প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিপ্লবী লেনিনের কৌশলই বিপ্লবীদের চেতনা
অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে লেনিন সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করলে সমালোচকগণ এক হাত নিয়েছেন। তারা বলেছিলেন, ‘মহাজাগতিক অঙ্কের ব্লু প্রিন্ট’। বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের সে আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছিল। বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের অভ্যন্তরীণ অসহযোগিতা ও বিশ্ব পুঁজিবাদী পক্ষ থেকে অপপ্রচার মহাপ্রাচীর তৈরি হয়ে গিয়েছিল ইতোমধ্যে।
দেখা গেলো, সাইবেরিয়ায় লেনিন একটা সাঁজোয়া ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে বহু কষ্টে জীবন শত্রুর কবল থেকে রক্ষা করেছিলেন। বিকেলের মিডিয়াতে নিউজ হয়ে গেলো, ভয়ংকর ট্রটস্কি লেনিনকে জেলে পুরে শিকলে বেঁধে রেখেছেন, আর মস্কোয় সেই জেলের গরাদের ওপাশ দিয়ে লেনিন চেয়ে রইলেন। অথচ পুরো ব্যাপারটাই মিথ্যে ছিলো।
লেনিনের স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়া ‘লেনিনের শিক্ষা’ নামক ছোট একটি পুস্তিকা লিখেন। লেনিন সম্পর্কে কিছু ধারণা এ বই থেকেও পাওয়া গিয়েছে। লেনিনের মধ্যে যে সাংগঠনিক প্রতিভা আছে এটা তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া যায় বলে ক্রুপস্কায়া এ বইতে উল্লেখ করেন।
লেনিনের দাদা, বাবা, মা, বড় ভাই-বোন প্রায় সকলেই বিপ্লবের কাজে জড়িত ছিলেন। লেনিন তার ছোট ভাই-বোনদের ভালোবাসতেন মনপ্রাণ দিয়ে। আনন্দ করতেন, খেলা করতেন। এ রকম প্রভাব ফেলতে লেনিন তার সন্তানদের ওপরও নির্দেশনা দিতেন। লেনিনের স্ত্রী নাদেজদা ক্রুপস্কায়া বলেন, যার জন্য তাঁর নিজের জীবন উৎসর্গীকৃত, ছেলেমেয়েদের মধ্যে তিনি দেখতেন সে আদর্শের অনুসারীদের। ছেলে-মেয়েদের সাথে আলাপ করতে করতে মাঝে মধ্যে তিনি বলে বসতেন, প্রশ্ন হিসেবে নয়, নেহাতই যেন তার মনের ভাবটুকু প্রকাশ করছেন এইভাবে, বড় হয়ে তোমরাতো কমিউনিস্ট হবে, তাই না?
আর এদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখবো, সিমন দলিলে লেনিনকে সা¤্রাজ্যবাদের প্রধান পদলেহনকারী, কাইজারের ভাড়াটিয়া অনুচর- এসব উল্লেখ ছিল পুরোদস্তুর মতো। লেনিনকে হাজির করা হলো ভয়ঙ্কর রূপে- রক্তপিপাসু, দানব এবং বিনাশী হিসেবে। এমনকি তার আমলে অপপ্রচার করতে লাগলো লেনিন আমলের রাশিয়ানরা। তারা অপপ্রচার করতেন মরা কুকুরের মাংস ছুরি নিয়ে কাটছে, পরে তা দগ্ধানো হচ্ছে। শুধু তাই নয়, লেনিনকে চরম বিলাসী হিসেবে উপস্থাপন করলো। লেনিন চীনা অনুচরদের আতিথেয়তায় এশিয়ায় বেশ আমোদণ্ডপ্রমোদে আছেন। তার নাকি ফলের বিলই উঠতো প্রতিদিন ২ হাজার রুবলের বেশি। উপরোক্ত বিষয়গুলো লেখক আলবার্ট রিস উইলিয়াম ‘লেনিন- মানুষটি এবং তাঁর কর্মযজ্ঞ’ বইটিতে তুলে ধরেন।
আলবার্ট রিস লেনিনের বিপ্লবী কাজের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তার বিপ্লবী কাজে সহায়ক হিসেবে পথ চলেছিলেন। তিনি লিখেন, ‘আমি লেনিনের কাছে এসেছিলাম আমেরিকা থেকে একজন সমাজতন্ত্রী হিসেবে। আমি তাঁর সঙ্গে একই ট্রেনে চেপেছি, একই মঞ্চে থেকে বক্তৃতা করেছি, দু মাস মস্কোর ন্যাশনাল হোটেলে থেকেছি তারই সঙ্গে। বিপ্লবের সময়ে যতবার তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলাম তাঁর বিবরণ দিলাম’।
আমেরিকান এ লেখক মুগ্ধমনে লেনিনকে দেখলেন একজন বিপ্লবী হিসেবে, লেনিন ভক্তদের দেবতা হিসেবে। আলবার্ট রিস উইলিয়ামস আমেরিকার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী রেমন্ড বরিন্স-এর উদ্ধৃতি টেনে লিখেন, “আমেরিকায় ফিরে ফ্লোরিডায় নিজের বিরাট জমিদারিতে একটা জ্যান্ত ‘ওক গাছ’ পুঁতে তার নাম রেখেছিলেন ‘লেনিন বৃক্ষ’।”
এই গাছটি বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে লেনিনের প্রতি তার এ সম্মান দিনের পর দিন বেড়ে চলে। রবিনস ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন এবং প্রতি রবিবার নিজের জমিদারিতে বন্ধুদের শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ শ্রমিকদের দিয়ে ধর্মোপদেশ দিতেন। যেভাবেই আরম্ভ হোক না কেন, প্রায় সবসময়ই লেনিনের প্রজ্ঞা আর মহাপ্রতিভার উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে সেটা শেষ হতো। সৌভাগ্যক্রমে এসব ধর্মোপদেশ বা বক্তৃতা রেকর্ড করা আছে।
