প্রকাশ : ০৭ নভেম্বর ২০২২, ১৩:৫৩
আমদানি পণ্যে উপর নির্ভরতা কমাতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে তাদের নিজেদের জন্য খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন এবং যেকোনো সংকট মোকাবিলায় রফতানি বাড়ানোর পাশাপাশি আমদানি নির্ভরতা কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন। আমদানি পণ্যে নির্ভরতা কমাতে দেশবাসীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান
রোববার (৬ নভেম্বর) রাতে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা একাদশ জাতীয় সংসদের ২০তম অধিবেশনে তার সমাপনী ভাষণে বক্তব্য রাখেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ সময় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমদানি পণ্যের ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে এবং আমাদের সকলেরই এ চেষ্টা করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। নিজেদের উৎপাদনটাকে ধরে রাখতে হবে। আর আমদানি করা পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। সাথে সাথে রফতানি বাড়াতে হবে, যে জন্য সরকার বিভিন্ন ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
‘বিশ্ব মন্দার মধ্যেও সরকার অর্থনীতিটাকে ধরে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং এ জন্য সকলকে কৃচ্ছ্রতাসাধন করতে হবে এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানির ব্যবহারে মিতব্যয়ী হতে হবে। প্রতিটি পরিবারকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কেননা ইউরোপের অনেক উন্নত দেশে রেশনিং চলছে এবং এ শীতে বিদ্যুৎ ব্যবহার সীমিত রাখতে তারা নতুন পরিকল্পনা করছে। কাজেই আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে এবং আগে থেকেই যে কোনো অবস্থার জন্য তৈরি থাকতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের এ মুহূর্তে যে জিনিসটার খুব বেশি প্রয়োজন নেই সেই বিলাসদ্রব্য আমদানি কমাতে হবে। আর এর ওপর আমাদের ট্যাক্সও বসাতে হবে বেশি করে।’
বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে বিরোধী দলের উপনেতার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘আমাদের মোট সরকারি ঋণ জিডিপির ৩৬ শতাংশ। আর বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর অন্তত এতটুকু বলতে পারি আমরা কোনো দিনও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হইনি। আমরা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করে যাচ্ছি। আমরা ঋণ খেলাপি (লোন ডিফল্টার) হইনি কখনো। আর ভবিষ্যতেও ইনশাল্লাহ হব না।’প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বিপর্যস্ত অর্থব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশ আলাদা নয়। বাংলাদেশকেও তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এ সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে। কারণ প্রতিনিয়ত ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে। কাজেই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষ করে যাদের খাদ্য পণ্য, জ্বালানি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে তারাও সংকটে পড়েছে। এরপরেও আমি বলব আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
দেশের মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করে তাদের চাহিদা সরকার পূরণের চেষ্টা করে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারপরেও চাপ রয়েছে; কেননা পণ্য উৎপাদনেও ভতুর্কির পরিমাণ অস্বাভাবিক রকম বেড়ে গেছে।
তার সরকার করোনার মধ্যে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট দিতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মাথাপিছু আয় হয়েছে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার, যেটা বিএনপি আমলে (২০০৫-০৬) অর্থবছরে ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার। পাশাপাশি বাজেটে উন্নয়ন খাতে সরকার ২ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে সক্ষম হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বাজেটের খাত ওয়ারি বরাদ্দের পরিমাণ বিশ্ব মূল্যস্ফীতির কারণে বেড়ে গেছে উল্লেখ করে বেশকিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতে আমাদের ভর্তুকি ধরা ছিল ১৭ হাজার কোটি টাকা, আজকে সেখানে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হয়ে প্রয়োজন হয়েছে ৩২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ দিতে গেলে এ ভতুর্কি দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি তেলে অতিরিক্ত ভতুর্কি লাগছে ১৯ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। খাদ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ভতুর্কির প্রয়োজন হচ্ছে ৪ হাজার কোটি টাকা। টিসিবি বা অন্যান্য জনবান্ধব কর্মসূচিতে ভর্তুকি লাগছে ৯ হাজার কোটি টাকা। কেননা এক কোটি মানুষকে বিশেষ কার্ড দিয়ে সরকার স্বল্পমূল্যে খাদ্য পণ্য সরবরাহ করছে। সার ও কৃষিপণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত ভর্তুকি লাগছে ৪০ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা। তার মানে শুধু ভর্তুকির চাহিদা বেড়েছে এক লাখ ৫ হাজার ১০৫ কোটি টাকা।
