প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০
শিক্ষক সাক্ষাৎকার : মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান
শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ভালো হওয়া খুবই জরুরি
৩১ বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান। বর্তমানে তিনি চাঁদপুর সরকারি কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি এ বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনে বহু শিক্ষার্থীকে পাঠদান করেছেন গুণী এ শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের নিজ সন্তানের মতো আদর-স্নেহে গড়ে তুলেছেন আদর্শিক সুনাগরিক হিসেবে। যাদের অনেকেই বর্তমানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
|আরো খবর
সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থীদের একজন সমাজকর্মী হিসেবে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা পারিপাশির্^ক জীবনের প্রতি দায়িত্ব পালনে ভূমিকা রাখতে নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সহকর্মীদের সাথে আন্তরিকতা ও সমন্বয় বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বন্ধুবৎসল, সদালাপী গুণী এ শিক্ষক সম্প্রতি দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের ‘শিক্ষাঙ্গন’ বিভাগের মুখোমুখি হন।
সাক্ষাৎকার নেন আলআমিন হোসাইন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কেমন আছেন?
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : আলহামদুলিল্লাহ, মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে বেশ ভালো আছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : ৩১ বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে দীর্ঘ ৩১ বছর শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশায় নিয়োজিত রেখেছেন এজন্য আমি শোকরিয়া আদায় করছি। দীর্ঘ এ শিক্ষকতা জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পার করেছি। কখনো হাল ছাড়িনি। মহান আল্লাহর উপর ভরসা রেখে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেছি। কখনো অন্যায়ের কাছে মাথানত করিনি। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ, বাকি কর্মজীবন যেনো সুস্থ থেকে সম্মানের সাথে সমাপ্ত করতে পারি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষকতা পেশায় কিভাবে এলেন?
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : আমার বাবা শিক্ষক ছিলেন। বাবা যখন পড়াতেন, তখন আমার মনে হতো শিক্ষার্থীরা খুব ভালোভাবে তা আত্মস্থ করতে পারছে। শিক্ষার্থীরা আমার বাবাকে খুবই সম্মান করতো। এজন্যে আমি নিজেও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স পাস করে ১৬তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আত্মনিয়োগ করি। আলহামদুলিল্লাহ, বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার প্রিয় শিক্ষক কে? কেন প্রিয়?
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : আমার প্রিয় শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের আবদুল মোমেন স্যার। স্যার, অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। শিক্ষাজীবনে স্যারের প্রতিটি কথা ও উপদেশ আমার চলার পথের পাথেয়। স্যার মুখে ও মনে এক ছিলেন। স্যার অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষক হিসেবে প্রথম দিন কেমন কেটেছে?
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : শিক্ষক হিসেবে প্রথম দিন আনন্দ ও ভয়ে কেটেছে। দীর্ঘ ছাত্রজীবনের অবসান ঘটিয়ে শিক্ষক হিসেবে পদার্পণ করি। শিক্ষার্থীদের মাঝে নিজের আহরিত-অর্জিত জ্ঞান বিতরণে নিজেকে প্রস্তুত বলে মনে আনন্দ অনুভব করি। নিজের স্বপ্নপূরণের সেদিনের স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াই। বাবার মতো শিক্ষক হয়েছি, সে আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। একই সাথে খুবই ভয়ে ছিলাম। কারণ, ঠিকমতো শিক্ষার্থীদের পাঠ বোঝাতে পারবো কি না সে ভয় মনে ছিলো। তবে মহান আল্লাহ আমাকে সে ভয় কাটিয়ে বিজয়ের দিশা দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত পাঠগ্রহণ আমার সেই ভয় দূর করতে সক্ষম হয়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনি বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি কলেজে কর্মরত আছেন। এ বিদ্যানিকেতন সম্পর্কে কিছু বলুন।
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : চাঁদপুর সরকারি কলেজ জেলার সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ। কলেজের নান্দনিক পরিবেশসহ শিক্ষাদানের পরিবেশ বেশ উন্নত, মানসম্মত ও সুন্দর। মেঘনাপাড়ের এ বিদ্যাপীঠে জেলার অসংখ্য শিক্ষার্থীসহ আশপাশের জেলার শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে। কলেজের মনোরম পরিবেশে শিক্ষার্থীরা আনন্দের সাথে পাঠগ্রহণ করে থাকে। কলেজে সুবিশাল মাঠসহ রয়েছে ইনডোর-আউটডোর খেলার ব্যবস্থা। দৃষ্টিনন্দন বাস্কেটবল গ্রাউন্ড রয়েছে। বিপুল বই-সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার রয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত উল্লেখযোগ্য জাতীয় দৈনিকসহ স্থানীয় পত্রিকার মাধ্যমে প্রতিদিনের বিশ্ব সম্পর্কে জানতে পারছে। গ্রন্থাগারে বসে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞানের পিপাসা নিবারণের সুযোগ পায়। সবচেয়ে বড় কথা, চাঁদপুর সরকারি কলেজ ছাত্ররাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত। এজন্যে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপিকে ধন্যবাদ জানাই। একই সাথে কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর অসিত বরণ দাশ স্যারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শিক্ষকবৃন্দ নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনি সমাজকর্ম বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিজের বিভাগ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : সমাজকর্ম বিভাগ চাঁদপুর সরকারি কলেজের সবচেয়ে বড় বিভাগ। এ বিভাগে আসনসংখ্যা ২০০। এ ২০০ আসন পরিপূর্ণ হয়েও অনেক শিক্ষার্থী এ বিভাগে ভর্তি আবেদন করে থাকে। আমি মনে করি, সমাজকর্ম বিভাগ চাঁদপুর সরকারি কলেজের মধ্যে অন্যতম বিভাগ। শিক্ষার্থীরা আমাদের কথা মতো নিয়মিত পড়াশোনা করছে। ফলে তারা ভালো ফলাফল অর্জন করতে সক্ষম হচ্ছে। এ বিভাগে দায়িত্বরত আমার সহকর্মীবৃন্দ যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। এ বিভাগে আমার সহকর্মী হিসেবে রয়েছেন সহকারী অধ্যাপক মোঃ আলমগীর হোসাইন, সহকারী অধ্যাপক নাসিদ সিফাত ও প্রভাষক নূরুন নাহার। সহকর্মীদের সহযোগিতায় আমি খুব সহজেই দায়িত্ব পালন করতে পারছি। অফিস সহকারী মোঃ মিজানুর রহমান নিষ্ঠার সাথে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
চাঁদপুর কণ্ঠ : এ বিভাগ নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : আমরা সুশিক্ষিত সুনাগরিক গড়ার মাধ্যমে দুর্নীতিমুক্ত স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে চাই। শিক্ষার্থীরা যেনো যথাযথভাবে শিক্ষাগ্রহণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়ে দেশের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করতে পারে, আমরা সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : কী কী প্রতিবন্ধকতা দূর হলে এ বিভাগটি আরো অগ্রসর হতো বলে আপনি মনে করেন?