এ প্রবন্ধে লেনিনের বৈপ্লবিক জীবনের চুম্বক কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরার প্রয়াস চালাবো। নাদেজদা ক্রুপস্কায়া লেনিনের স্ত্রী। বিপ্লবী জীবনের একান্ত সঙ্গী। বিপ্লব করতে করতেই প্রেম বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে এ দুজনের। এ যুগল প্রেম গণপ্রেমে ভেসে গেলো। দুজনের উচ্ছ্বাস রাশিয়ান সর্বহারাদের মুক্তিতে আলিঙ্গন করলো।
লেনিন ১৮৭০ সালের ২২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। রাশিয়ার ভলগা নদীর তীরেই তার জন্ম হয়েছিল। শহরটির নাম সিমবির্¯‹। কৈশোরকাল প্রায় সবটাই এখানে কাটান। মানে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত। লেনিন-নামটি মূলত ছদ্মনাম। এটাই বিশ্ববুকে ‘একমাত্র বারুদ’ প্রেরণা হয়ে উঠলো। তার আসল নাম উলিয়ানভ। গণআন্দোলনের মধ্য দিয়েই ‘লেনিন’ নামটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। লেনিনের স্মৃতি রক্ষার্থে তার জন্মস্থান সিমবির্¯‹ নামকরণ হয়েছে উলিয়ানভস্ক। এটা একপর্যায়ে বিদ্যাপীঠের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে।
লেনিনের পিতা ইলিয়া নিকলায়েভিচ ছিলেন নিম্ন মধ্যবিত্ত। সাত বছর বয়সে লেনিন তার বাবাকে হারান। বড় ভাইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় লেখাপড়া করতে সমর্থ হন। লেনিনের বাবা খুব মেধাবী ছিলেন। তিনি শিক্ষকতা করতেন। পেনজা কলেজে পদার্থবিদ্যা ও গণিত বিষয়ে ক্লাস নিতেন। পরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিদর্শকের পদ নেন। সর্বশেষ ডিরেক্টর পদে উন্নীত হন। লেনিনের বাবা একজন বিপ্লবী ছিলেন। ১৮৫৬ সালে কৃষকদের জন্যে ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।
ছেলেবেলায় লেনিন মার্কসের লেখা পড়ে আকৃষ্ট হন। তিনি উপলব্ধি করেন, পিছিয়ে থাকা রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। লেনিনের প্রিয় জায়গা ছিল লাইব্রেরি। লাইব্রেরি জীবন তার জ্ঞানের আধার। লাইব্রেরিতে অধ্যয়ন করে লেনিন নিজেই একটা প্রতিষ্ঠিত লাইব্রেরি হয়ে যান। লেনিনের বাবাও একজন পড়ুয়া ছিলেন। তার বাবা যতো বই কিনতেন সবক’টি বই তিনি পড়তেন। লেনিন জিমনেশিয়াম লাইব্রেরিতে সময় কাটাতেন। সেই লাইব্রেরির অধ্যক্ষ ছিলেন রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কেরেনেস্কির পিতা ফ.ম কেরেনেস্কি। একসময় লেনিনই কেরেনেস্কিকে হটিয়ে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করেন।
লেনিন ছোটবেলায় ভালো সাহিত্য রচনা করতেন। প্রধানমন্ত্রী কেরেনেস্কির পিতা ফ.ম কেরেনেস্কি জিমনেসিয়ামের উদ্যোগে সাহিত্য রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। লেনিনের রচনা পড়ে ফ.ম কেরেনেস্কি বলেন, এসব কি নিপীড়িত শ্রেণির কথা লিখেছো? কী তাদের কাজ? এ রচনায় লেনিন কত নম্বর পেলেন, তা জানতে লেনিন খুব কৌতূহলী ছিলেন। পরে দেখা গেল লেনিনই সর্বোচ্চ নম্বর পেলেন।
লেনিনরা ছিলেন ৬ ভাই-বোন। এরা হলেন : আন্না, আলেক্সান্দ, ভ্লাদিমির, ওলগা, দমিত্রি আর মারিয়া। ওলগার সাথেই খেলা করতেন লেনিন। ১৮৯১ সালে ওলগা টাইফাস রোগে মারা যান। লেনিনের বড় ভাই আলেক্সান্দ্র এলজন বিপ্লবী ছিলেন। লেনিন তার দ্বারা প্রভাবিত হন। আর এদিকে ‘ইস্ক্রা’ কবি দলের সদস্য ছিলেন আন্না ও আলেক্সান্দ্র। এ কবিদল সে সময়ে ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।
লেনিনের দাদা ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনি ইউক্রেনের অধিবাসী ছিলেন। তিনি স্থানীয় চাষীদের চিকিৎসা করতেন। তিনি ছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের সার্জন। লেনিনের মা সন্তানদের শিক্ষার প্রতি বেশ মনোযোগী ছিলেন। সেজন্যে তিনি লেনিনকে জার্মান ভাষা শেখাতে উদ্যোগ নেন। পরে জার্মান ভাষাসহ লাতিন আমেরিকার অন্যান্য ভাষা শেখার দিকেও মনোনিবেশ করেন।
