরে তথ্য-উপাত্ত ও ছবি তথা আলোকচিত্র সংগ্রহ করলেন। সংগৃহীত তথ্যগুলোর যাচাই-বাছাই ও গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণ করে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছে উপস্থাপন করলেন। জেলা প্রশাসক মহোদয় সমুদয় তথ্য-উপাত্ত দেখার পরে তার আলোকে গ্রন্থটি রচনা ও দ্বিভাষিকীকরণের নিমিত্তে উক্ত কমিটিতে আমাকে অন্তর্ভুক্তির জন্যে পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে কমিটির সবাই একমত হন। সেই মোতাবেক জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনাকে সমৃদ্ধকরণের স্বার্থে একজন দরকারি ব্যক্তি হিসেবে আমি অন্তর্ভুক্ত হলাম। আমাদের এই প্রকাশনা কমিটি বিভিন্ন দফায় একাধিক স্থানে একাধিকবার একসাথে বসে সভা করেছি, ভুক্তিগুলো রচনা করেছি এবং সেগুলোর যথার্থতা নিয়ে কোনো সন্দেহ তৈরি হলে তা সবাই মিলে সমাধান করেছি। কখনো চাঁদপুর সরকারি কলেজে, কখনো চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজে কিংবা কখনো পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের ভেতরে আমরা প্রকাশনা কমিটি সমবেত হয়েছি। বিকেলে চারটা কিংবা পাঁচটার পর থেকে কখনো রাত বারোটা আর কখনও ভোরের সূর্য ওঠার আগে আগে, ফজরের আজান পর্যন্ত আমরা কাজ করেছি। রাতে বাসায় ঢুকেছি কখনও দেওয়াল টপকে কিংবা কখনও অপেক্ষা করেছি ভোর হওয়ার। তারপর বাসায় ঢুকেছি কারও ঘুমে ব্যাঘাত না ঘটিয়ে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে চা পানে যেমন আপ্যায়িত হয়েছি, তেমনি খিচুড়ি-মাংসেরও সদগতি করেছি রাতের খাবারে।
আমাদের হাতে সময় বেশি ছিলো না। আমরা বসেছি দুহাজার ষোল সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে। বইটির ডামি বানানোর সময় ছিলো দুহাজার সতের সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে আমাদের বইটি প্রেসে পাঠাতে হতো। কাজেই সময়ের সাথে আমাদের পাল্লা দিতে হচ্ছিলো সমানতালে। সবাই আমরা কর্মজীবী। সকালে কারও ক্লাস নিতে হতো, কারও প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হতো। আমার রোগী দেখে দানাপানির ব্যবস্থা করতে হতো। শাহাদাত ভাই দিনে চাপহীন থাকলেও সন্ধ্যার পর থেকে ছিলো তাঁর কাজের চাপ। তাই চাইলেও আমরা প্রতিদিন বসতে পারিনি। এ কমিটিতে পরে আরও দুজনকে যোগ করা হয়। একজন মুহম্মদ ফরিদ হাসান এবং আরেকজন রাসেল হাসান। কিছু লেখা আমি বলতাম আর পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মহোদয় তাঁর ল্যাপটপে টাইপ করে অন্তর্ভুক্ত করতেন। কিছু লেখা আমি বাসায় বসে, চেম্বারে রোগী দেখার ফাঁকে স্যামসাং মোবাইল ফোনের নোটে টাইপ করে উজ্জ্বলকে পাঠাতাম। উজ্জ্বল তা ল্যাপটপে বইয়ের পাণ্ডুলিপিতে নির্দিষ্ট জায়গায় সেট করে নিতো। কিছু কিছু ইংরেজি করেছেন গোলাম মোস্তফা সাহেব আর কিছু কিছু ইংরেজি করেছি আমি।
বইয়ের কিছু ছবি কাজী শাহাদাত ভাইয়ের ভাগিনার তোলা ছিলো। বিশেষ করে মেঘনার ছবি। আমি কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরে প্রথম দুটো সভায় জড়তাক্রান্ত ছিলাম। কারণ, আমি শুরু থেকে না থাকায় প্রকাশনা বিষয়ে সিদ্ধান্তগুলো সব জানা হয়নি। দ্বিতীয় মিটিংয়ের পর, মোটামুটি যখন আমার লেখার কাজে গতি আসলো, তখন একদিন জেলা প্রশাসক মহোদয় আমাকে তাঁর কার্যালয়ে ডেকে ইলিশ বিষয়ক ছড়া প্রকাশনায় অন্তর্ভুক্ত করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি কিছু দরকারি পরামর্শ আমাকে দিলেন। যত বিষয়ই আসুক না কেন, তার সাথে ইলিশকে জুড়ে দিতে হবে। তাঁর এ পরামর্শ খুব কাজে দিয়েছিলো। ফলে ইলিশ ও চাঁদপুর বিষয়ক পঁচিশটার মতো ছড়া আমি লিখে জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনার অন্তর্ভুক্ত করি। এতে ইলিশকে চাঁদপুরের মেয়ে হিসেবে আমি আখ্যান তৈরি করেছি।
