প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:২৪
মোবাইল ফোন: ডিজিটাল মাদক নাকি আধুনিক জ্ঞান আহরণের সেরা হাতিয়ার?
মোবাইল ফোন: ডিজিটাল মাদক নাকি আধুনিক জ্ঞান আহরণের সেরা হাতিয়ার?
|আরো খবর
মোবাইল ফোন বর্তমান যুগে মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি যেমন জ্ঞান আহরণের একটি চমৎকার হাতিয়ার, তেমনি এর অপব্যবহার অনেক নেতিবাচক প্রভাবও সৃষ্টি করতে পারে। প্রযুক্তির এই বিস্ময় আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সহজ করে তুলেছে, কিন্তু একইসঙ্গে এটি যদি সঠিকভাবে ব্যবহার না করা হয়, তবে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মোবাইল ফোনের ইতিবাচক দিক: ১. শিক্ষার ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের বিপ্লব: মোবাইল ফোন শিক্ষাক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। < b>অভিজ্ঞ শিক্ষকদের অ্যাক্সেস: এখন বিশ্বের সেরা শিক্ষকদের লেকচার মোবাইলের মাধ্যমে পাওয়া যায়। হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানের লেকচার ইউটিউবে সহজলভ্য। অনলাইন লাইব্রেরি: গুগল বুকস, জাস্টোর এবং রিসার্চগেটের মতো প্ল্যাটফর্ম মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জ্ঞান আহরণের সুযোগ করে দিয়েছে।
২. স্বাধীন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি: মোবাইল ফোনে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই সময়মতো পড়াশোনা করতে পারে।
ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম: উদাহরণস্বরূপ, কুরসেরা, উডেমি, এবং খান একাডেমির মতো সাইটগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পছন্দমতো বিষয় শিখতে পারে। ভাষা শেখা: ডুওলিঙ্গো এবং বাবেলের মতো অ্যাপ ভাষা শেখার জন্য অত্যন্ত কার্যকর। ৩. অনলাইন পরীক্ষার সুবিধা: মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সহজেই অনলাইন পরীক্ষা দিতে পারে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের পরীক্ষা এবং ক্লাস মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পরিচালনা করেছে। ৪. ডিজিটাল ডায়েরি এবং রিমাইন্ডার: শিক্ষার্থীরা মোবাইল ফোনে নোটস রাখতে পারে এবং পড়াশোনার পরিকল্পনা তৈরি করতে পারে। < b>রিমাইন্ডার অ্যাপ: টিকটিক এবং গুগল কিপের মতো অ্যাপ কাজের শিডিউল নির্ধারণে সাহায্য করে। ৫. উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশেষ ভূমিকা: উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বই এবং শিক্ষক সহজলভ্য নয়, সেখানে মোবাইল ফোন শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিচ্ছে।মোবাইল ফোনের নেতিবাচক দিক: ১.গেমিং আসক্তি এবং সময়ের অপচয়: অনলাইন গেমিং শিক্ষার্থীদের মনোযোগ হ্রাস করছে। পাবজি, ফ্রি ফায়ার এবং অন্যান্য গেম শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। তারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এবং শারীরিক সক্রিয়তা কমছে। ২. সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব: সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহারে মানসিক চাপ এবং হতাশা বেড়ে যাচ্ছে। ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক এবং স্ন্যাপচ্যাটের মতো প্ল্যাটফর্মে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করলে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নকল সুখ এবং সাফল্যের ছবি দেখে অনেকেই হতাশায় ভোগে। ৩. অনৈতিক বিষয়বস্তুতে প্রবেশাধিকার: ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অবাধে অনৈতিক বিষয়বস্তুতে প্রবেশ করছে। এ ধরনের বিষয়বস্তু শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। ৪. ব্যক্তিগত তথ্যের ঝুঁকি: মোবাইল ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সাইবার অপরাধীদের শিকার হচ্ছে।
ফিশিং অ্যাটাক এবং ডেটা ব্রিচের মতো সমস্যা তাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে ফেলছে।
