শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫  |   ২৪ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

পরীক্ষাবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতির মস্তিষ্ককে অন্তঃসার করবে

পরীক্ষাবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থা জাতির মস্তিষ্ককে অন্তঃসার করবে
মাহবুবুর রহমান

মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন পরীক্ষা করার জন্য। এ পৃথিবী আমাদের সকলের জন্য একটি বিরাট পরীক্ষার হল। পৃথিবীর আদি মানব-মানবীকে আল্লাহর পরীক্ষার মাধ্যমে এ দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। বেহেস্তে তাদেরকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিলো পরম সুখের উদ্যানে অমৃত সুধা পান করে সময় অতিবাহিত করার জন্য। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস তারা উভয়ে নিষিদ্ধ ফল গন্ধব খেয়ে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ঝামেলাপূর্ণ ও কন্টকাকীর্ণ পরীক্ষাগার এই দুনিয়াতে অবতীর্ণ হতে হয়।

বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার সেক্সপিয়ার এ দুনিয়াকে একটি ড্রামামঞ্চ ও পরীক্ষাগার হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার ভাষায় ‘Life is a struggle, life is not a bed of roses.’

সংগ্রাম ও পরীক্ষার মুখোমুখি হয়ে মানবজাতিকে এ পৃথিবীতে টিকে থাকার দুর্দান্ত প্রয়াস চালিয়ে যেতে হয়। পরীক্ষা মানে শুধু লিখিত ও মৌখিক কতিপয় প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়া নয়। পরীক্ষা মানে হিংস্র প্রাণীর হাত থেকে বাঁচা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করা। আকাশ-পাতাল, বাতাস, বিশ্বভ্রমা- জয় করার দুর্ণিবার অভিযাত্রা। পরীক্ষা মানে সভ্যতার বিকাশ সাধনে ব্রত হওয়া। পরীক্ষা মানে আগুন, বাষ্পীয় ইঞ্জিন, তড়িৎ শক্তি, বিদ্যুৎ শক্তি, যান্ত্রিক শক্তি, রাসায়নিক শক্তি, চৌম্বক শক্তি ইত্যাদি আবিষ্কার পূর্ব কঠিনতর অবস্থার মুখোমুখি হওয়া।

কিন্তু আজ আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষাবিহীন অনাবিষ্কারের লক্ষ্যহীন একটি গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শিশুর সার্বিক বিকাশ সাধনে তাকে সহজ ও কাঠিন্যের মুখোমুখি দাঁড় না করালে সে নিজেকে স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে পুরোপুরি অক্ষম হবে।

পৃথিবীর সভ্যতার বিকাশের সুতিকাগার মরোক্কে স্থাপিত খ্রিস্টপূর্ব ৮৫৯-এ প্রতিষ্ঠিত কারাওইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বর্তমান বিভিন্ন দেশে আধুনিক আদলে প্রতিষ্ঠিত সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মৌখিক, লিখিত, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে বিশ্ববিদ্যালয় এবং তথা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করে কর্মক্ষেত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়।

জন্মগতভাবে প্রত্যেক মানুষের বুদ্ধি, প্রজ্ঞা সুপ্তাবস্থায় থাকে। তাকে প্রাতিষ্ঠানিক, অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষা অর্জন, অভিজ্ঞতা শুদ্ধির জন্য বারবার ভুল প্রয়াসের মাধ্যমে সুপ্ত প্রতিভাকে শাণিত করতে হয়। তারপর মস্তিষ্কে উপাত্ত ও তথ্য সংগ্রহ করত নিজেকে অর্জিত তথ্য ভাণ্ডার বা জ্ঞানের মাধ্যমে পরিচালিত করতে হয়। পৃথিবী নামক গ্রহের উত্তর গোলার্ধে সুমেরু অঞ্চলে বৃহত্তর এশিয়া মহাদেশের আওতাভুক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের অধিবাসী আমরা। এ মহাদেশকে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি, ইংরেজ বেনিয়া, নীলকারকরা তাদের ঔপনিবেশ হিসেবে দীর্ঘদীন শাসন করেছেন। এর পূববর্তী সময়ে সুলতানি, মোঘল, পর্তুগিজদের শাসন আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্লেষণ করলে আমরা পরীক্ষাবিহীন কোনো শিক্ষা মাধ্যমের অস্তিত্ব খুঁজে পাই না।

ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর যে কয়েকটি শিক্ষা কমিশন বা কমিটির সুপারিশ করা হয় তার মধ্যে ক) ভারতীয় স্বাধীনতার পূর্ব সময় ১৮১৩ সালের চার্টার কমিশন; Sir Thomas James Babington Macaulay -এর ১৮৩৫ সালে নিম্ন পরিস্রাবণ নামীয় শিক্ষা কমিশন, ১৮৮২ সালের হান্টার কমিশন (লর্ড রিপনের সময়), ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি কমিশন ১৯০২ (লর্ড কার্জনের সময়), ১৯২৮-২৯ সালের হার্টগ কমিশন; বেঙ্গল অ্যাডুকেশন অ্যাক্ট ১৯৩০ (লর্ড কার্জনের সময়), Abbot wood Report 1937, Sargent Report 1944. পৃষ্ঠা নং ০১