লেনিনের রাজনৈতিকভাবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কার্লমার্কসের পুঁজি বইটাই মূলত প্রধান প্রেরণা। লেখক চের্নিশভেস্কির লেখাগুলোও তাকে নিয়ে আসেন উচ্চমাত্রার চিন্তা করার ক্ষেত্রে। সে থেকেই দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ মার্কসের দিকে ঝুঁকে পড়েন। লেনিনের চার বছরের বড় তার ভাই আলেক্সান্দ্র একটা গোপন পার্টি করতেন। এ বিপ্লবী পার্টির নাম ‘নারোদনায়া ভলিয়া’। রাজা হত্যার চক্রান্তে আলেক্সান্দ গ্রেফতার হন।
ভাই গ্রেফতার হলে পরে বোন আন্নাকেও গ্রেফতার করা হয়। আলেক্সান্দের প্রাণদণ্ড হয় ৮ মে। লেনিনের ভাই আলেক্সান্দ্রকে মুক্তির জন্যে পরিবারের পক্ষে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করেন। কিন্তু এ আবেদন নাকচ হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও লেনিনের মা শঙ্কিত না হয়ে আরও জ্বলে ওঠেন। ছেলে-মেয়েদের বিপ্লবী কাজে উৎসাহ দেন, সহযোগিতা করেন।
লেনিন নারোদবাদের সাংগঠনিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তকে রুশ বিপ্লবের জন্যে অকার্যকর ভেবে তিনি তার বিপ্লবী কাজকে এগিয়ে নেন। মার্কসের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে সাংগঠনিক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
ঊনিশ শতকের সপ্তম দশকে রুশ বিপ্লবের পূর্বে একজন শক্তিশালী বিপ্লবী চিন্তাবিদ ছিলেন। তার নাম চের্নিশেভস্কিও হেৎসেন। এরা পুঁজিবাদের অবসান চাইতেন, একটা উন্নত সমাজব্যবস্থা চাইতেন। গড়ে তুলতে চাইতেন শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা। কিন্তু বিপ্লবের পথ তাদের জানা ছিলো না। সে কারণে তাদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হটকারিতায় পরিণত হতো।
১৬৬৩ সালে চের্নিশেভস্কিকে সামাজিক ফাঁসি দেয়া হয়। পোল্যান্ড, বেলারাশিয়া, লিথুনিয়ায় কৃষক বিদ্রোহ ঘটানো ছিল তার অপরাধ। এ অজুহাতে জার সরকার পোল্যান্ডে বিদ্রোহ দমন করে। বহু নেতাকে জেলে পুরেন। অনেককে নির্বাসনে দেন। মূল নেতা চের্নিশেভস্কিকে সামাজিক ফাঁসি দেন। এ রকম ফাঁসির চরিত্র হলো, প্রকাশ্যে জনতার সামনে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করিয়ে মাথায় তরবারি ভাঙ্গা। এরপর দণ্ডভোগের জন্যে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে দেয়া।
যাই হোক, এক পর্যায়ে কল্পস্বর্গীয় সমাজতন্ত্রীদের পদক্ষেপ ভেস্তে যেতে লাগলো। অতঃপর ব্যর্থ হলেন কল্পস্বর্গীয়রা। আর এদিকে কল-কারখানা গড়ে উঠতে লাগলো। ১৮৬১ সালে ভূমি সংস্কার হলে ভূমিদাস প্রথার পতন হয়। পুঁজিবাদের উন্মেষ ঘটে। দেখা গেছে, ১৮৯০ সালে শিল্পকারখানা দ্বিগুণ হয়ে গেলো। এর আগে ১৮৮৫ সালে শ্রমিক আন্দোলনের এক ব্যাপক আয়োজন ব্যাপৃত ছিল। সে সময় মরোজভ মিলে শ্রমিক ধর্মঘট হয়। ৮ হাজারের বেশি শ্রমিক পিসরেট অনুযায়ী বেতনের দাবিতে আন্দোলন সংঘটিত করলো। এ আন্দোলনে ৬ শ’ শ্রমিক গ্রেফতার হন। এদের মধ্য ৩৩ জনকে আদালতে সোপর্দ করা হয়। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে লেনিন মার্কসবাদকে পুরোপুরি আয়ত্তে আনেন। ১৮৮৮ সালে কাজানে তিনি মার্কসবাদী একটি ইউনিটে অংশ নেন। এ সময় মার্কস-এঙ্গেলসের লেখা পড়ে তিনি বেশ প্রভাবিত হন এবং মার্কসবাদকেই জীবন দর্শন হিসেবে নেন। (তথ্যসূত্র : রুশ বিপ্লবের ইতিহাস, মনজুরুল আহসান খান)
লেনিন পিটারসবুর্গের শ্রমিকদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করতে লাগলেন। তাদেরকে পরিচর্যা করতে লাগলেন আপন মনে। শ্রমিকদের বাসায় গিয়ে মার্কসবাদ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করতেন। পাশাপাশি শ্রমিকদের অভাব-অভিযোগ শুনতেন। বেশ মনোযোগী ছিলেন শ্রমিক-কর্মচারীদের পড়াশোনার প্রতি। ১৮৯৩ সালে তিনি সামারা থেকে পিটার্সবুর্গে এসে উপরোক্ত কাজগুলো সম্পাদন করতে লাগলেন।
