প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৫২
খণ্ডে খণ্ডে অখণ্ড জীবন
(কুড়িতম পর্ব)
সন্তানের কাছে মা হলো নাটাই, সন্তান হলো ঘুড়ি। যত উপরে উঠুক, নাটাইয়ের টানে ঘুড়ি যেমন ফিরে আসে শেকড়ে, তেমনি নাড়ির টানেও সন্তান ফিরে যায় তার জননীর কাছে, জন্মমূলে। যতদূরে থাক, যেখানেই থাক। কিন্তু মা চিরজীবী হয়ে যাওয়ার পর অবস্থা এমন হয় যে, জীবনের গাঙে প্রাণের তরণি বোধ হয় চিরতরে নোঙর তুলে ফেলে। কোনো টান থাকে না, কোনো প্রাণ থাকে না দিনযাপনে। দুহাজার এগারো সালের দিনগুলো নোঙরহীন নৌকার মতো চলছিল হেলেদুলে। খাওয়ার জন্যে খাই, চলার জন্যে চলি। এর মধ্যে অবশ্য বড়ো ছেলেটি স্কুলে যেতে শুরু করেছে। স্টেডিয়াম সড়কের পাশে স্কুলটিতে একফালি আঙিনা আছে যাকে খেলার মাঠের কাঠামো দেওয়া হয়েছে শিশুদের দোলনা এবং নাগরদোলা বসিয়ে। স্কুল প্রাঙ্গণটা ছোট হলেও প্রাণচঞ্চল ছিলো। ছোট ছেলেটি তার মায়ের কোলে পিঠে ব্যাগে চড়ে স্কুলে আসে বড়ো ভাইকে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। অনেকটাই ক্যাঙারু মায়ের মতো। তাকে পেয়ে বড়ো ভাইয়ের সতীর্থরা একটু দলাই মথাই করতো। নাদুস নুদুস ছিলো তো! ছোট বয়স হতেই তাকে দীপা ম্যাম আপন তনয়তুল্য স্নেহে দেখতেন। বড়ো ছেলের স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো ঘটা করে। তাতে পুরুষ ও নারী অভিভাবকদের জন্যে একটা করে ইভেন্ট থাকতো। ডা. আহসানউল্লাহ ভাই এই ইভেন্টটাকে জীবনমরণ গুরুত্ব দিয়ে নিতেন। শার্ট-প্যান্টের হাত-পা বটে, তিনি তৈরি থাকতেন যুদ্ধ জয়ে। একবার একটা ইভেন্ট ছিলো, বয়াম ভর্তি আটা-ময়দা ঘেঁটে মুখ দিয়ে একটা চকলেট বের করে এনে দৌড় লাগানো। কিন্তু প্রতিযোগীদের হাত বাঁধা ছিলো। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। এক একজনের মুখে আটা-ময়দার প্রলেপ লেগে মনে হলো সদ্য ভাস্কর্যগুলো গড়ানো হয়েছে প্লাস্টার অব প্যারিস দিয়ে। এতো কষ্ট করে যে পুরস্কার আহসানউল্লাহ ভাই পেলেন, তা ছিলো আসলে বড়ো একটা লাউ।
এ সময়ের একটা দারুণ চর্চা ছিলো আমার বড়ো ছেলের সহপাঠী বন্ধুদের গার্ডিয়ানের আমাদের বাসায় জমায়েত হওয়া। আমার বাসাটা তখন ছিলো আখতার মঞ্জিলের চারতলায়, স্কুলের বেশ কাছেই।ছেলের ক্লাসের বেশ কয়েকজন গার্ডিয়ানের সাথে আমাদের পারিবারিক বন্ধুতা হয়ে যায়। ফলে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে তারা আমাদের বাসায় আড্ডা দিতেন বা অপেক্ষা করতেন। এ রকম বহুদিন আড্ডা ও প্রতীক্ষার ছলে নাশতার উৎসব হতো। কোনোদিন খিচুড়ি, কোনোদিন বউয়া আর ভর্তা, কোনোদিন হাতে বানানো রুটি-ভাজি। যতোটা না খাওয়া তারচেয়ে অধিক ছিলো মিলনমেলা। সংগত কারণেই একসময় মহিলা মহলের আড্ডার বিষয় হয়ে যেতো পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কীয় জাগতিক বিষয়। স্কুলে আসতে-যেতে একটা বিষয় আমার পত্নী নিবিড় মনোযোগে খেয়াল করেছেন। বিষয়টি বেশ মজার। যে কোনো গার্ডিয়ান মিটিংয়ে স্কুলের অধ্যক্ষ মহোদয় নিজেকে নতুন বউয়ের উপমা দিয়ে বক্তব্য সাজাতেন। অর্থাৎ গার্ডিয়ানদের সহযোগিতা ছাড়া স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছুই করতে পারেন না, কেননা স্কুলের অধ্যক্ষ একজন নতুন বউয়ের মতোই সদ্যোস্ফুট। এ উপমা মনে হলেই আমার পরিবারের স্যারের কথা মনে পড়ে যায়। মুরুব্বি অত্যন্ত প্রগাঢ় স্নেহে তাকে ভগ্নি সম্বোধন করতেন, যা ছিলো আমাদের জন্যে বড়ো এক পাওয়া।