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : আমাদের প্রতি ব্যাচে নির্দিষ্ট আসনসংখ্যা পূরণ হওয়ার পরও অধিক শিক্ষার্থী সমাজকর্ম বিভাগে ভর্তি হতে চায়। এটা আনন্দের খবর। তবে এ বিভাগে শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সঙ্কট রয়েছে। উল্লেখযোগ্য এ দুটি প্রতিবন্ধকতা দূর করা জরুরি। তাহলে বিভাগটি আরো অগ্রসর হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সমাজকর্ম বিভাগের সহ-পাঠক্রমিক কার্যক্রম সম্পর্কে কিছু বলুন।
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থীরা সহ-পাঠক্রমিক বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখছে। দেয়ালিকা, বির্তক, আবৃত্তি, শিক্ষাসফর, ফুটবল, ভলিবল, বিষয়ভিত্তিক রচনা প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতায় শিক্ষার্থীরা নিয়মিত অংশ নিয়ে থাকে। এতে শিক্ষার্থীদের মনোজগতের উন্নতি হচ্ছে। এছাড়া রোভার স্কাউটসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে আমাদের শিক্ষার্থীরা যুক্ত রয়েছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সমাজকর্ম বিভাগের ফলাফল সম্পর্কে কিছু বলুন।
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : প্রতি বছর সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভালো ফলাফল অর্জন করছে। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণসহ মেধাতালিকায় কৃতিত্বের সাক্ষর রাখছে। যারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে ভূমিকা রাখছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : এ বিভাগে আপনার সহকর্মীদের বিষয়ে জানতে চাই।
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : আমার সহকর্মীরা খুবই আন্তরিক ও বন্ধুবৎসল। তাঁরা সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করেন। বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে তাঁরা আমাকে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেন। শিক্ষার্থীদের সহজ ও সাবলীলভাবে পাঠদানে আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করি। নিজেদের মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় করি। এতে পরস্পর সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ভালো হওয়া খুবই জরুরি। এতে শিক্ষার মান উন্নত হয়। একই সাথে ভালো ফলাফল অর্জন করা সম্ভব হয়। আমাদের সমাজকর্মে ‘র্যাপো’ তথা পেশাগত সম্পর্ক নামে একটি কথা আছে। ঠিক আমি মনে করি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক র্যাপোর মতো হওয়া উচিত। আমার বিশ্বাস, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক যতোই মধুর হবে সেই বিভাগের লেখাপড়াসহ সার্বিক অবস্থার মান ততোই বৃদ্ধি পাবে। একজন শিক্ষার্থীর পাঠগ্রহণের যে কোনো সমস্যায় শিক্ষকের শরণাপন্ন হওয়া জরুরি। একই সাথে একজন শিক্ষকেরও উচিত, শিক্ষার্থীর সমস্যার কথা অনুধাবন করে সে অনুযায়ী সমাধানের পথ বাতলে দেয়া। তবেই পড়ার প্রতি শিক্ষার্থীর আগ্রহ বাড়বে এবং শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর ভক্তি-শ্রদ্ধা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : একজন শিক্ষার্থীর প্রধান কাজই হলো পড়াশোনা করা। তাই পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে হবে। পাশাপাশি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি তার দায়বদ্ধতা পূরণ করা। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা যাবে না। নিজের ধর্ম যথাযথভাবে পালন করতে হবে। সহপাঠী বন্ধুদের সাথে ভালো আচরণ করতে হবে। পরস্পর সহযোগিতামূলক পরিবেশ বজায় রেখে পড়াশোনা করবে। যে কোনো সমস্যায় শিক্ষকদের শরণাপন্ন হতে হবে। শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। শিক্ষকদের সাথে অসদাচরণ করা যাবে না। শিক্ষার্থীদের পরমতসহিষ্ণু হতে হবে। মানুষের সাথে আন্তরিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতে হবে। একই সাথে জঙ্গিবাদসহ দেশবিরোধী কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : অবসর সময় কী করেন?
মুহাম্মদ ইয়াহ্-ইয়া খান : অবসরে সমাজ নিয়ে গবেষণা করি। যেহেতু আমি একজন সমাজকর্মী, তাই সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করি। সমাজসেবামূলক কাজে আনন্দ অনুভব করি। পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা পূরণের চেষ্টা করি। পরিবারকে সময় দিই।