প্রকাশ : ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৮:৩৯
শিক্ষাজীবনের স্মৃতি

আমি তখন ৩য় শ্রেণিতে পড়ি। বাবার ইচ্ছে ছিল আমি যেনো চাঁদপুরের অন্যতম বিদ্যাপীঠ মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ পাই। বাবার ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যেই শুরু করি প্রচেষ্টা। ভর্তি পরীক্ষার কিছুদিন আগে মায়ের হাত ধরে হাজির হই সেই বিদ্যাপীঠে। ভর্তি-সংক্রান্ত কিছু কার্যাবলি ও প্রবেশপত্রের জন্যে। বিদ্যালয়টির এত সুন্দর পরিবেশ, গাছপালা, সাজানো আঙিনা নিমিষেই আমাকে মুগ্ধ করে। হঠাৎ কেন জানি না আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠি, ‘ইসস্! আমি যদি এই বিদ্যাপীঠে পড়ার সুযোগ পাই’।
২০ ডিসেম্বর, ২০১৭। দিনটি ছিল ভর্তি পরীক্ষার দিন। সবার থেকে দোয়া নিয়ে রওনা দিলাম সেই ইচ্ছে পূরণের পরীক্ষার দিকে। একটা অদ্ভুত ভয় কাজ করছিল ভেতরে। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে শেষ করলাম পরীক্ষা। আমার মনে আছে, পরীক্ষায় গণিত বিষয়ে একটি সময়ের অংক এসেছিলো। হল থেকে বেরিয়ে জানতে পারি আমার উত্তরটি সঠিক হয়নি। বাসায় এসে সে কি কান্না। বাবা-মা রাতে গিয়েছিলো ফলাফল আনার জন্যে। আমিতো কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলেছিলাম, আমি পারিনি। বিদ্যালয়টিতে পড়ার সুযোগ আমি হয়তো হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু হঠাৎই মায়ের ফোন এলো। মা বললো, ‘মা তুমি পেরেছ। তোমার নামটি যারা বিদ্যালয়টিতে অধ্যয়নের সুযোগ পেয়েছে তাদের মধ্যে জ্বলজ্বল করছে’। মায়ের কথাটা শুনে আমি কান্নার মাঝেই হেসে ফেলি। পরদিন খবরের কাগজে আমার রোল নম্বরটি দেখতে পেয়ে বুঝতে পারি যে, আমার দু চোখ দিয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরছে।
প্রথম দিন সেই বিদ্যাপীঠে ছাত্রীরূপে প্রবেশ করা, নতুন বই, সেই বিদ্যাপীঠের নির্ধারিত পোশাক; এত কিছু মনের মধ্যে যে কি আনন্দের সঞ্চার করেছিলো তা সত্যি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আজ আমি সেই মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী। মাঝখানে কতগুলো বছর কেটে গেলো। কত আনন্দই না করেছি এই সময়গুলোতে। বিদ্যাপীঠটি সত্যিই অনেক কিছু দিয়েছে আমায়।
নতুন বছরে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, আমাদের সম্মানিত প্রধান শিক্ষকের নিকট থেকে বই পাওয়ার আনন্দ। দিয়েছে বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান, বিভিন্ন ধর্মীয় ও জাতীয় দিবসগুলো শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিয়ে পালন করার সুযোগ। সবচেয়ে দামি যেটা পেয়েছি, তা হচ্ছে এই বিদ্যালয়টির একজন ছাত্রী হিসেবে নিজের পরিচিতি দিতে পারা। এতো শুধু হাতেগোনা কিছু বিষয়ের কথা বললাম। সত্যি যা পেয়েছি তা কখনো লিখে শেষ করতে পারবো না।
চেয়েছি আমিও যেনো বিদ্যাপীঠটিকে কিছু দিতে পারি। যদিও সেটি খুবই সামান্য হবে। বিদ্যালয়টিকে আমার ফলাফলের মাধ্যমে সেই সামান্যটুকুই যে দিতে পেরেছি, তাতেই একটা প্রশান্তি খুঁজে পাই। জানি সে রকম কিছুই দিতে পারিনি। তবে চেষ্টা করবো ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে এই বিদ্যাপীঠটির নাম একটু হলেও উজ্জ্বল করতে। ভাবতেও অবাক লাগে কীভাবে সাতটি বছর কেটে গেল! বিদ্যালয়ের শিক্ষক-
শিক্ষিকাদের অগাধ ভালোবাসা, স্নেহ, পাঠদান, সহপাঠীদের সাথে অধ্যয়ন, খেলাধুলা কত কিছুই না করেছি। কত স্মৃতিই না জমা হয়েছে মনের গভীরে। আরও কিছু সময়ও পেতাম। পেতাম আরও কিছু স্মৃতি জমানোর সুযোগ। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি।
প্রতি বছর যখন বার্ষিক মিলাদ ও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠানে যেতাম, তখন আপুদের সেই আবেগঘন কথাগুলো সত্যিই হৃদয়ের গভীরে দাগ কাটতো। দেখতে দেখতে আমিও সেই সময়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি আমাকেও কথাগুলো বুঝতে হবে, অনুভব করতে হবে।
পরিশেষে আমার প্রিয় বিদ্যাপীঠ, মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়কে বলতে চাই, সত্যিই তোমাকে ছেড়ে যেতে অনেক কষ্ট হবে আমার। অনেক কিছু শিখিয়েছো তুমি, বুঝিয়েছো তুমি। কাল হয়তো তোমার ছায়া থেকে দূরে চলে যেতে হবে, তবুও তুমি মনে রেখো, আমার মন থেকে তুমি কখনো মুছে যাবে না। তুমি সবসময় জড়িয়ে থাকবে আমার স্মৃতিতে, ভালোবাসায় এবং শ্রদ্ধায়।
সামিরা মেহনাজ নুসরাত : দশম শ্রেণি, মাতৃপীঠ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।