ধীরে ধীরে আমি কাজী শাহাদাত ভাইয়ের নেতৃত্বে বিতর্কের মতো সৃজনশীল আয়োজনের সাথে যুক্ত হয়ে যাই। প্রথম প্রথম আমি বিচারক হিসেবে সনাতনী বিতর্কের মূল্যায়নকারীর দায়িত্ব পালন করতে থাকি। পরবর্তীতে সংসদীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতা চালু হলে আমি মাননীয় স্পিকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অবতীর্ণ হই। আমার দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠা দেখে কেউ কেউ আমাকে মাননীয় স্পিকার হিসেবে সম্বোধন করতে শুরু করে। একসময় চাঁদপুর কণ্ঠ, সিডিএম ও টিআইবি-এর যৌথ উদ্যোগে প্রাইমারি স্কুলের বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু হয়। প্রতিযোগিতার পূর্বে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকদের জন্যে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। কোনো কারণে আমাকে প্রশিক্ষক বা ফেসিলিটেটর হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ সময় ডা. আব্দুন নূর তুষার ভাইও একটা সেশন নেন। আমার নেওয়া সেশনে সম্ভবত শিক্ষকমণ্ডলি নিজেদের মনের কথাগুলোর প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। তারা সন্তোষ প্রকাশ করেন তাদের প্রচারিত অভিব্যক্তিতে। এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সাব্বির আজম উৎসাহিত হন। সাব্বির একজন বিতর্ক অন্তপ্রাণ মানুষ। এসময় তার ধ্যানজ্ঞান ছিলো বিতর্ক ও তার নবতর উৎকর্ষ উদ্ভাবন। সে নিবিড় যত্ন নিয়ে আমার সেশনের মৌলিক বিষয়গুলো একসাথে করে একটা পুস্তিকা সম্পাদন করলো। সম্পাদনকালে কিছুটা নিজেও তাতে তথ্য সংযুক্ত করে দিলো। কাজী শাহাদাত ভাইয়ের মতো একজন সৃজনশীল সংগঠক ও বিতর্কমনস্ক মানুষ এ বিষয়টা প্রত্যক্ষ করে তা বিতার্কিকদের পাঠ্য হিসেবে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং টিআইবিকে সম্মত করালেন বইটির প্রকাশক হতে। টিআইবি শুধু বইটির প্রকাশকই হলো না, বরং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই বিতর্ক প্রতিযোগিতার স্পন্সরও হয়ে গেলো।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতর্কের চর্চা তথা যুক্তি ও পরমতসহনশীলতার মাহাত্ম্য তৈরি করা একটা চমৎকার ধারণা। কারণ কোমল মনে যুক্তির চর্চা তৈরি করা যেমন সহজ তেমনি আয়াসসাধ্যও বটে। প্রথমত তাদের জন্যে উপযুক্ত বিষয়বস্তু নির্বাচন ও তাদের মেন্টরিং করা বেশ দূরদর্শিতার ব্যাপার। বিষয়টা এমন না যে, কেবল মুখস্থ করে ওগলানো হলো। এটা মনের মধ্যে চেতনা তৈরি করার বিষয়। মনের গভীরে রেখাপাত না করলে এই আয়োজন বৃথা। তাই বিষয়টা যতোটা সহজ ঠিক ততোটাই কঠিন। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রত্যাশার চেয়েও তাদের দক্ষতা অধিক ভালোভাবে উপস্থাপন করেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিতর্ক প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করার কথা ছিলো জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের। এজন্যে তিনি নিমন্ত্রিত ছিলেন। কিন্তু বিশেষ কারণে তিনি উপস্থিত থাকতে না পারায় অন্তিম মুহূর্তে এ দায়িত্ব আমার উপরে বর্তায়। আমি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সাথে এ সময় থাকতে পেরে বেশ উৎফুল্ল ছিলাম। এ প্রতিযোগিতা থেকে আমরা বেশ কয়েকজন তুখোড় বিতার্কিক পাই, যারা পরবর্তীতে বড়োদের মঞ্চও মাতিয়েছিলো মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে। ছোটদের পাশাপাশি বড়োদের বিতর্ক প্রতিযোগিতার জন্যেও রাজনের তাগাদায় আমাকে কয়েকশ বিষয়বস্তু নির্ধারণ করতে হয়েছে। বিভিন্ন স্তরে এই বিষয়বস্তুগুলো উপযোগী করে নির্ধারণ করা চাট্টিখানি কথা নয়। দুই পক্ষই যাতে সমানভাবে বলতে পারে বা তাদের যুক্তিতর্ক পেশ করতে পারে সে বিষয়ে সদা যত্নশীল হতে হতো। বিতর্কের আসরে বিচারকার্য করতে গেলে নিজের চিন্তার সাথে বক্তার বক্তব্যকে মিলিয়ে নিতে হয়। আর এ কাজ করতে গেলে মাঝে মাঝে কান খোলা রেখে চোখ বন্ধ করে শ্রবণ করতে হয়। এতে নিবিড় মনোযোগ তৈরি হয়। কিন্তু দর্শকের কাছে কখনও কখনও এ দৃশ্যের ভুল মর্মার্থ দাঁড়ায়। তারা মনে করেন, মূল্যায়নকারী হয়তো নিদ্রালু হয়ে উঠেছেন। কিন্তু এই ধারণার অসারতা প্রমাণিত হয় বিচারকের বক্তব্যে, বিচারকার্যের মূল্যায়ন সম্পর্কিত অভিব্যক্তিতে। যখন বিতর্কের বিচারক খুঁটিনাটি বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেন, তখন বুঝা যায়, তিনি কতোটুকু গভীর মনোযোগে নিবিষ্ট ছিলেন। আর এ কারণেই পরদিন পত্রিকায় টুকিটাকি শিরোনামে সংবাদ হয়, বিচারকের আসনে স্বয়ং সিসি ক্যামেরা, যার নজর ও শ্রবণ হতে বাদ যায় না কিছুই।
বড়োদের বিতর্কের বিচারকার্যে বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় পরবর্তী বছরে তাদের দলের প্রাপ্যতা নিয়ে। কেননা হারলে সবারই একটা নেতিবাচক আবেগ তৈরি হয়। বিচারক প্যানেলকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। আসলে বিতর্কের মতো সৃজনশীল শিল্পের বিচার প্রক্রিয়ায় যে কোনো নিরেট ধ্রুব মানদণ্ড নেই, তা অনেকেই বুঝতে চান না। একই বিতর্ক দশ মিনিট আগে শুনলে মনের ভেতর যা অভিব্যক্তি ও প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, দশ মিনিট পরে শুনলে তাতে অবশ্যই ভিন্নতা তৈরি হয়। এটাই মুখ্যত সৃজনশীলতা। এতে পরম সত্য বলে কিছুই নেই। ছোটদের বিতর্কের বিচারকার্যে আবেগ একটা মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।তাদের বক্তব্যকে একদিকে বয়স দিয়ে যেমন বিবেচনা করতে হয়, তেমনি বিতর্ক শেষে ফলাফলের সময় তাদের আবেগটাও দুর্বহ হয়ে দাঁড়ায়। দর্শকের হাততালি কিংবা সক্রিয়তা বিতর্কের জমজমাট অবস্থার জন্যে দরকারি হয়ে দাঁড়ালেও নিরপেক্ষ বিচারকার্যের জন্যে তা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। অনেকেই মনে করেন, হাতে তালি পাওয়া বক্তাই বুঝি সেরা। তা যে সর্বদা সত্য নয়, সে সত্য বোঝার মতো শক্তি অনেকেরই থাকে না।