নারোদবাদী যারা কল্পিত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, এদের বিরুদ্ধে লেনিন চরম আঘাত আনলেন তার মসৃণ লেখনীর মধ্য দিয়ে। এ সময়ে প্লেখানভের ভূমিকাও বেশ তৎপর ছিলো। একপর্যায়ে গিয়ে লেনিন-প্লেখানভের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। লেনিন দেখালেন বিপ্লবের প্রধান মৈত্রী হবে শ্রমিক-কৃষকের। শ্রমিক-কৃষকরাই হবে বিপ্লবের মূল শক্তি। প্লেখানভ মনে করতেন, রাশিয়ায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রধান শক্তি হবে উদারনৈতিক বুর্জোয়ারা। লেনিন তার নীতিতে অটল থেকে পিটার্সবুর্গের মার্কসবাদীদেরকে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান। তিনি মার্কসবাদ সাধারণ শ্রমিকদের মাঝে ছড়িয়ে দিলেন। কিন্তু এ সময়ে অর্থনীতিবিদগণ শ্রমিকদেরকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিলেন। লেনিন এসবের বিরোধিতা করেন।
পিটার্সবুর্গের ‘লীগ অব স্ট্রাগল’-এর অন্যতম নেতা ছিলেন বিপ্লবী ক্রুপস্কায়া। তিনি একটি পার্টি গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিকদের সাথে আলোচনা করেন। এ সময় লেনিন সাইবেরিয়ার নির্বাসনে। রুশ সোশ্যাল ‘ডেমোক্রেটিকদের কর্তব্য’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। লেখাতে তিনি একটি মার্কসবাদী পার্টি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন করেন। এ সময় ক্রুপস্কায়াও সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত হন। এ সময়কালে লেনিন-ক্রুপস্কায়ার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। একপর্যায়ে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। (তথ্যসূত্র : রুশ বিপ্লবের ইতিহাস, মনজুরুল আহসান খান)। যাই হোক অবশেষে এ দুজনের প্রচেষ্টায় ‘রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি’ গঠন হয়ে গেলো।
ঊনিশ শতকের শুরুর দশকে গোটা বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে রাশিয়াতেও মারাত্মক প্রভাব পড়ে। দেশের বহুসংখ্যক কল-কারখানা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের হাতে চলে যায়। প্রায় তিন হাজার ছোট বড় শিল্প-কারখানা এ সময় বন্ধ হয়। এ সুযোগে সা¤্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি রাশিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করলো। আবার এদিকে পারস্য, চীন, মাঞ্চুরিয়া ও মঙ্গোলিয়া প্রভৃতি দেশে জার সরকার ক্ষমতা বিস্তার করতে লাগলো। তাদের উপর শোষণ চালালো নির্বিঘ্নে। এমতাবস্থায় রুশ সা¤্রাজ্যবাদ প্রায় ১৫ কোটি রুবল বিদেশে লগ্নি করলো। জার সরকার ও পুঁজিপতিরা দেশ-বিদেশে শোষণ চালালো গলাগলি করে।
লেনিন জার শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে পেশীগত সংগ্রাম ও মনোগত সংগ্রাম দুটোকেই প্রাধান্য দিলেন। সে কারণে তিনি মার্কসবাদকে আরও প্রসারিত করতে খবরের কাগজ প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। সে মোতাবেক ১৯০০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইস্ক্রা’ (স্ফুলিঙ্গ) প্রকাশ করেন। ইস্ক্রার মাধ্যমেই পার্টির কর্মসূচিগুলো প্রকাশ হতো। তার এ পদক্ষেপে তৎসময়ের অর্থনীতিবিদগণ ব্যাপক সমালোচনায় মগ্ন হয়ে গেলেন। তারা মনে করতেন, শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বকে রীতিমতো কটাক্ষ করতেন। সে কারণেই লেনিন ‘কী করিতে হইবে’ এ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। ইস্ক্রা বিরোধীদের প্রশ্নের সমুচিত জবাব দেন লেনিন। তিনি বলেন, “সর্বহারা শ্রেণি সংগ্রামে তাদের পার্টি হচ্ছে একমাত্র বিপ্লবী হাতিয়ার। অতএব, এ পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ এবং সুসংগঠিত করতে হবে। সমস্ত রাশিয়াজুড়ে বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন সকল মার্কসবাদী চক্রকে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে কেন্দ্রীভূত করতে হবে একটি মাত্র বিপ্লবী পার্টিতে। কিন্তু ইস্ক্রা বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের বিরোধিতা করে এবং পার্টিকে দুর্বল ও আগের মতো অসংগঠিত করে রাখতে চায়।” (তথ্যসূত্র : অক্টোবর বিপ্লব ও রুশ কমিউনিস্টদের রণকৌশল-- জে ভি স্ট্যালিন)।
