প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৩:০১
পাঠ্যপুস্তক থেকে দুর্বোধ্য পরিভাষা বাদ দেওয়া উচিত
বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের পরপর ব্যাপক গণদাবির মুখে শিক্ষা সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে জনমতকে পাশ কাটিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তককে রাজনৈতিক প্রচারণার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। কখনও কখনও ভুল এবং মিথ্যা তথ্যের ওপর নির্ভর করে রচিত বিষয়বস্তু পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছিল। আশার কথা, সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসেবে বিতর্কিত ও মানহীন বিষয়গুলো বাদ দিয়ে বৈষম্যবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে তথ্যনির্ভর ও মানসম্পন্ন বিষয় যুক্ত করে পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করা হচ্ছে। তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে নিঃসন্দেহে এটি ভালো উদ্যোগ। তবে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে আরও একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে এখনই বিবেচনায় আনা প্রয়োজন, যাতে অন্তত ২০২৬-এর জন্য মানসম্মত পাঠ্যপুস্তক তৈরি করা যায়। বিষয়টি হলো পাঠ্যপুস্তকের ভাষা।
গবেষণায় দেখা গেছে, একজন শিশু যখন মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করে, তখন তার মননশীলতা এবং চিন্তা করার ক্ষমতা শক্তিশালী হয়। তার আত্মবিশ্বাস এবং সৃজনশীলতা বাড়ে। মাতৃভাষার মাধ্যমে সে তার পরিবার, সমাজ ও জাতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। মাতৃভাষায় পাঠ্য বিষয় সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। তাই ইউনিসেফ, ইউনেস্কোসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা মাতৃভাষায় শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে। আমাদের দেশে পাঠ্যপুস্তক মাতৃভাষা বাংলায় রচিত হবে এটিই স্বাভাবিক। তবে বাস্তবতা হলো, পাঠ্যপুস্তকের ভাষা আপাতদৃষ্টিতে বাংলা হলেও যে বাংলা আমাদের মাতৃভাষা তা নয়। বিশেষ করে বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তকে পরিভাষার আধিক্য বেশি। ওই ভাষাকে মাতৃভাষা বাংলা দাবি করা পরিহাস ছাড়া কিছু নয়।
তাই এখন সময় এসেছে প্রশ্ন করার। পরিভাষা কি আসলেই মাতৃভাষায় শিক্ষার সহায়ক? আমি মনে করি, মূল ভাষা হোক বা পরিভাষা, এর বোধগম্যতাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। বাংলায় বহুল প্রচলিত পরিভাষা আছে, যেগুলো মাতৃভাষার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। এগুলোর অর্থ উদ্ধার করতে বিশেষ বিদ্বান হওয়ার প্রয়োজন হয় না। যেমনÑসংবাদপত্র, প্রধানমন্ত্রী, উপজেলা, উচ্চ বিদ্যালয় ইত্যাদি। এ ধরনের পরিভাষা শিক্ষার সহায়ক, কেননা এগুলোর অর্থ ছাত্রছাত্রীদের কাছে স্পষ্ট এবং বোধগম্য।
আবার কিছু শব্দ আছে বিদেশি ভাষার মূল শব্দেই মানুষের কাছে বেশি বোধগম্য। যেমনÑএসি, বাস, অফিস, মোবাইল ফোন, টিভি, চার্জার, পিসি, স্টেশন ইত্যাদি। বিদেশি ভাষার কোনো শব্দ যখন আমজনতার কাছে বোধগম্য হয়ে ওঠে তখন তা আর কার্যত বিদেশি শব্দ থাকে না। এগুলোর পরিভাষা খুঁজতে যাওয়াটা পণ্ডশ্রম। লেখাপড়া না জানা মানুষও যখন এক্স-রে মানে বোঝে, তখন এর পরিভাষা রঞ্জনরশ্মি ব্যবহার করার যুক্তি কী? ডায়াবেটিস মানে কী, মানুষ তা সরাসরিই বোঝে। এর পরিভাষা হিসেবে ‘বহুমূত্র রোগ’ ব্যবহার না করাই শ্রেয়। এসব ক্ষেত্রে পরিভাষার ব্যবহার অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
পরিভাষার অতি ব্যবহার মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষাকে সহজ তো করেইনি, বরং কিছু ক্ষেত্রে কঠিন করে তুলেছে। কোথাও বলা যায়, বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে।
