প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
শিক্ষাবান্ধব শিক্ষক প্রয়োজন
আশিকুর রহমান হিমেল
নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে সে শহরের বড় নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। দীর্ঘ দুই বছর ধরে পড়াশোনা চলছে অসুস্থ দিনমজুর বাবার হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙার টাকায়। মা অন্যের বাসায় কাজ করে সংসার চালায়। বাবা ফোন দিলেই বলেন, হিমেল তোর পড়া শেষ হতে আর কতদিন বাপ? কিন্তু হিমেল প্রত্যুত্তরে বলে দেয়, ‘এই তো বাবা আর কয়েক দিন’।
|আরো খবর
অথচ হিমেল দুই বছরে একটা সেমিস্টার শেষ করতে পেরেছে মাত্র। সেশনজটের কবলে পড়ে নিজেকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। অভিযোগ, অনুনয়গুলো জমে থাকে নিজের মধ্যে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য তরুণ প্রজন্ম তথা শিক্ষার্থীদের সুশিক্ষা দিয়ে রাষ্ট্রের কল্যাণে গড়ে তোলা। এটি শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা চর্চার স্থান। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের একটা অংশ হিসেবে জুড়ে থাকে শিক্ষকরা। বলা হয়ে থাকে, শিক্ষকরা পিতৃতুল্য কিন্তু পূর্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেরূপ শিক্ষক ছিলেন বর্তমান তেমন শিক্ষক রয়েছে কি? শিক্ষকের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত শিক্ষার্থীকে যথাসময়ে সুশিক্ষা দিয়ে সন্তানের মতো গড়ে তোলা, কিন্তু বর্তমান সিংহভাগ শিক্ষকই শিক্ষকতার মতো মহান পেশার উদ্দেশ্য ভুলে গিয়ে শিক্ষকতাকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে।
এমন শিক্ষকসমাজ শিক্ষার্থীর চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থের কথাই বেশি চিন্তা করে। প্রতিটি শিক্ষক শিক্ষার্থীর অভিভাবক। পরিবারে অভিভাবক যেমন তার নিজ সন্তানের কোনো সমস্যা দেখলে চুপ থাকতে পারে না তেমনই শিক্ষার্থীদের যথাসময়ে সুশিক্ষা ও সব সমস্যায় পাশে থাকা শিক্ষকের দায়িত্ব। কোনো শিক্ষক যখন দায়িত্বকে তোয়াক্কা না করে শিক্ষকতার সংজ্ঞা ভুলে গিয়ে এটি পেশা হিসেবে বেছে নেয় তখন সে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। এর ভয়াবহ পরিণাম ভোগ করে শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষকের মর্যাদার সঙ্গে যেমন শিক্ষার মানের সম্পর্ক জড়িত, তেমনই শিক্ষার প্রসারে শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষকের বিকল্প নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিকাংশ শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্যের দুষ্টুচক্রে অযোগ্য, অসাধু ব্যক্তিরা জায়গা পায় ফলে প্রকৃত শিক্ষকরা যোগ্য স্থানে আসতে পারে না। যেখানে শিক্ষকরা মহান পেশায় প্রবেশ করেন নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে, সেখানে শিক্ষার্থীদের তারা কী শেখাবেন তা নিয়ে সন্দিহান। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনার সময়সীমা চার বছর পর্যন্ত থাকলেও কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে তা নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না।
একজন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি কিংবা ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠিত করবে এই উদ্দেশ্যে। কিন্তু শিক্ষকদের ক্লাসে অনুপস্থিতি, পরীক্ষা নিতে অনীহাসহ নানা অজুহাতের ফলে নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস শেষ করতে পারে না। এতে অতিরিক্ত সময় গুনতে হয় শিক্ষার্থীদের, যাকে আমরা ‘সেশনজট’ নামের অভিশাপ হিসেবে জানি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু অসাধু শিক্ষক নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে অনুপস্থিত থেকে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সান্ধ্যকালীন কোর্সে ব্যস্ত কিংবা পরিবারে সময় ব্যয় করলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে ক্লাস-পরীক্ষা পিছিয়ে শিক্ষার্থীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো নষ্ট করে।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০, জুডিশিয়ারিতে ৩২ বছর পর্যন্ত। অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো অসাধু, পেশাদার শিক্ষকের কবলে পড়ে অবলীলায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা হ্রাস পায়, ফলে অনেক শিক্ষার্থী তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন পূরণে ব্যর্থ হয়। শিক্ষকদের এমন অসচেতনতায় শিক্ষার্থীরা হতাশ, দুশ্চিন্তা ও আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে ওঠে।
