প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:৩২
৪৮ ঘন্টা পর ইলিশ আহরণে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা
ইলিশ শিকারে সাগরে আন্তঃমহাদেশীয় অভিন্ন নিষেধাজ্ঞা চান মৎস্যজীবীরা
ইলিশ প্রজননের প্রধান মৌসুম হিসেবে ইলিশের নিরাপদ প্রজনন নিশ্চিত করতে আর মাত্র ৪৮ ঘন্টা পর শুরু হচ্ছে ২২ দিনের মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান। আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশের প্রজননের জন্যে ইলিশ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই সময়ে দেশব্যাপী ইলিশ পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুদ ও বিনিময়ও সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ থাকবে বলে সরকারি সিদ্ধান্ত হয়েছে । তবে সাগরে একই সময়ে অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতে ‘ট্রান্স বাউন্ডারি’ অর্থাৎ আন্তঃমহাদেশীয় অভিন্ন নিষেধাজ্ঞা চান মৎস্যজীবীরা।
|আরো খবর
বাংলাদেশের ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, আহরিত ইলিশের প্রায় ৮০ ভাগ মাছ পরিভ্রমণ করে বাংলাদেশের জলসীমানায়। এই ইলিশ প্রতিদিন ৭২ থেকে ৭৪ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করার সক্ষমতা রাখে। তারা কোনো ভৌগোলিক বাউন্ডারি বা সীমারেখা মানে না। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে লাগে না কোনো ভিসা। ফলে সে স্বাধীনভাবে চলাচল করে। বাংলাদেশের জলসীমানা থেকে সহজেই ভারতে চলে যায় । ফলে ইলিশ গবেষকগণ
ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ একটি স্ট্যান্ডার্ড লেভেলে নির্ধারণ করেন। তাই বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশ ভারতকেও এই নিষেধাজ্ঞার সময়টিতে ইলিশ আহরণ বন্ধের বিষয়টি মানা উচিত। তাহলে ইলিশের প্রাচুর্যে সবাই লাভবান হবে। এমনই মত প্রকাশ করেন বাংলাদেশের ইলিশের গবেষকগণ। দেশের ইলিশ সম্পদ নিয়ে কাজ করা গবেষকদের মধ্যে ড. আনিসুর রহমান প্রায় ৩৩ বছর যাবত ইলিশের জীবন চক্র, পরিভ্রমণসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে কাজ করছেন।
তিনি এ বিষয়ে বলেন, প্রজনন মৌসুমে নিষেধাজ্ঞা অনুসরণ করলে ইলিশ স্বাধীনভাবে চলাচল করবে। বাংলাদেশ ও ভারতের জলসীমা ইলিশে ভরে যাবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের মেঘনা নদীর যেখানে নিরাপদে ইলিশ মাছ প্রজননের জন্যে নিরাপদ বেসিন মনে করে প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন, জাটকা সুরক্ষায় ৬০দিন এবং মাছের বৃদ্ধির জন্য সাগরে ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয় --এ সকল স্থানের বিষয়ে আমাদের অভিন্ন মত একান্ত জরুরি। যেহেতু কমন জলাশয় অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরেই ইলিশের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র, তাই সাগরে অভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সময়কালটি আমাদের সমন্বয় হওয়া দরকার। এজন্যে উভয় রাষ্ট্র মিলে একমত হওয়া প্রয়োজন।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতির সভাপতি মানিক জমাদার বলেন, বঙ্গোপসাগর থেকেই বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার ইলিশ আহরণ করে থাকে। সাগরে অভিন্ন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি আমরা বহু বছর যাবত সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে জানিয়ে আসছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফলস্বরূপ বাংলাদেশের মৎস্যজীবীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, আমরা মৎস্য বিভাগকে বলছি ‘ট্রান্স বাউন্ডারি’ অর্থাৎ আন্তঃমহাদেশীয় অভিন্ন নিষেধাজ্ঞা নির্ধারণ করার জন্যে। কিন্তু তা না হওয়ায় বরং আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
মানিক জমাদার আরো বলেন, মূলত গভীর সমুদ্রে ইলিশ শিকার করে ট্রলি জাহাজ। তারা অত্যাধুনিক সিস্টেম ব্যবহার করে সোয়াস অব নোগ্রাউন্ড পর্যন্ত মৎস্য শিকার করে। তাদের ক্ষেত্রে সাগরে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও ম্যানুয়াল ট্রলার দ্বারা সাগর উপকূল ও মেঘনার মাঝ বরাবর থেকে মৎস্য আহরণ তাদের জন্যে বুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে শত শত ম্যানুয়াল ট্রলার ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট মৎস্যজীবীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ও নদী কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কাওসার দিদার বলেন, প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় অক্টোবর-নভেম্বরে ২২দিন, ইলিশের পোনা জাটকা রক্ষায় মার্চ-এপ্রিল ৬০ দিন বাংলাদেশের মেঘনাসহ আরো কিছু নদীতে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়। অন্যদিকে ইলিশ বৃদ্ধির সময় বাংলাদেশের সাগর উপকূলে ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়।
জনাব কাউসার দিদার আরো বলেন, মে মাসের প্রথম দিকে ভারতে বঙ্গোপসাগর উপকূলে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয় । এরপর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই বাংলাদেশে ৬৫ দিন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়। প্রজনন মৌসুমে ট্রান্স বাউন্ডারি অর্থাৎ আন্তঃমহাদেশীয় অভিন্ন নিষেধাজ্ঞা বঙ্গোপসাগরে কার্যকর করা হলে বাংলাদেশ-ভারত সমভাবে উপকৃত হবে। তবে এই বিষয়গুলো দেখভাল কিংবা কার্যকর করার ক্ষেত্রে দেশের উচ্চ পর্যায়ে অর্থাৎ কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছালে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্র উপকূলের মৎস্যজীবীরা উপকৃত হবে।
চাঁদপুরের কান্ট্রি ফিশিং বোট মালিক সমিতির সভাপতি শাহ আলম মল্লিক বলেন, একই সাগর থেকে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মৎস্যজীবীরা মাছ শিকার করেন। অভিন্ন নিষেধাজ্ঞা না থাকায় বাংলাদেশে যখন নিষেধাজ্ঞা থাকে, সেই সময় ভারতের জেলেরা প্রচুর পরিমাণে মাছ শিকার করেন। অনেক সময় তারা বাংলাদেশের জলসীমানায়ও বিচরণ করে থাকে। তাই সাগরে অভিন্ন নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হলে উভয় দেশ লাভবান হবে ।
সর্বোপরি গবেষকদের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণ এবং এই সকল সময়ে সংশ্লিষ্ট জেলেদের জন্যে তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হলে হয়তো এ বিষয়ে সুফল পাওয়া যেতো এবং এই সুফল শুধু একাই এক পক্ষের নয়, একদিকে জেলেদের অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেতো বলে জানান সংশ্লিষ্ট সকলে।