শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২৪  |   ৩১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   চাঁদপুর জেলা গণফোরামের কর্মী সমাবেশ
  •   নিষেধাজ্ঞার প্রথম দিনে ফরিদগঞ্জে অবাধে ইলিশ বিক্রি
  •   পিকনিকে যাওয়া শিক্ষার্থীর মরদেহ মেঘনায় ভেসে উঠলো দুদিন পর
  •   নেতা-কর্মীদের চাঁদাবাজি না করার শপথ করিয়েছেন এমএ হান্নান
  •   বিকেলে ইলিশ জব্দ ও জরিমানা

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:১৬

মুদ্রা পাচার রোধে সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন

মো. রবিউল হাসান
মুদ্রা পাচার রোধে সামাজিক উদ্যোগ প্রয়োজন

বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। রেমিট্যান্স ও তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানির ওপর ভিত্তি করে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে মোট চাহিদা বেড়েছে, তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান, বৃদ্ধি পেয়েছে দেশের অর্থনৈতিক পরিধি। এই প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে হলে পরে দরকার প্রচুর বিনিয়োগ। কিন্তু দেশে দেখা দিয়েছে অর্থসংকট। এই অর্থসংকটের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়া, রেমিট্যান্স হ্রাস পাওয়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরি, বাণিজিক ব্যাংকের দুর্নীতি, মুদ্রা পাচার, ঋণ খেলাপি ইত্যাদি। এসব কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে মুদ্রা পাচার।

নিজ দেশের অর্থ অবৈধ উপায়ে দেশের বাইরে চালান হওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রা অবৈধভাবে বিনিময় হওয়াকে অর্থ পাচার বলা হয়। একটি দেশের সার্বিক আর্থিক নিরাপত্তার জন্য আর্থিক খাতের স্বচ্ছতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ পাচার দেশ ও জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। মানুষের মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে। যদি দেশের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হয় তবে দেশে বিনিয়োগ বাড়ে না, বেড়ে যায় দুর্নীতি ও আর্থিক সংকট।

বিশ্বব্যাপী মুদ্রা পাচার একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, এ সমস্যা বিশ্বের সব দেশেই বিরাজমান। তবে তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশে এই সমস্যা অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করেছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থপাচার বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফ আই)’ এর প্রকাশিত রিপোর্টে এই মুদ্রা পাচারের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছে।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯১১ কোটি মার্কিন ডলার বাইরে চলে যায়।২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি মার্কিন ডলার বা ৬ লাখ ৬ হাজার ৮৬৮ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।২০১৪ সালে যে পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে তা দিয়ে আমরা অনায়াসে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের পরিবহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ ও কৃষিপণ্য খাতে বরাদ্দ দেয়া সম্ভব ছিল।

জিএফআই তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মুদ্রা পাচারের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে। তারা এটাও বলেছে যে এটি বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বে প্রতিবছর যে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয় তার ২৪ শতাংশই উন্নয়নশীল দেশ থেকে হয়ে থাকে।

এ ব্যাপারে একজন তরুণ অর্থনীতিবিদের সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ‘কোনো দেশ থেকে বিদেশি মুদ্রা বেরিয়ে গেলে সে দেশের অর্থনীতি ভারসাম্য হারাতে থাকে। একই সঙ্গে দুর্নীতির হার বেড়ে চলতে থাকে। যার ফলে দেখা যায় কিছু সংখ্যক মানুষ অতিরিক্ত ধনী হয়ে যায় আর দরিদ্র শ্রেণির সমস্যা বাড়তে থাকে। মুদ্রাস্ফীতির কারণও হয়ে যায়’।

মুদ্রা পাচারের সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর উপায় হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেনের সময় ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ এবং ‘ওভার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তর করা। এক শ্রেণির রপ্তানিকারক পণ্য রপ্তানির সময় ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে পণ্যের মূল্য কম দেখায়। এই অর্থ তারা বিদেশে রেখে দেন। অন্যদিকে আমদানিকারকদের নিকট থেকে সেই অর্থ আদায় করেন। অনেক আমদানিকারক আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি প্রদর্শন করেন। ‘ওভার ইনভয়েসিং’-এর মাধ্যমে এরা দেশ থেকে অতিরিক্ত অর্থ বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন।

উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি আরোও পরিষ্কার হবে। ধরা যাক, একজন জগএ রপ্তানিকারক যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানিতে জগএ রপ্তানি করেন। এখন যুক্তরাষ্টের সেই কোম্পানির সাথে চুক্তি হয়েছে উনি ৫ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করবেন। কিন্তু খাতা-কলমে দেখাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রে ৩ কোটি টাকার পণ্য পাঠিয়েছেন। বাকি ২ কোটি টাকা যুক্তরাষ্টের ঐ কোম্পানি থেকে নিজের অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নিচ্ছেন। এটাকে বলে আন্ডার ইনভয়েসিং।

ওভার ইনভয়েসিং কী?