বাঙালি সংস্কৃতিতে সন্তানবতী বিবাহিতা নারী প্রসব ও প্রসবোত্তর ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে বাপের বাড়ি আসে। ইলিশও সেরকম। জেলা প্রশাসক যেহেতু চাঁদপুরের প্রশাসনিক প্রধান, তাই তাঁকে ইলিশের বাবা কল্পনা করে ছড়া লিখি 'ইলিশের বাড়ি' শিরোনামে। পরবর্তীকালে চাঁদপুর জেলা ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যাল ২০১৭ উপলক্ষে উপহার হিসেবে পাটের যে ব্যাগ দেওয়া হয় তাতে একপাশে এই ছড়াটি ছাপিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে ছড়াকারের নাম দেওয়া হয়নি। সিদ্ধান্তটা সম্পূর্ণ জেলা প্রশাসক মহোদয়েরই ছিলো। কারণ তিনি চেয়েছিলেন, কোনোরূপ দ্বিমত না রেখেই জেলা ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যাল উদযাপন করতে। জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনায় মেঘনার চর, মেঘনায় জোছনা যাপন, হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড়ো মসজিদ, আট উপজেলা, রূপসা জমিদার বাড়ি, মুক্তিযুদ্ধের জাহাজ লোরাম, অঙ্গীকার, রক্তধারা, দীপ্ত বাংলা, চল্লিশ গ্রামে অগ্রিম ঈদ, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা, ভাসমান বেদে সম্প্রদায়, নতুন বাজার পুরান বাজার সংযোগকারী আউয়াল সেতু সবই ছড়ায় ছড়ায় স্থান পেয়েছে। একটি মজার বিষয় ছিলো, সাইফুল আজম তার ক্যামেরায় ডিসি বাংলোর গাছের আগায় বক এবং মেঘনার বুকে গাঙচিলের দুটো অসাধারণ ছবি তোলে। প্রকাশনা কমিটির সদস্যদের চাহিদায় এ দুটো ছবির বিষয় নিয়ে দুটো ছড়া লিখি এবং সেগুলো দ্বিভাষিক বইটাতে স্থান পায়। বইটির পাণ্ডুলিপি সংশোধনকালে একটা ভূতুড়ে সমস্যা দেখা দেয়। আমরা যতই সংশোধন করি না কেন, উজ্জ্বলের ল্যাপটপে তা তাৎক্ষণিকভাবে সংশোধিত হলেও পরদিন আবার একইরূপে তা বলবৎ থাকতো। ফলে আমাদের কিছু শ্রম ভূতেও খেয়েছে বলা যায়। ছাপাখানায় পৌঁছানোর আগে উজ্জ্বল এবং কাজী শাহাদাত ভাইকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। তারপরও লঞ্চে এবং ঢাকায় গিয়ে উজ্জ্বল বেশ কয়েকবার আমার সাথে যোগাযোগ করেছে, শেষ মুহূর্তের সংশোধনের বিষয়ে।
এরকম একটা বই আমরা কোথায় ছাপাবো এটা ছিলো একটা বড়ো সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন আলাপ আলোচনায় এবং কাজী শাহাদাত ভাইয়ের যোগাযোগে আমরা গ্রাফোসম্যান হতে জিউস বাইন্ডিংয়ে বইটি ছাপানোর সিদ্ধান্ত নেই। প্রথম সংস্করণে এক হাজার কপি ছাপানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং কমপক্ষে দুইশ কপি জেলা ব্র্যান্ডিং ফেস্টিভ্যালের দিন সরবরাহ করার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনার পায়াপাশি তৎকালীন চাঁদপুর প্রেস ক্লাবের সভাপতি বিএম হান্নান ও সাধারণ সম্পাদক সোহেল রুশদী চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের পৃষ্ঠপোষকতায় ইলিশ রান্না বিষয়ে একটা পুস্তিকা প্রকাশ করেন। এটিও বেশ সমাদৃত হয় এবং বেশ কয়েকবার পুনর্মুদ্রিত হয়।
দ্বিভাষিক জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনায় চাঁদপুরের অনেক দর্শনীয় স্থান ও স্থাপনা ছবি ও বর্ণনাসহ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মনসার মুড়া, সাচারের রথ, মেহার কালীবাড়ি, লোহাগড়া মঠ, উজানি বখতিয়ার খাঁ মসজিদ, পুরানবাজার নাখোদা মসজিদ, যাযাবর ভবন, অযাচক আশ্রম, সাহেববাজার পর্তুগীজ দুর্গ, সেইন্ট যোসেফের গির্জা, অলিপুর মসজিদ, আলমগিরি মসজিদ, নাওড়া মঠ--এ সব কিছুই ব্র্যান্ড বুককে সমৃদ্ধ করেছে। প্রচ্ছদে ইলিশ যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি স্থান পেয়েছে মোলহেড। আমাদের এই ব্র্যান্ড বুকটিই বাংলাদেশের প্রথম জেলা ব্র্যান্ডিং প্রকাশনা। সেক্ষেত্রে আমরা একটা বড়ো গৌরবের অধিকারী। আমাদের এ বইটি চৌষট্টিটি জেলায় যেমন উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি বিদেশেও বিভিন্ন দূতাবাসে পৌঁছেছে। বইটি বোদ্ধা কর্তৃক ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে।
(চলবে)