সরকার প্রধান এ সময় বিশ্ব বাজারে পণ্য মূল্য বাড়ার কিছু উদাহরণ টেনে বলেন, ডিজেলের ব্যারেল প্রতি মূল্য ১৩২ ডলার বা তার বেশি থেকে প্রায় ১৭০ ডলার হয়েছে। গ্যাস সরবরাহে নভেম্বর মাসে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘন মিটারেই ১০ টাকা ৬০ পয়সা হারে ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে। এলএনজিকে প্রতি ঘনমিটারে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে ৪৮ টাকা। সেভাবে ইউরিয়া সার ৭৫ টাকায় কিনে দিতে হচ্ছে ২২ টাকায়, টিএসপি ৫৯ টাকায় কিনে কৃষক পর্যায়ে দিতে হচ্ছে ২২ টাকায় এবং অন্যান্য সারও এভাবে উচ্চমূল্যে ক্রয় করে ন্যায্যমূল্যে কৃষককে সরবরাহ করতে ভর্তুকি বহুগুণে বেড়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত এক বছরে বিশ্ব বাজারে চিনি, মসুর ডালসহ অন্যান্য খাদ্য পণ্যের মূল্য বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, যার অধিকাংশই আমাদের আমদানি করে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে একই সময়ে চাল, গম, আটার মূল্য বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনের ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
এত কিছুর পরও দেশে ১৫ লাখ ৭৩ হাজার ৪৮৫ মেট্রিক টন খাদ্য মজুত রয়েছে বলে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।কাজেই আমাদের চিন্তার কিছু নাই। ইতোমধ্যে ৫ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন চাল আগাম আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এ জন্য ভারত, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে এবং কিছু চুক্তিও হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সরকারপ্রধান আরও বলেন, এরই মধ্যে ৯ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন গম আমদানির কার্যক্রম চলছে এবং চুক্তি করা চাল ও গম দেশে আসা শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে রাশিয়া তার বাধাটা সরিয়ে নেয়ায় ইউক্রেনসহ ঐ অঞ্চল থেকে পণ্য আমদানি শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী রিজার্ভ নিয়ে বিরোধী দলের উপনেতার বক্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, উনি একটি হিসাব দেখিয়েছেন, যেখানে শুধু খরচটাই দেখিয়েছেন। কিন্তু আয়টা যুক্ত করেননি। আমাদের কিছু আয় আছে, সেটাও বাস্তব।
তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে জুলাই-অক্টোবরে রফতানি আয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি। আর একই সময়ে (চলতি অর্থবছরে জুলাই-অক্টোবরে) প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) এসেছে ৭.২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি। একই সময়ে আমদানি ঋণপত্র খোলা হয়েছে ২২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ৭ বিলিয়ন কম। কেননা তখন ডলারের দাম কম ছিল; কাজেই ঋণপত্র খোলার দায়টা এখন আমাদের নিতে হচ্ছে। কারণ এখন ডলারের দাম বেড়ে গেছে। সেটা পরিশোধটাও অতিরিক্ত চাপ। তবে, অতীতের ঋণপত্র খোলার যে ঘাটতি বা চাপ সেটা ২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হয়ে যাবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। জানুয়ারি ২০২৩ থেকে ডলারের সংকট নিরসনেও তার সরকার বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়েছে বলে জানান তিনি।
রিজার্ভের হিসাব প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা জানান, ’৯৬ সালের ২৩ জুন সরকার গঠনের সময় তিনি রিজার্ভ পেয়েছিলেন ২.১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তার সরকার ক্ষমতায় এসেই সেই রিজার্ভকে প্রায় ৪ বিলিয়নের কাছাকাছিতে উন্নীত করে। এরপর দ্বিতীয়বার সরকারে আসে ৬ জানুয়ারি, ২০০৯ তারিখে, তখন রিজার্ভ ছিল ৫.৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৮ জানুয়ারি, ২০১৪ তারিখ যখন টানা দ্বিতীয় এবং মোট তৃতীয় বারের মত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে তখন রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ১৭.৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করেছে। এরপর চতুর্থ দফা এবং টানা তৃতীয় দফায় সরকার গঠনের সময় ৭ জানুয়ারি, ২০১৯ রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ায় ৩২.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ৩০ জুন, ২০২০ তারিখে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬.০৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তিনি আরও বলেন, ৩০ জুন, ২০২১ তারিখে আমাদের রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬.৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; আর ৩০ জুন, ২০২২ তারিখে ৪১.৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। করোনার সময় আমদামি-রফতানিসহ অন্যান্য ব্যয় প্রায় বন্ধ থাকায় তা প্রায় ৪৮ বিলিয়নে উঠে গিয়েছিল। পরবর্তীতে আমদানি বৃদ্ধি, সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বস্তবায়ন এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ফলে রিজার্ভ কিছুটা কমে বর্তমাতে ৩ নভেম্বর, ২০২২ রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩৫.৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের যে রিজার্ভ আছে সেই রিজার্ভে অন্তত ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যদি ৩ মাসের আমদানি পরিমাণ রিজার্ভ থাকে, তাহলে সেটাই যথেষ্ট। এটা হলো বাস্তবতা।