মোবাইল ফোনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার উপায়: ১. কর্মমুখী ব্যবহারে অভ্যস্ত করা: শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন কর্মমুখী কাজে ব্যবহারে উৎসাহিত করতে হবে। যেমন, ব্লগিং, ভিডিও কনটেন্ট তৈরি বা কোডিং শেখানো। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ফ্রিল্যান্সিং বা ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহারের শিক্ষা দিতে হবে। ২. নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ: মোবাইল ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে তা অনুসরণ করা উচিত। সকালে এবং রাতে পড়াশোনার জন্য আলাদা সময় নির্ধারণ করতে হবে। গেমিং বা বিনোদনের জন্য সীমিত সময় রাখতে হবে। ৩. মনিটরিং এবং পরামর্শ: অভিভাবক এবং শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর নজর রাখা। সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে তাদের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে বোঝাতে হবে। ৪. সাইবার নিরাপত্তা: সাইবার নিরাপত্তা শিক্ষার অংশ করা স্কুল এবং কলেজে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কোর্স চালু করা উচিত। শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে কীভাবে অনলাইনে নিরাপদ থাকতে হয়।
মোবাইল ফোনের উদাহরণভিত্তিক সফলতা: ১. অনলাইন উদ্যোক্তাদের উত্থান: অনেক তরুণ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।উদাহরণ: বাংলাদেশের অনেক তরুণ ইউটিউব এবং ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য বিপণন করে আয় করছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ব্যবসার লেনদেন সহজ হয়েছে। ২. স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব: গ্রামীণ অঞ্চলের মানুষ টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে চিকিৎসা পাচ্ছে। ডাক্তার আছেন: অ্যাপটি দেশের চিকিৎসা সেবা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। জরুরি সেবার জন্য অ্যাপ ব্যবহার করে রক্তদাতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। ৩. সামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা: মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তরুণরা সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে অনলাইনে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ৪. বিশ্ব সংযোগ: মোবাইল ফোন শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা সহজ হয়েছে। বিদেশি বন্ধু তৈরি এবং তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
মোবাইল ফোন এবং কর্মসংস্থান: ১. ডিজিটাল কর্মক্ষেত্র তৈরি: মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম ফ্রিল্যান্সিং কাজে যুক্ত হচ্ছে। আপওয়ার্ক, ফাইভার, এবং পিপল পার আওয়ারের মতো সাইটে কাজ করে তরুণরা বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। ২. কন্টেন্ট ক্রিয়েশন: ইউটিউব এবং টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে কাজ করে অনেকেই সফল কন্টেন্ট ক্রিয়েটর হয়ে উঠেছে ভিডিও তৈরি, এডিটিং এবং প্রমোশনের মাধ্যমে আয় করা সম্ভব। ৩. ডিজিটাল মার্কেটিং: ডিজিটাল মার্কেটিং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ই-কমার্স সাইট পরিচালনায় মোবাইল ফোন একটি অপরিহার্য হাতিয়ার।
মোবাইল ফোনের ভবিষ্যৎ:
মোবাইল ফোনের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অফুরন্ত। নতুন প্রযুক্তি যেমন ৫জি, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং আইওটি (ইন্টারনেট অফ থিংস) মোবাইল ফোনকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে মোবাইল ফোন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার অভিজ্ঞতাকে নতুন মাত্রা দেবে। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি: মোবাইল ফোন ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ক্লাসরুম তৈরি করতে সাহায্য করবে। স্মার্ট লার্নিং: ভবিষ্যতে মোবাইল ফোন শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত লার্নিং অ্যাসিস্ট্যান্টে পরিণত হবে।উপসংহার: মোবাইল ফোন মানুষের জীবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি এর সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত না করলে এটি ক্ষতির কারণ হতে পারে। শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া উচিত, যাতে তারা এর ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগিয়ে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারে। সমাজে মোবাইল ফোনের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের যৌথ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। মোবাইল ফোন যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে এটি ডিজিটাল মাদক নয়; বরং মানব উন্নয়নের জন্য একটি সেরা হাতিয়ার।
প্রতিবেদন: মোঃ জাকির হোসেন, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি।