প্রকাশ : ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০:৩৫
আগুনের নদী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চার.
চাকচিক্যময় এই পৃথিবী। এখানে মরীচিকাময় আগুনের টানে যেমন কীটপতঙ্গ ছুটে এসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, তেমনি টাকার লোভে অনেক মানুষই দেশবিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে কেউ সমুদ্রসঙ্গমে নিমজ্জিত হয়, আর কেউ বেঁচে ফিরে আদম ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ে নিঃশেষ হয়ে যায়। এদের মধ্যে আবার কেউ কেউ গ্যাং লিডারকে টাকা দিয়েও প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারে না। নিখোঁজ হয়ে যায়, সমাধি হয় অকূল সমুদ্রের মাঝে।
এরই মাঝে আবার কেউ কেউ নারীর টানে ছুটে যায়, ভালোবাসে প্রেম করে বিয়ে করে ক’দিন পরই দুজনের ঝগড়াঝাটি হয়ে কেউ কেউ নিজকে সমর্পিত করে ফ্যানের রশিতে অথবা রেল গাড়ির চাকার নিচে। কেউ কেউ ভালোবেসে নিজের জীবনটাও দিয়ে নারীর ছলনার মাঝে, আবার কোনো কোনো দুর্বৃত্তপুরুষ নারীকে প্রেমের ছলনায় দিনের পর দিন ভোগ করে আস্তাকুঁড়ে ফেলে চলে যায়। এসব কথা ইরফান বলছিলো অধরার সাথে।
এমন সময় অধরার মুঠোফোনে একটি কল এলো। অধরা সেটি খেয়াল করলো না কথায় কথায়। কিন্তু ইরফানের নজরে এলো। ইরফান বললো, ‘অধরা কলটা রিসিভ করো।’
‘ওহ আচ্ছা।’ এই বলে অধরা মুঠোফোনের দিকে তাকিয়েই চমকে উঠলো। তারপর রিসিভ করে বললো, ‘হ্যালো, অনন্যা। কেমন আছো তুমি?’
‘অধরা আমি তাকে খুন করে ফেলেছি।’
‘কী বলছো এসব?’ অধরার চোখগুলো যেনো ভয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
‘হ্যাঁ। এক আন্ডারওয়ার্ল্ডের গ্যাং লিডারের ইশারায় আমার সংসার তছনছ করে দিয়েছিলো আমিনুল। দিনের পর দিন শারীরিক-মানসিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করেছে। গোপন ভিডিও করে তা আমার স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের কাছে পাঠানোর হুমকি দিয়ে মাসে মাসে আমাকে এটিএম বুথের মতো ব্যবহার করেছে। আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা করে যখন কানাডা থেকে প্লেনে উঠছিলাম, তখনও জানতাম না যে আমিনুল জাপান থেকে ফিরে আসবে। দেশে ফেরার পরপরই আমাকে ফোন করে সে। তখন সে জানতে পারে, আমি দেশে এসেছি। নিজেকে শেষ করার জন্যে যে ছুরি কানাডা থেকে নিয়ে এসেছিলাম, সেটা দিয়েই ওকে মেরেছি।’
‘ওহ। আল্লাহ। বলো কি তুমি?’
অনন্যা উত্তর দেয়, আমি খুনি, এটাই সত্য; সারা দুনিয়াও জানে। খুন করে কানাডায় চলে এসেছি। তাই তুমি ভাবতে পারো, বেঁচে গেছি। আসলেই আমি বেঁচে আছি? ২০১৯ সাল থেকে ট্র্যাপে পড়েছি আমিনুলের। বহুবার সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলাম। আত্মহত্যা করতে গিয়েছি কয়েকবার।
‘আমাকে এসব জানাওনি কেনো?’ অধরা প্রশ্ন করে।
‘আমি কাউকেই জানাতে পারিনি অধরা, আমাকে নরকের আগুন গ্রাস করেছিলো। আমি কোনো মতেই আরিফুলের যন্ত্রণা থেকে বের হতে পারিনি। বরং ধীরে ধীরে আরো ফেঁসে গেছি। তাই বসুন্ধরার একটি ভাড়া ফ্ল্যাটে আমিনুল ইসলামকে হত্যার পরদিন কানাডায় চলে আসি। আমার পরিবারের সদস্যদের না জানিয়েই ঢাকায় চলে আসি।
‘তারপর?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অধরা।
‘তারপর যেভাবে পাঁচ বছর আমাকে অত্যাচার করেছে, ওইদিন বসুন্ধরার ভাড়া ফ্ল্যাটে ওঠার পরই সে জোর করে আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করে। এর আগে জাপান থেকে আনা মদ খেয়েছিল আরিফুল। আরও কিছু জিনিস এনেছিল, যা আমার চিন্তারও বাইরে ছিলো। এরপর যখন আরিফুল ঘুমিয়ে পড়ে তখন মনে হচ্ছিল, আমার সামনে যাকে দেখছি, তা কোনো মানুষের চেহারা নয়। মুহূর্তের মধ্যে কী ঘটে গেছে, তা এখন কল্পনাও করতে পারছি না। এখন কানাডায় একটি সেফ হোমে আছি। দায় মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত আমি।’
অনন্যা কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরো জানায়, ২০১৬ সালে হাসান বাবুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এর এক বছর পর তার স্বামী কানাডায় চলে যায়। তখন নরসিংদীর একটি কলেজে লেখাপড়া করতো অনন্যা। ২০১৯ সালের দিকে আরিফুলের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। ওই সময় হঠাৎ বড়ো ধরনের রোগ ধরা পড়ে অনন্যার। যৌনাঙ্গে টিউমার। প্রথম পর্যায় ছিলো সেটি। পাশাপাশি সে জানতে পারে, কখনও বাচ্চা নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে না। এ সময় তাকে সাহস জোগায় আমিনুল। এরপর থেকে ধীরে ধীরে আমিনুলের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরে এ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয়। তখন আমিনুল মাসে ১৪ হাজার টাকার বেতনে ঢাকার একটি আবাসিক হোটেলে ছোটখাটো চাকরি করতো। কিছুদিন পর অনন্যা উপলব্ধি করে, কী করছে সে? এটা তো আসলেই ঠিক নয়। এরপর এ ধরনের সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়।
আমিনুল অনন্যাকে তার স্ত্রী-সন্তানের কথা গোপন করে। কিন্তু এক সময় জানতে পারে গাজীপুরে তার প্রথম স্ত্রী ও এক মেয়ে আছ। তখন আমিনুলকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে, স্ত্রীর সঙ্গে তার বনিবনা নেই। বাচ্চার টানে মাঝেমধ্যে গাজীপুরে যায়। প্রতিবছর শেষের দিকে অনন্যার স্বামী কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসতো। ২০২০ সালে আসার পর প্রথমে জানতে পারে, আমিনুলের সঙ্গে অনন্যার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। স্বামীর কাছে সবকিছু স্বীকার করে ক্ষমা চায় সে। এরপর পারভীনকে দ্রুত কানাডায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।
অনন্যা এরপর বলে, ‘যখন এ সম্পর্ক থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করেছি, তখনই গোপন ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখায় আমিনুল। এও বলেছে, পুলিশকে জানিয়েও লাভ হবে না। কারণ, তার রাজনৈতিক হাত অনেক লম্বা। কোনো এক গ্যাং লিডার নাকি তার খুব কাছের আত্মীয় এবং তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের মাফিয়া। স্বর্ণ চোরাচালান থেকে, ইয়াবা কোনো কিছুই বাকি নেই। মানুষ খুন করতে তার বাহিনীর হাত এতোটুকু কাঁপে না। এসবের ভয়ে দিনের পর দিন আমাকে অসহনীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। আমার শারীরিক অসুস্থতাকে কখনও গুরুত্ব দিতো না সে।’
আবারও কেঁদে উঠলো অনন্যা। তারপর বলতে লাগলো, ‘এই নরককুণ্ড থেকে বাঁচতে অনেক সময় এমন প্রার্থনাও করেছি, ঢাকা থেকে নরসিংদীতে যে গাড়িতে আমিনুল ফিরছে, সেটি যেন দুর্ঘটনায় পড়ে। এতে আমিনুল মারা যায়, আর আমিও মুক্তি পাবো। এরই মধ্যে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভয়-ভীতি দেখিয়ে হলফনামায় জোর করে সই নিয়ে বিয়ের নাটক করে আমিনুল। এরপর আমাকে বলতে থাকে, কানাডাপ্রবাসী স্বামী হাসান বাবুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না। একটি আলাদা ফোন আমাকে দেওয়া হয়, যেটা দিয়ে আমিনুলের সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য করা হতো।’
এবার আর অধরা বিষয়টি মেনে নিতে পারলো না। সে অনন্যাকে প্রশ্ন করলো, ‘তুমি কেনো আইনের আশ্রয় নিলে না। তুমি কোনো সাহস করে সবাইকে তোমার এ ঘটনার কথা বলে দিতে পারলে না? ওই গডফাদার জামশেদ বাহিনীর ভয়ে?
অনন্যা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। তারপর বলতে থাকে, ‘এসব ঘটনায় আমি গভীর ডিপ্রেশনে চলে গেছি। সাহস হারিয়ে মরার জন্যে কীটনাশক ব্যাগে নিয়ে মাসের পর মাস চলতাম। এটাও ভেবেছি, এসব জেনেও কী করে আমার স্বামী সব সহ্য করছে! আমাকে মেনে নিচ্ছে!’
‘তাহলে তোমার সমস্যাটা কোথায় ছিলো? তোমার স্বামীই যদি তোমাকে সাহস দিতো, সহ্য করে নিতো, তাহলে তুমি কেনো সবকিছুই তোমার স্বামীকে জানালে না?’
‘জানি না। আমার স্বামী প্রতি মাসে কানাডা থেকে যে টাকা পাঠাতো, তার অর্ধেক আমিনুল নিয়ে নিতো। তার মোটরসাইকেলের তেল খরচ, দামি মোবাইল সেট কিনে না দিলে ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখাতো। বাধ্য হয়ে মাসের পর মাস হাজার হাজার টাকা তাকে দেয়া লাগতো।’
‘তোমার এসব বন্ধ করার প্রয়োজন ছিলো। একজন মেয়েকে সমাজে বাঁচতে হলে তাকে সাহস রাখতে হয়। সত্যের মুখোমুখি হয়ে জীবনযুদ্ধে বাজি লাগাতে হয়। কান্নায় সব সমাধান হয় না অনন্যা।’