বিতর্ক প্রতিযোগিতার প্রতিটি পর্যায়ের দিন একটা করে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা কাজী শাহাদাত ভাইয়ের একটা মহান ব্রত। এই সংখ্যাটার নামও মহৎ। এর নাম দেওয়া হয়েছে 'বিতর্কায়ন'। আমরা যেমন 'বিদ্যুতায়ন', 'চুম্বকায়ন' শব্দগুলো ব্যবহার করি আহিত করা বা আবিষ্ট করার জন্যে, তেমনি 'বিতর্কায়ন' শব্দটিও অত্যন্ত জুতসইভাবে বিতর্কের আবেশ তৈরিকরণে প্রযুক্ত হয়েছে। এই 'বিতর্কায়ন' শীর্ষক বিশেষ প্রকাশনার মাধ্যমে বিতর্ক শিক্ষার্থী ও প্রতিযোগীরা যেমন শিক্ষণে যুক্ত হয়, তেমনি বিতর্ক বিষয়ে নিজেদের ভাবনাকেও প্রকাশ করতে পারে। এটা যেন এক ধরনের দ্বিপাক্ষিক মতামত প্রকাশযোগ্য শ্রেণিকক্ষে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। প্রতিযোগিতা শেষে 'বিতর্কায়ন'-এর বিশেষ সংখ্যাগুলো থেকে বাছাইকৃত লেখা নিয়ে প্রকাশিত হতো 'বিতর্কায়ন' নামে স্মারক গ্রন্থ। পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতাকে কালের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত রাখার জন্যে এ এক মহৎ ও দূরদৃষ্টি সম্ভূত উদ্যোগ। এটি কেবল ভাব প্রকাশের মুখপত্রই নয়, এটি পুরস্কার হিসেবে উৎকৃষ্ট ও মর্যাদাময়। পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার একযুগ পূর্তি পর্যন্ত প্রায় ছয়ের অধিক 'বিতর্কায়ন' গ্রন্থ এবং অসংখ্য 'বিতর্কায়ন' বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। এই মহৎ কর্মযজ্ঞে দুজন মানুষ হিমালয় উচ্চতায় দাঁড়িয়ে ছিলেন নেপথ্যে। একজন পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সের কামরুল হাসান শায়ক আরেকজন দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের সম্পাদক ও প্রকাশক অ্যাডভোকেট ইকবাল-বিন-বাশার। তাঁর পত্নী প্রফেসর বিলকিস আজিজের ভূমিকাও কম নয় মোটেই। বিতর্কের এই মহৎ কর্মযজ্ঞ যিনি মহাবলী হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত বহনের মতো টেনে নিয়ে গেছেন, তিনি আর কেউ নন, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক জনাব কাজী শাহাদাত, যিনি নিজেকে বিতর্ক জ্বরে আক্রান্ত একজন বিতর্ক শ্রমিক বলে পরিচয় দিতেই শ্লাঘা বোধ করেন।
চাঁদপুরে বিতর্ক চর্চার প্রচল ও প্রসারে ইবনে আজম সাব্বির যেমন উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিলেন, তেমনি জনাব কাজী শাহাদাতও ছিলেন গুরু দ্রোণাচার্যের ভূমিকায়। পরবর্তী সময়ে কিছুটা দ্বিমত তৈরি হওয়ায় সিকেডিএফ-এর জন্ম হয়। তৃণমূল পর্যায়ে বিতর্কের মতো নান্দনিক ও সৃজনশীল শিল্পকে ছড়িয়ে দিয়ে প্রজন্ম বিনির্মাণের যে মহান ব্রত জনাব কাজী শাহাদাত নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো করে যাচ্ছিলেন, তাতে সুনাম যতটুকু মিললো, ঠিক ততটুকুই যেন তিনি অনেকের বিরাগভাজন হতে শুরু করলেন। কেউ কেউ প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে তাঁকে নেতিবাচক চোখে দেখেছেন, আর কেউ কেউ ঈর্ষার অবস্থান হতে তাঁকে বিরোধিতা করে