ধরুন একজন বাংলাদেশি আমদানিকারক জাপান থেকে ৩ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে কিন্তু দেখাচ্ছে যে তিনি জাপান থেকে ৫ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছেন। এখানেও ২ কোটি টাকা জাপানে অবৈধভাবে পাচার করছেন। এটাই হলো ওভার ইনভয়েসিং।

এছাড়া কতিপয় হুন্ডির মাধ্যমেও বাংলাদেশে টাকা অবৈধভাবে আসছে ও যাচ্ছে। এক জরিপে বলা হয় বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের প্রায় এক তৃতীয়াংশ হুন্ডির মাধ্যমে আসে। বাংলাদেশ থেকে যারা সপরিবার ইমিগ্রেট হচ্ছে তাদের সম্পদের অর্থ অবৈধভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে বিশ্বে বিভিন্ন উন্নত দেশে। দেশে যেহেতু অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ অর্থাৎ কালো টাকা বিনিয়োগ বা ব্যবহার করার সুযোগ খুব একটা নেই তাই এই টাকা বিদেশে পাচার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে কালো টাকা এবং অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের তেমন সুযোগ নেই। নির্বাচনের আগের বছর দেশ থেকে মুদ্রা পাচার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় কারণ যারা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে অবৈধ অর্থ উপার্জন করেন তারা নির্বাচনের আগে সেই টাকা বিদেশে নিরাপদে সরিয়ে নিতে চান। এ কারণে দেখা গেছে যে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে দেশে মুদ্রা পাচার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছিল।

এক শ্রেণির জনগোষ্ঠী দেশের বাইরে বা উন্নত দেশে স্থায়ীভাবে এই অর্থ পাচারে লিপ্ত থাকে। এদের মধ্যে অনেক ঋণ খেলাপিও অর্থ পাচারের সাথে জড়িত। সংসদে ১০০ জন সেরা ঋণ খেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে।

মানি লন্ডারিং আইন আছে যা সাম্প্রতি সংশোধন করা হয়েছে তবুও এর যথেষ্ট ফাঁক-ফোকর রয়ে গেছে। তাই এই মামলাগুলো টেকে না।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে মুদ্রা পাচার একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রচলিত কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মুদ্রা পাচার বন্ধ করা যাবে না। মুদ্রা পাচার বন্ধ করতে হলে প্রথমে কালো টাকা বা অবৈধ অর্থ উপার্জনের পথরোধ করতে হবে।

কালো টাকা সৃষ্টির সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অসদুপায় অবলম্বন করা। তাই নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কর্মকর্তা যদি আন্তরিক হন তাহলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং অনেকাংশেই বন্ধ করা সম্ভব। এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে যেকোনো পণ্যের ও সেবার আন্তর্জাতিক মূল্য যাচাই করা সম্ভব।

দেশে দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করতে হবে।

সুপারিশ নয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা দিতে হবে।

আন্তর্জাতিকক্ষেত্রে মুদ্রাপাচার ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপর তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

পরিশেষে, বলতে চাই আমরা যত কিছুই করি না কেন, মুদ্রা পাচারের আসলে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কারণ অর্থপাচারকারীরা কখনোই তাদের পাচারকৃত অর্থের প্রকৃত পরিমাণ কারো কাছে প্রকাশ করে না। তবে পরিস্থিতি যে নিতান্তই নাজুক তা আমরা দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের অর্থসংকট থেকেই বুঝতে পারছি। বর্তমানে আমরা রিজার্ভ সংকটের দিকে যাচ্ছি। পরিস্থিতি পুরোপুরি লাগাম ছাড়া হওয়ার আগেই লাগাম টেনে ধরতে হবে নয়তো আসন্ন ঝড় সাথে জলোচ্ছ্বাসও বয়ে নিয়ে আসবে। মো. রবিউল হাসান : বেসরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়