‘শোনো আগে। আমি আমার নিজের জীবন বাঁচাতে আমিনুলের সাথে জাপানি তরুণীর বিয়ের সব আয়োজন করেছিলাম। ওই তরুণীর সঙ্গে সব ঠিকঠাক হওয়ার পর কক্সবাজারে হানিমুনে যায় তারা। ওই সময় আমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা নিয়েছিল আমিনুল। এর কিছুদিন পর সে জাপানে চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পর কয়েক মাস কোনো যোগাযোগ করেনি। আমিও ভেবেছি, জাপানি তরুণীর সঙ্গে সুখে আছে। তবে এ বছরের শুরুর দিক থেকে আবার যোগাযোগ শুরু করে। সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটায় ঈদুল ফিতরের দিন। হঠাৎ কানাডায় আমার স্বামী হাসান বাবুর কাছে বেশ কিছু ভিডিও পাঠায় আমিনুল। এরপর ম্যাসেজ করে অশ্লীল কথাবার্তা লিখে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে ইঙ্গিত করে নানা হুমকি দেওয়া শুরু করে। দ্রুত কানাডা থেকে আমাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো না হলে এসব ভিডিও আত্মীয়স্বজনের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখায়। এতে মানসিকভাবে আমি ভেঙ্গে পড়ি।’
‘আহ, অনন্যা। তোমার এভাবে ভেঙ্গে পড়া ঠিক হয়নি।’ অধরা বললো।
‘এ পরিস্থিতিতে আত্মহননের পথ বেছে নিতে কানাডা থেকে দেশে ফিরেছিলাম। অনলাইনের মাধ্যমে বসুন্ধরার ওই ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিল আমিনুল। সেখানে ওঠার পর আমিনুল তাকে বলে, ফার্মগেটে একটি হোস্টেল ভাড়া করে দেওয়া হবে আমাকে। বছরে একবার জাপান থেকে আসবে আমিনুল। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো দরকার নেই। এরপরই আবারও জোরপূর্বক নির্যাতন শুরু করে। স্বামী-সংসার ফেলে আসার পর নিপীড়নের শিকার হলে সব ওলটপালট হয়ে যায়।’
‘হ্যাঁ, হবারই তো কথা। তাহলে তুমি এমন করলে কেনো?’ অধরা প্রশ্ন করলো।
‘ভেবেছিলাম, আমার স্বামীর কাছে এমন নোংরা ছবি পাঠানোর কারণে হয়তো ক্ষমা চাইবে আমিনুল। হয়তো পুরো বিষয়টি নিয়ে মাফ চাইতে জাপান থেকে আসছে। ঢাকায় এসে ঠিক পুরোনো রূপ দেখা গেলো তার। আমিনুলের মোবাইল ফোনসেট হাতে নিয়ে দেখি, আমার নানা ধরনের গোপন ভিডিও। কখন-কীভাবে এসব তুলেছিল, জানি না। কিছু ভিডিও আমাকে বের করে দেখাচ্ছিল সে। এটা আমি মেনে নিতে পারিনি।’
‘তারপর?’
‘আমিনুলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর থেকে আমাকে একঘরে করে ফেলা হয়। বন্ধু-বান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কোথায়, কেনো যাচ্ছি, তা প্রতি মুহূর্তে তাকে জানাতে হতো। প্রায়ই মনে হতো, আমার রিমোট কন্ট্রোল ওই পাষণ্ডের হাতে। প্রতি সপ্তাহের কোন্ দিন কোন্ সময় তার বাসায় যেতে হবে, এটিও ঠিক করে দিয়েছিল সে। আমার নিজের লাইফ বলতে কিছু ছিলো না।’
‘হায় রে মানুষ। মানুষের জীবনের কি তাহলে কোনো মূল্যই নেই?’ প্রশ্ন করে অধরা।
‘কানাডায় ফিরে আবার নিজেকে শেষ করে দেয়ার কথা বারবার মাথায় আসছে। আমি মরে গেলে আমার মা-বাবাসহ পরিবারের কাউকে নিয়ে যেন পুলিশ টানাহেঁচড়া না করে, এটি নিশ্চিত করবে প্লিজ। আমিনুলকে হত্যার পর একবার স্বামী ফোন করেছিল। কোন মুখে তার সঙ্গে কথা বলবো? নিজের জীবনের সঙ্গে তার গোছানো জীবনটাও ধ্বংস করেছি। যাই হোক, আমিনুলকে খুনের পর ফোন বন্ধ করে রাখতে পারতাম। সেটা করিনি। এখন আমার আশপাশে কথা বলার মতো কাউকে পাচ্ছি না। কেউ কথা বললে মনে এক ধরনের শান্তি পাই।’অধরা অনন্যার কথাগুলো শুনে নির্বাক। অনন্যা প্রশ্ন করলো, ‘কি অধরা চুপ হয়ে গেলে কেনো? তুমি না আমার শ্রেষ্ঠ বান্ধবী? ভয় পেয়েছো নাকি?’ অধরা আর কান্না লুকিয়ে রাখতে পারলো না। হড়হড় করে কাঁদতে শুরু করলো। (চলবে)