গেছেন। আবার কেউ কেউ আছেন অকুণ্ঠভাবে তাঁর পাশে ছিলেন। এতে রাজা রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগরের কথা সামনে চলে আসে। আসলে সমাজকে সংস্কার করতে গেলে সবাইকে একমত করানো কঠিন। কেউ কেউ ঐ মত বা ব্রতকে বুঝে উঠতে পারেন না, আর কেউ কেউ নিজের অক্ষমতাকে বড়ো করে দেখে অন্যের সাফল্যকে অনুমোদন করতে কুণ্ঠা বোধ করেন। এর পাশাপাশি আজকের বাঙালি সমাজে জুতা আবিষ্কারের মতো জটিলতাও আছে। একজন কোনো বিষয়ে সার্থকতা পেলে অন্যজন মনে মনে বলে উঠে, এটাতো আমার পরিকল্পনাতে ছিলো, ঐ ব্যাটা তা কেমন জেনে ফেললো! নিজেকে আর দশজনের সামনে হিরো করে তোলার ব্যাপারেও বাঙালির মধ্যে অন্যের সাফল্যকে অনুমোদন করতে দ্বিধাবোধ তৈরি হয়। ফলে মহৎ কাজে সংখ্যাগরিষ্ঠকে শুরুতেই পাওয়া যায় না।
শতভাগ সহমত না হলেও চাঁদপুরে এর রেশ ধরে বিতর্ক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিলো আনাচে কানাচে। চতুরঙ্গ ইলিশ উৎসব কিংবা মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় যেমন, তেমনি জেলা প্রশাসনের মাসব্যাপী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক উৎসব এবং সনাক-টিআইবির বিভিন্ন দিবস উদ্যাপনকে কেন্দ্র করেও বিতর্ক চর্চা অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি কেন্দ্রের নির্দেশনায় সমকাল বিজ্ঞান বিতর্ক এবং প্রথম আলো বন্ধু সভাও বিতর্কের আয়োজন চালু রাখে। বিতর্ককে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক চর্চার মাধ্যমে বিস্তৃত পরিসরে নিয়ে যেতে সিসিডিএফের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভাষাবীর এম এ ওয়াদুদ বিতর্ক উৎসব চাঁদপুরকে জাতীয়ভাবে গৌরবান্বিত করেছে। বিতর্ক শিক্ষার জন্যে ২০১৯ সাল থেকে কাজী শাহাদাতের তত্ত্বাবধানে চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি ও তারও বেশ ক'বছর পরে চাঁদপুর সরকারি কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক অসিত বরণ দাসের পৃষ্ঠপোষকতায় চাঁদপুর স্কুল অব ডিবেট চালু হয়। বিতর্কের বিকাশ ও প্রসারে জনাব কাজী শাহাদাতের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো চাঁদপুর অযাচক আশ্রমের পৃষ্ঠপোষকতায় চরিত্র গঠন আন্দোলন পরিষদের আয়োজনে বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। এর ফলে ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে বিতর্ক শিল্প বিকশিত হওয়ার মঞ্চ লাভ করে। পাঞ্জেরী-চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক প্রতিযোগিতার দূরবর্তী সুফল হিসেবে চাঁদপুরের বিতার্কিকরা যেমন জাতীয় পর্যায়ে নিজেদের দক্ষতায় কৃতিত্ব অর্জন করেছে, তেমনি গড়ে উঠেছে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক বিতর্ক ক্লাব। গ্রাম-গঞ্জের নবীন বিতার্কিকদের মধ্যে তৈরি হয়েছে স্বপ্ন নিজেকে উচ্চতর পরিমণ্ডলে তুলে ধরার।
লেখক : উপদেষ্টা, দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ ও চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশন (সিকেডিএফ); অধ্যক্ষ, চাঁদপুর বিতর্ক একাডেমি।