লেনিন স্থির করেন, প্রথমে রাজনৈতিক ক্ষমতা জয় করতে হবে, আর অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে মার্কসীয় আদর্শ ছড়িয়ে দিতে হবে। লেনিন সমাজতন্ত্র গড়নে শক্তিশালী নিয়ামক মনে করেছেন বৃহদায়তন যন্ত্রশিল্প। এতে করে কৃষিকেও পুনর্বিন্যাস করা যায়। প্রযুক্তির অগ্রসরতা ও শিল্পযোজনকে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। শিল্পযোজন কর্মনীতি ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ কর্মধারা। আর পুঁজিতন্ত্রকে নিঃশেষ করতে কৃষিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এটাকে ঋদ্ধ করতে কৃষিভিত্তিক প্রযুক্তিতে গুরুত্ব দিয়েছেন।
লেনিন নারোদবাদীদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে নিন্দা ও বিরোধিতা করেছেন। ভূমিদাস প্রথার বিরুদ্ধে, অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে অর্জিত বিজয়ের সুযোগ বুর্জোয়ারাই নিয়েছিল, যা নারোদবাদীরা মেনে নিতে পারেনি। (তথ্যসূত্র : নারোদবাদের অর্থনৈতিক মর্মবস্তু, ভি আই লেনিন)।
লেনিন নারোদবাদীদের ‘অর্থনৈতিক মর্মবস্তু’ গ্রন্থে বলেন, “...এই নারোদবাদীরা তাদের পেটিবুর্জোয়া চরিত্র শেষবারের মতই উন্মোচন করেছেন। শ্রেণি-সংগ্রাম বুঝতে না পারার চরম অক্ষমতাজনিত কারণে তুচ্ছ, মধ্যবিত্ত সংস্কার নিয়ে তাদের জিদ তাদেরকেই উদারনৈতিক দলে নিক্ষেপ করেছে।”
মার্কসের ‘পুঁজি’ বইটি আত্মস্থ করে লেনিন ‘রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ’ বইটি রচনা করেন। এ বইটি ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি এ বইতে দেখিয়েছেন, রাশিয়ায় পুঁজিবাদ উন্নতির ক্ষেত্রে শিল্পের পাশাপাশি কৃষিতেও জোরদার হচ্ছে।
লেনিন ‘অর্থনীতিবাদ’-এর বিরোধিতা করেন। অর্থনীতিবাদ হলো একপ্রকার সুবিধাবাদ। এ সংক্রান্ত একটি প্রচারপত্রমূলক গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯০১ সালে ‘কী কবিতে হইবে’ এ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। মার্কসবাদের ভিত্তিতে পার্টির বিভিন্ন পর্যায়গুলোকে শক্তিশালী করতে এ বইটি বেশ কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল।
১৯০৪ সালে প্রকাশ করেন ‘এক পা আগে দুই পা পিছে’ গ্রন্থটি। পার্টির অভ্যন্তরীণ মেনশেভিকদের বিপ্লব বিরোধী মনোভাব। মার্কসবাদ বিরোধী পদক্ষেপের সমালোচনা করে এ বইটি রচনা করেন। তিনি রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনের নীতি-কৌশল এখানে ব্যাখ্যা করেন। মেনশেভিকদের বিপদসমূহকে বিশ্লেষণ করেন সপাটে। এতে লেনিন কংগ্রেসের প্রস্তুতি, কংগ্রেসের বিভিন্ন জোট-বাধাবাধির তাৎপর্য, ভাষার সমধিকার সংক্রান্ত ঘটনাটি, পার্টির নিয়মাবলি, সুবিধাবাদীদের মিথ্যে অভিযোগে নির্দোষীদের দুর্ভোগ, কংগ্রেসের পরেকার অবস্থা ও সংগ্রামের দুটি পদ্ধতি প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করেন।
১৯০৫ সালে লেনিন প্রকাশ করেন ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির দুই রণকৌশল’ গ্রন্থটি। এ বইটিকে সরকারবিরোধী অপরাধভিত্তিক কর্মকাণ্ড আখ্যা দিয়ে জার সরকার নিষিদ্ধ করেন। এটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব রচনা করতে মার্কসবাদকে এগিয়ে নেন। এতে করে মার্কসবাদ আরও সুসংহত অবস্থায় পরিদৃষ্ট হয়। এখানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মৌলিক দিকগুলো ফুটিয়ে তোলেন।
মার্কসবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রশ্নের সম্মুখীন হন তিনি। মার্কসবাদী বিরোধীদের প্রকৃতি টেনে ধরতে লেনিন ১৯০৯ সালে ‘বস্তুবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদী সমালোচনা’ বইটি রচনা করেন। এই বইটি লিখতে গিয়ে তিনি জেনেভা শহরের গ্রন্থাগারে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ফল্গুধারার বিপরীতে যারা অবস্থান নিয়েছিলেন এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা তুলে ধরা লেনিনের একটি অপূর্ণাঙ্গ একটি দর্শন তত্ত্বের বই প্রকাশ করেন ১৯১৩ সালে। ‘দার্শনিক নোট বই’ হলো একটি। এ গ্রন্থে তিনি দার্শনিক কার্লমার্কস, হেগেল ও ফয়েরবাখের দার্শনিক বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি ১৯১৪ সলে লিখেন জাতিসমূহের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। এটি একটি রাজনৈতিক প্রচারপ্রক্রিয়া।