খ) ভারত স্বাধীনতার পরবর্তী সময় গঠিত কমিশনসমূহ যথা : ১৯৪৭ সালের পাকিস্তানের করাচিতে Education reform Committee এর আলোচনা, মাওলানা আকরাম কান কমিশন ১৯৪৯ সালে (রিপোর্ট ১৯৫২), আতাউর রহমান শিক্ষা কমিশন ১৯৫৭; এসএম শরীফ কমিশন (১৯৫৮ জেনারেল আইউব খান উদ্বোধন করেন ১৯৫৯ সালে), এয়ার মার্শাল নূর খান কমিশন ১৯৬৯,

(গ) স্বাধীন বাংলাদেশ সময় গঠিত কমিশনসমূহ যথা : National Education Commission, ড. কুদরাত-ই-খুদা ১৯৭২ (উদ্বোধন ২৪/০৯/১৯৭২ এবং প্রকাশ ৩০/০৫/১৯৭৪ ); National Education Advisery committee 1978 ( Report published 08/02/1979). মাজেদ খান কমিশন ১৯৮৩, বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন ১৯৮৭, Headed by Dr. Mofizuddin Ahmed;

Samsul Haque Education commission 1997; M. A Bari Education Commission 2001 ( Submitted 2002), Bangladesh Education Commission 2003 headed by Mohammad Moniruzzaman Miah (Submitted 2004) এবং সর্বশেষ জাতীয় অধ্যাপক Kabir Chowdhury Education Commission 2009.

এ সকল কমিশন ও কমিটিসমূহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় আজকের বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একদিনে রাতারাতি পরিশুদ্ধ হয়নি। এর ইতিহাস মানব সভ্যতার মতই বহু পুরোনো। ঔপনিবেশিক শাসন, স্বাধীনতার পূর্ব-উত্তর ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা, তারপর পূর্ব পাকিস্তান ও বর্তমান বাংলাদেশে সবকটি শিক্ষা কমিশন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে

১। দেশীয় ভাষায় শিক্ষার মাধ্যমের গুরুত্ব প্রদান।

২। দেশীয় ভাষার পাশাপাশি ইউরোপীয় ইংরেজি ভাষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ।

৩। আরবি ও উর্দু ভাষায় শিক্ষার মাধ্যম।

৪। সার্বজনীন ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি জোরদার।

৫। প্রাথমিক শিক্ষা হবে আট (৮) বছর মেয়াদী, মাধ্যমিক শিক্ষা হবে ৪ (চার) বছর মেয়াদী এবং উচ্চ শিক্ষা ডিগ্রি তিন (৩) বছর, অনার্স চার (৪) বছর এবং মাস্টার্স হবে এক (১) বছর মেয়াদী।

৬। শিক্ষায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীদের অন্তর্ভুক্তিকরন, নারী শিক্ষার প্রসারণ এবং দলিত ও নিম্নশ্রেণির মানুষের জন্য সমান শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন।

৭। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য মানসম্মত প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা।

৮। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সময়োপযোগী কারিক্যুলাম এবং বহুমুখী পরীক্ষার ব্যবস্থা প্রবর্তন।

৯। কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা ব্যবস্থার জোরদার।

১০। মেধার ভিত্তিতে বৃত্তি প্রদান।

উপরোক্ত সুপারিশগুলো হলো সকল কমিশনের সম্মিলিত সুপারিশমালা। যেখানে কোথাও পরীক্ষাকে অনুৎসাহিত করা হয়নি।

সর্বশেষ, শিক্ষার মেঘনাকার্টা নামক খ্যাত ১৮৫৪ সালে স্যার চার্লস উড কর্তৃক প্রবর্তিত Wood’s Despatch -এর সুপারিশ হলো আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার নবসূচণা। Wood’s Despatch বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব আরোপসহ কেজি, নারী ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

কলম্বাস কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন। টমাস আলভা এডিসন অগ্নি পরীক্ষা এবং চরম অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিষ্কার করে আমাদের আলোকিত করেছিলেন। বিজ্ঞানীগণ কঠিন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সভ্যতার জন্য আকাশযান, জলযান, পাতালযান, গ্রহ-নক্ষত্র, নীহারিকা, ছায়াপথ, উল্কাপি-, নভোমন্ডল, বারিমণ্ডল, মহাজাগতিক রশ্মির মত কঠিন বিষয়গুলো আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন এবং মহাসৃষ্টির রহস্য উন্মোচন করে চলছেন। যেমনিভাবে মায়েরা নিশ্চিত ঝঁকিপূর্ণ জীবনের কথা উপেক্ষা করে পরম আশায় গর্ভধারণ করেন এবং আমাদের পৃথিবীকে উর্বর করেন।