ওপরের ছকের মূল শব্দ অথবা পরিভাষা হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহৃত পরিভাষা কোনোটিই বাংলাভাষীদের কাছে পরিচিত বোধগম্য কোনো শব্দ নয়। দুটিই নতুন করে শিখতে হয়। তবে মূল শব্দটি না শিখে কেউ যদি শুধু পরিভাষা শেখে, উচ্চশিক্ষায় তার বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়। কেননা স্নাতক পর্যায়ের বই-পুস্তক বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইংরেজি ভাষায় লেখা এবং শিক্ষকরা ক্লাসে লেকচার দেওয়ার সময় মাধ্যমিক পর্যায়ে শিখে আসা পরিভাষাগুলো সংগত কারণেই আর ব্যবহার করেন না। ফলে অনেক মেধাবী ছাত্রেরও বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ক্লাসে শিক্ষকের কথা বুঝতে বেগ পেতে হয়।
কারিগরি শিক্ষার্থীদের শ্রমবাজার সাধারণত দেশের বাইরেও বিস্তৃত হয়। কখনো বা পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়মিত আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়। তাই তাদের ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজনেই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক ইংরেজি টার্ম জানা প্রয়োজন। পরিভাষায় শিক্ষা তাদের পেশার গুণগত মান বাড়ায় না। বরং অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক যোগাযোগে বিভ্রান্তি ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আমি মনে করি, পাঠ্যপুস্তকে অপরিচিত পরিভাষার ব্যবহার কার্যত মাতৃভাষায় শিক্ষার উদ্দেশ্য পূরণ করে না। অধিকন্তু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞান যে গতিতে প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে, আমাদের দেশে সেই গতিতে সহজে বোধগম্য উপযুক্ত পরিভাষা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিজ্ঞান শিক্ষাকে গতিশীল ও কার্যকর করার জন্য পাঠ্যপুস্তককে অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বোধ্য পরিভাষা থেকে মুক্ত করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে আমরা জাপানি মডেল গ্রহণ করতে পারি। জাপানি ভাষায় মাতৃভাষার সঙ্গে ইংরেজি বা কোনো বিদেশি শব্দ সরাসরিই ব্যবহার করা হয়। তবে তা লেখার জন্য তারা ‘কাতাকানা’ নামে ভিন্ন বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছে। আমরাও মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে পরিভাষার পরিবর্তে বিদেশি শব্দ সরাসরি ব্যবহার করতে পারি। বিদেশি শব্দ লাতিন হরফে লিখে সঙ্গে ব্রাকেটের ভেতরে বাংলা বর্ণে উচ্চারণ লেখা যেতে পারে। যেমন :
বর্তমান বাক্য : তরল বা বায়বীয় পদার্থে আংশিক বা সম্পূর্ণ নিমজ্জিত কোনো বস্তুর ওপর তরল বা বায়বীয় পদার্থ লম্বভাবে যে ঊর্ধ্বমুখী লব্ধিবল প্রয়োগ করে তাকে প্লবতা বলে। প্লবতার মান বস্তুর নিমজ্জিত অংশ কর্তৃক অপসারিত তরল বা বায়বীয় পদার্থের ওজনের সমান।
প্রস্তাবিত বাক্য : তরল বা বায়বীয় পদার্থে আংশিক বা সম্পূর্ণ নিমজ্জিত কোনো বস্তুর ওপর তরল বা বায়বীয় পদার্থ লম্বভাবে যে ঊর্ধ্বমুখী লব্ধিবল প্রয়োগ করে তাকে ইঁড়ুধহপু (বুয়েন্সি) বলে। ইঁড়ুধহপু (বুয়েন্সি)’র মান বস্তুর নিমজ্জিত অংশ কর্তৃক অপসারিত তরল বা বায়বীয় পদার্থের ওজনের সমান এ উদাহরণে প্লবতা শব্দটি কোনোভাবেই দৈনন্দিন জীবনে বহুল পরিচিত শব্দ নয়। ইঁড়ুধহপু (বুয়েন্সি) শব্দটিও নতুন। তবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পর ‘প্লবতা’ শব্দটি আর ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। তবে কারিগরি পেশায় যুক্ত থাকলে বুয়েন্সি শব্দটি কাজে লাগবে। কাজেই নতুন করেই যদি কোনো শব্দ শিখতে হয়, সেটিই শেখা ভালো যেটি উচ্চশিক্ষা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনে বেশি কাজে আসবে।
বিজ্ঞান শিক্ষায় নতুন, অপরিচিত ও দুর্বোধ্য পরিভাষা পাঠ্যপুস্তক থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া দরকার মনে করি। এতে ভাষার বোধগম্যতা বৃদ্ধি পাবে। শিক্ষার্থীরা পেশাগত জীবনে প্রয়োজনীয় শব্দগুলো আত্মস্থ করার জন্য বেশি সময় পাবে। কম প্রচলিত পরিভাষা মনে রাখার বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাবে। মাতৃভাষায় শিক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য, অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের সহজভাবে বিষয়গুলো বোঝানো, যাতে তারা বিভিন্ন জটিল বিষয়ে সঠিক ধারণা লাভ করতে পারে; সেটি আরও ভালোভাবে বাস্তবায়িত হবে।