১৯১৬ সালে ‘সা¤্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ বইটি লিখেন। বিশ শতকে পুঁজিবাদ নতুনভাবে বিকশিত হওয়ার দিকগুলো তুলে ধরেন। সা¤্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক মর্মার্থ, বিরোধ ও ধ্বংসের অনিবার্যতা এ গ্রন্থে লেখা হয়।
১৯১৭ সালে বিপ্লবোত্তর ‘এপ্রিল থিসিস’টি লিখেন। সমাজতান্ত্রিক সমাজ অগ্রসরের ক্ষেত্রে এ গ্রন্থটির ভূমিকা অত্যাবশ্যক ছিল। একই বছর তিনি ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। সামজতন্ত্র ও সাম্যবাদকে লেনিন সাম্যবাদী সমাজ বিকাশের দুটি আলাদা পর্যায় হিসেবে মনে করেন। এতে দেখান, সমাজতন্ত্রই হয়ে উঠবে সাম্যবাদের বিকশিত দিক।
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও মার্কসবাদকে বিরূপ সমালোচনা করেছেন কার্ল কাউৎস্কি। তিনি মার্কসবাদী মতবাদকে ‘একনায়কত্ব’ আখ্যা দেন। এর প্রতিবাদে লেনিন ১৯১৮ সালে ‘প্রলেতারিয় বিপ্লব ও দলদ্রোহী কাউৎস্কি’ এই বইটি লিখে সুবিধাবাদের ওপর চরম আঘাত করেন।
বলশেভিক পার্টি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, নেতৃত্বে দোষাবলি, মার্কসবিরোধী কর্মকাণ্ডের সংশোধন ও নির্দেশনা দেখিয়েছেন ‘কমিউনিজমে’ বামপন্থার শিশুরোগ বইটিতে। এটি ১৯২০ সালে প্রকাশ হয়।
সমাজতন্ত্র সম্পর্কে লেনিনের নির্দেশনাগুলোর আজও আবশ্যকতা রয়েছে। অক্টোবর বিপ্লবের পর সমাজতন্ত্রের সফলতা ব্যাখ্যা নিয়ে লেনিন সর্বস্তরে আলোচনা ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে ১৯১৭-১৯২২ সাল ছিলো মূল সময়কাল। এ সময়ে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেন। সেগুলো ছিল বেশ সমসাময়িক। ১৯২২ সালে লেনিন স্ট্রোক করেন এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। লেনিন এ অবস্থায় উপলব্ধি করেন তার ভবিষ্যৎ বাঁচা-মরা নিয়ে। তখন তিনি মৃত্যু নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। লেনিন যাতে মানসিক শ্রম না করে- এ নিয়ে ডাক্তারদের পরামর্শ ছিল।
লেনিনের লেখনীর কৌশলগুলো ছিল বৈচিত্র্যময়। তিনি নিজের মত নিজেই ব্যক্ত করতেন আবার তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করতেন। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে তার ‘এপ্রিল থিসিস’ ছিলো যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তিনি এখানে সন্তর্পণে দেখিয়েছেন, গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষকদেরকে অধিক হারে পাওয়া যাবে ঠিক, কিন্তু বিপ্লব সংঘটিত হবে না। কৃষক মজুর-শ্রমিক শ্রেণির পক্ষে থাকতে পারে, ধনী কৃষক বরাবর শত্রু হবে এবং মধ্য কৃষক হবে দোদুল্যমান। তার লেখনিতে স্ট্যালিনকেও তিনি ছাড় দেননি। ‘কর্মই ভালো, তবে ভালো’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে স্ট্যালিনকে সমালোচনা করা হয়েছে তির্যকভাবে। স্ট্যালিনের সহযোগী কুইবিশেভ ‘প্রাভদা’ পত্রিকায় না ছাপানোর অনুরোধ করেন।
লেনিন যখন লক্ষ্য করলেন বিপ্লবের পর বলশেভিক পার্টি শাসক দলে পরিণত হয়েছিলো, পার্টির মধ্যে সুবিধাবাদী চরিত্র বিরাজ করছিল এবং ক্ষমতা প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বৈষয়িক সুবিবধাদীর চর্চা শুরু হয়ে গেলো, সে সময় তিনি রচনা করেন ‘বামপন্থী কমিউনিজমণ্ডশিশুদের রোগ’ গ্রন্থটি।
১৯২২ সালে লেনিন অসুস্থ হয়ে পড়লে স্ট্যালিনকে সহযোগিতা করেন ঝিনোভিয়েও ও কামেনেভ। এ দুজনও পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। সাতজন পলিটব্যুরোর সদস্যের মধ্যে অপরাপর সদস্য ছিলেন লেনিন, ট্রটস্কি স্ট্যালিন, সোকোলনিকভ এবং বুর্বায়েভ। এ সময় কিনোভিয়েও ও কামেনেভ স্ট্যালিনের পক্ষ নিয়ে ট্রটস্কির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
লেনিনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাশক্তির দুর্বার গতি আসে মার্কসের বস্তুবাদ ও ভাববাদের দ্বন্দ্ব থেকে। রাজনীতি এবং অর্থনীতির আলাদা করে বিচ্ছিন্ন বৈশিষ্ট্য লেনিন দেখেননি। একটি আরেকটির পরিপূরক হিসেবে দেখেছেন বলেই তিনি দর্শনগত দিক নিয়ে অভিমত দেন যে, ‘সাম্প্রতিক দর্শন দু হাজার বছর আগে দর্শন যে পরিমাণ বিবাদরত ছিল, তারই অনুরূপ। বিবাদরত দলগুলো অপরিহার্যভাবেই ছিল বস্তুবাদ ও ভাববাদ। এখানে লেনিনের এ বক্তব্যটিও মার্কসের চিন্তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। লেনিনের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী জ্ঞানতত্ত্বে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হন। প্রথমত, বস্তুর চেতনা নিরপেক্ষ বা সংবেদন নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে। অর্থাৎ আমাদের চেতনার বাইরে বস্তু স্বাধীনভাবে অস্তিত্বশীল। দ্বিতীয়ত, নীতির দিক থেকে অভ্যাস ও সত্তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই এবং এ ধরনের কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না। একমাত্র পার্থক্য হলো জানা বিষয়ের সাথে অজানা বিষয়ের পার্থক্য। তৃতীয়ত, অন্যান্য বিজ্ঞানের মত-জ্ঞানতত্বের ক্ষেত্রেও আমাদের দ্বান্দ্বিকভাবে চিন্তা করতে হবে। (তথ্যসূত্র : মার্কসীয় দর্শন, হারুন রশীদ)
মার্কস চিন্তা করেছেন মানুষের জ্ঞাত বাইরে কোনো কিছুই থাকতে পারে না। যারা ভাবেন পরাবাস্তবতা এবং সুপার পাওয়ারই সর্বৈব। তাদের জ্ঞান আড়ষ্ট ছাড়া কিছুই হতে পারে না। এটা এক ধরনের গোঁড়ামিবাদ অর্থাৎ ডগম্যাটিজম। লেনিন বলেন, মার্কস ও এঙ্গেলসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আপেক্ষিকতাবাদকে ধারণ করে, কিন্তু তা আপেক্ষিকতাবাদে পর্যবসিত হয় না। অর্থাৎ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ আমাদের যাবতীয় জ্ঞানের আপেক্ষিকতাকে স্বীকৃতি দেয় এই অর্থে যে, আমাদের জ্ঞান নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। এই অর্থে নয় যে, তা বিষয়গত সত্যকে অস্বীকার করে।
প্রসঙ্গত, মার্কস আরও সুস্পষ্ট করেছিলেন যে, ‘মানবিক চিন্তার বস্তুগত সত্য আছে কি না এ প্রশ্ন তত্ত্বগত নয়, ব্যবহারিক। ব্যবহারের ক্ষেত্রে মানুষকে তার চিন্তার সত্যতাকে অর্থাৎ বাস্তবতা ও শক্তিকে ইহমুখিতাকে প্রমাণ করতে হবে। ব্যবহার থেকে বিচ্ছিন্ন, চিন্তার বাস্তবতা ও অবাস্তবতা সংক্রান্ত প্রশ্ন নেহাতই পণ্ডিতি কুতর্ক’।
মার্কস বিষয়ীগতকে নাকচ করে দিয়ে বিষয়গত (বস্তুগত)কে তিনি লুফে নিয়েছেন। বিষয়গত হলো আত্মগত, যা বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে। এর অস্তিত্ব থাকুক আর না থাকুক। মার্কসের তত্ত্বকে প্রাণশক্তি মনে করে লেনিন পথ অঙ্কন করেছেন। তত্ত্বটি প্রায়োগিক জায়গায় নিয়ে গেছেন। মার্কস দিলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী তত্ত্ব আর সেই তত্ত্বকে জীবন দিয়েছেন লেনিন। লেনিন তত্ত্বটির ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবে রূপদান করেছেন।
লেনিন অক্টোবর বিপ্লবের পূর্ববতী ঘটনা বিশ্লেষণ করেন সমধিকভাবে। তিনি বলেন,‘...কারণ সে সময় আমরা পুরোপুরি জ্ঞাত ছিলাম যে, সোভিয়েতগুলো তখন পর্যন্ত আমাদের করায়ত্ত ছিল না। কৃষকরা তখনও বলশেভিক পন্থার নয়, লিবের-দান-চার্নভের পন্থার প্রতিই আস্থাশীল ছিল এবং ফলস্বরূপ আমাদের পিছনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আমরা পাইনি, আর সে কারণে অভ্যুত্থানের বিষয়টি ছিল অপরিপক্ব’।
এ প্রসঙ্গে স্ট্যালিন বলেন, অক্টোবরের জন্যে গোটা প্রস্তুতিকাল জুড়েই পার্টি ব্যতিক্রমহীনভাবেই তার সংগ্রামের ক্ষেত্রে নির্ভর করেছিল গণবিপ্লবী আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত উত্থানের উপর। আন্দোলনেই পার্টির নেতৃত্ব অক্টোবর অভ্যুত্থানে জন্যে গণরাজনৈতিক বাহিনী গঠন করার সহায়তা প্রদান করে। এর ফলেই দাঁড়ালো একটিমাত্র পার্টি বলশেভিক পার্টিরই হাতে।
যাই হোক, লেনিন বিশ্বের মহানায়ক হয়েছেন সমাজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। এ বিপ্লব যে কত কণ্টকাকীর্ণ পথ ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। লেনিনের বিপ্লবকাল ও বিপ্লব-পরবর্তী আর অল্প বিস্তার আলোচনা করে এর ইতি টানতে চাই।