আধুনিক জ্ঞানের পিতা সক্রেটিস পথিককে যে প্রশ্নের মুখোমুখি করতেন সে প্রশ্নগুলি পরীক্ষা ভিন্ন কিছু নয়। আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে সমস্ত বিপদণ্ডআপদ, নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি সবই পরীক্ষার আওতায় পড়ে। জীবনে পরীক্ষার মুখোমুখি না হলে সে জীবন ব্যর্থ, নিষ্ফল, অন্তঃসার ও অর্থহীনতার পর্যবসিত হয়।

মোদ্দকথা বলা যায়, একটি দক্ষ, যোগ্য ও নির্ভরশীল জাতি গঠনে শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি নির্ভরযোগ্য পরীক্ষা পদ্ধতির সরব উপস্থিতি থাকা একান্ত প্রয়োজন।

পরীক্ষা না থাকার ক্ষতি

১। শিক্ষার্থীরা কুপ্রবৃত্তির বশিভূত হয়ে পড়বে।

২। শিক্ষার্থীরা অলস, আবিষ্কারের প্রতি অনাগ্রহশীল হয়ে পড়বে।

৩। কারিক্যুলামের বাইরে গিয়ে আলাদা, অনগ্রসর, গোবর-গনেশ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।

৪। সৃজনশীল মনোবৃত্তির ভাটা পড়বে।

৫। পড়াশোনার নৈমত্তিকতা হারাবে।

৬। চ্যালেঞ্জ করার সাহস হারাবে।

৭। মেধা মননশীলতার উৎকর্ষ সাধনের সুযোগ সীমিত হবে।

৮। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে নিজেকে অতল গহ্বরে হারিয়ে ফেলবে।

৯। জাতি মেধাহীন, অশিক্ষিত. অভিশপ্ততার মত করাল গ্রাসে নিমজ্জিত হবে।

সর্বোপরি লোহাকে পুড়িয়ে কাজে লাগাতে হয়। সোনাকে আগুনে জলসে নিখাত করতে হয়। শিশুদের পরীক্ষার মাধ্যমে চেতনায় আগুন ধরিয়ে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে আত্মনির্ভরশীল, সাহসী, ঝুঁকি গ্রহণের মনোবৃত্তি সৃষ্টি করে উপযুক্ত জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের নিমিত্তে পরীক্ষা ব্যবস্থাকে অক্ষুন্ন রেখে কিভাবে এর নিখুঁত এবং নির্ভরযোগ্য Version হিসেবে তৈরি করা যায়, সে বিষয়ে আমাদের আরও ভাবা দরকার।

সুপারিশসমূহ :

১। Constructed Response Questionaire (CRQ) কাঠামোবদ্ধ প্রশ্নের প্রতি জোরদার।

২। পুরো সিলেবাস থেকে কোন বিকল্প ছাড়াই প্রশ্ন করতে হবে। যাতে করে শিক্ষার্থীদের পুরো বই আত্মস্থ করতে হয়। শিক্ষার্থীরা যদি পুরো সিলেবাস নাই পড়ে তাহলে যে অংশ সে বাদ দিলো, সে যদি ডাক্তার হয় তাহলে সে ওই অংশে উল্লিখিত রোগের চিকিৎসা করতে পারবে না। সে যদি ইঞ্জিনিয়ার হয়, তাহলে সে ওই অংশের ডিজাইনে ভুল করবে। এভাবে সিলেবাসের কোন অংশ বাদ যাওয়া মানেই শিক্ষার্থীর বিদ্যায় ঘাটতি বা ফুটো থেকে যাওয়া।

৩। পরীক্ষার মাধ্যম লিখিত ও মৌখিক, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক, ধারাবাহিক এবং সামষ্টিক পদ্ধতিতে নেওয়া। তাহলে বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিক্ষার্থীদের Heterogeneously যাচাই করা যাবে এবং তাদের versatile Knowledge -এর অধিকারী করে গড়া সম্ভব হবে।

৪। পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি হবে নমনীয় যাতে কোন শিশু ঝড়ে না পড়ে এবং পরীক্ষা ভীতি পাছে সৃষ্টি হয়।

৫। পরীক্ষা পদ্ধতি এমন হবে যাতে শিক্ষার্থীরা গতানুগতিক মুখস্থ পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করতে না পারে।

লেখক : মাহবুবুর রহমান, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর।

মোবাইল : ০১৭৬৮-৯৬৯৬২০। ইমেইল: [email protected]

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়