শিক্ষার্থীদের এমন পরিস্থিতিতেও তাদের স্নায়ুর উদ্বেগ ঘটে না বললেই চলে, তাহলে শিক্ষককে শিক্ষা দেবে কে? আজকের কিছু শিক্ষক তাদের নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে ফেলেছে। তারা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়ে যথাসময়ে সুশিক্ষাদানে ধারে-কাছেও আসছে না। শিক্ষকদের এমন আচরণ ও শিক্ষাবিমুখ ভাবনার তুষানলে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। কিছু শিক্ষক নানা অজুহাতে যথাসময়ে ক্লাস-পরীক্ষা নিতে না পারলেও বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম শিক্ষকতা করে। এর ফলে নিজ বিভাগের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঠিক সময়ে সিলেবাস শেষ করতে না পারায় পরীক্ষা নিতে পারে না।
বিগত ৭ জানুয়ারি ২০২২-এ ‘পাবলিকিয়ান পরিবার’ নামে পেইজে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের এক শিক্ষার্থী সেশনজটের অভিশাপে তার জীবন বিপন্ন, এমন হতাশা ও দুশ্চিন্তায় আত্মহত্যার মতো মারাত্মক পথে পা বাড়ানোর অভিপ্রায় নিয়ে স্ট্যাটাস দেয়। এমন অবস্থায় শিক্ষার্থীরা কার কাছে যাবে, কার কাছে নিজের সমস্যা তুলে ধরবে? আদৌ কি তারা শিক্ষার্থীদের ভাষা বুঝতে শিখেছে নাকি পেশাদারিত্বের খাতিরে শিক্ষকতা করে! শিক্ষকদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব ও কলহের দরুন বাড়তি সময় যোগাতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষকরা রাজনীতি করবে কিন্তু এর দায় শিক্ষার্থীরা কেন নেবে? শিক্ষকদের ভিন্ন আদর্শ থাকতে পারে, তারা বিভিন্ন মতাদর্শের রাজনীতি করতে পারে তবে সেটা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে নয়। প্রতিটি শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে স্বপ্ন বুনে আসে, শিক্ষকদের এমন রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, নিজেকে সেরা প্রমাণসহ বিভিন্ন কারণে তা ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাইভেটের তুলনায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ে।
তারা স্বপ্ন দেখে যথাসময়ে পড়াশোনা শেষ করে দ্রুত একটা চাকরি নিয়ে মা-বাবা ও পরিবারের দায়িত্ব নেবে। কিন্তু কিছু অসাধু শিক্ষকের অসদাচরণের ফলে তাদের সেই স্বপ্ন ছুঁতে অপেক্ষা করতে হয় বছরের পর বছর, নয় তো সেই স্বপ্নের অস্তিত্ব হারিয়ে যায় সময়ের কাছে। শিক্ষকদের টালবাহানা আর নানা অজুহাতে শিক্ষা কার্যক্রমের নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকলেও তা মেনে শিক্ষাদানের কোনো নমুনা নেই। ছয় মাসের সেমিস্টার এমন অনিয়ম, অজুহাতে বছরে গিয়ে অতিক্রান্ত হয়। মাসের পর মাস পরীক্ষা না নিয়ে শিক্ষার্থীদের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা হ্রাস করে। অসচেতন শিক্ষকের উদাসীনতায় ঝরে যায় অসংখ্য মেধাবীর স্বপ্ন, তবুও অসাধু শিক্ষকদের স্নায়ুর বিকাশ ঘটে না।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস-২০১৯-এ শিক্ষকদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেছিলেন : একজন শিক্ষকের সবচেয়ে বড় গুণ শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে তাকে বোঝানো, তার অন্তরকে বোঝার মাধ্যমে তাকে ভালোবেসে বোঝানো। কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন শিক্ষকতার অভাববোধই আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক এখন রসহীন। সর্বোপরি, শিক্ষার্থীদের এমন দুর্দশা থেকে মুক্তির জন্য হলেও শিক্ষকদের জবাবদিহিতার জায়গা তৈরি করা ও নিয়োগ বাণিজ্য বন্ধ করে অসাধু শিক্ষকের আসনে সচেতন ও শিক্ষার্থীবান্ধব শিক্ষক নিয়োগ জরুরি।