বিপ্লবের পূর্ব মুহূর্তে রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিলো। ক্ষমতায় ছিলেন কেরেনেস্কি। বলশেভিকদের ওপর নির্মম নির্যাতন, অত্যাচার সপাটে চালাতেন। তারপরও রাজানীতির বৃহৎ স্বার্থে লেনিন কৌশলে হেঁটেছেন।
রাশিয়ায় দুর্ভিক্ষের সময় রুশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন কর্নিলফ। তিনি বলশেভিকদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছেন। দেশের এ সংকটকালে রুশ প্রধানমন্ত্রী প্রিন্স লভোভ পদত্যাগ করেন। তারপরই কেরেনেস্কি হলেন প্রধানমন্ত্রী। কেরেনস্কি ক্ষমতায়ন হওয়ার পেছনে লেনিনের বলশেভিক পার্টির কর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সর্বাধিনায়ক কর্নিলফ রাশিয়ায় ক্ষমতা নেয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠলেন। আবার এদিকে বলশেভিক পার্টিকে ধ্বংস করার জন্যে কর্নিলফের অভিযান অব্যাহত রাখলেন। কেরেনেস্কি পুঁজিবাদী সরকার, কর্নিলফ মসনদে বসতে যে বাসনা বাস্তবায়নের জন্যে পদক্ষেপ নিলেন, সে মুহূর্তে কেরেনেস্কি তাকে বরখাস্ত করলেন।
এ সময়ে রাশিয়ায় জার্মানরা রিগা দখল করে ফেললেন। কর্নিলফ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিতে উচ্চ বাসনা প্রকাশ করতে চাইছিলেন। কেরেনেস্কি সরকার বলশেভিক কর্মীদের নির্যাতন করা সত্ত্বেও কর্নলিফের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, অবশেষে কর্নলিফ ব্যর্থ হন।
লেনিন কেরেনেস্কি সরকারকে হটাবেন--এটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দিলেন। লেনিনের কথামতো চলছে বিপ্লব-সংগ্রাম। লেনিন এ সময় ফিনল্যান্ড থেকে পেত্রোগ্রাদে চলে আসলেন। সময়ক্ষণ ছিল ৭ অক্টোবর। ২৪ অক্টোবর বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে একটি চিঠি পাঠান। যাতে করে জনগণ সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে পিছু না হটে। সরকারপ্রধানকে গ্রেফতার করা ছাড়া যেন রাজপথ না ছাড়ে। লেনিন ২৫ অক্টোবরকেই বিপ্লবের মোক্ষম দিন হিসেবে নিলেন। আগের দিনও নয় পরের দিনও নয়। এদিন বিপ্লব করতে না পারলে সবকিছু হারাবার সম্ভাবনা দেখেছিলেন। লেনিনের নির্দেশমতো তাই-ই হলো। ২৫ অক্টোবরই ১৯১৭ সালে প্রাসাদ ও সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর দখলে নিয়ে নিলো বিপ্লবী শ্রমিক, নাবিক ও সৈনিকরা (তথ্যসূত্র : লেনিন, আবুল হাসানাত)। উল্লাসে ফেটে পড়লো বিপ্লবীরা। শ্রমিক মেহনতীদের স্বর্গের দ্বার খুলে গেলো। মানুষ মহানন্দে উচ্ছ্বাস করলো। মুখে ধ্বনিত হলো ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব জিন্দাবাদ’।
শ্রমিক-মেহনতিরা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করলেন। বাস্তবায়নের প্রধান নেতা লেনিন সমাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে আরও সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। চিন্তার বলিরেখা আঁকলেন। এভাবে চলতে চলতে ১৯১৯ সালে জারতন্ত্রের সকল পদক্ষেপ বিনষ্ট করে দিলেন। নবযুগের পর্দা সাঁটালেন। তা হলো, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। তাই জারতন্ত্রও উচ্ছেদ হয়ে গেলো চিরদিনের জন্যে। সমাজতান্ত্রিক সরকার হলে কী হবে- টিকে থাকতে দিবে না পুঁজিবাদ- সা¤্রাজ্যবাদীরা। সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, জার্মান, ব্রিটিশ মার্র্কিন, জাপান ও ফরাসিরা।
লেনিন দমে যাননি। সঙ্গে তো আছেন- ট্রটস্কি, স্ট্যালিন, লুনাচায়স্কি। এ চার বিপ্লবী সমাজতন্ত্রকে সুসংহত করতে আরও একাট্টা ও দৃঢ় হলেন। রাশিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ। জার্মান মুখিয়ে আছে সেভিয়েতদের উপর, কৌশলগত কারণে জার্মানীর সাথে ১৯১৮ সালের ৩ মার্চ শান্তি চুক্তি করলেন। আর এদিকে ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ মার্কিন ও ফরাসি সৈন্যরা আক্রমণ করলো। দখলে নিলেন সুরমনিস্ক। জাপান এবং ব্রিটিশ দখলে নিলেন সুরমনিস্ক। লেনিনের সুযোগ্য প্রধান নেতৃত্ব লালফৌজ তাদেরকে পরাজয় করে আরেকটি নবঅধ্যায় সৃষ্টি করলো। এ লালফৌজের নেতৃত্বে ছিলেন ট্রটস্কি। ট্রটস্কি বিপ্লবের জন্যে শ্রমিক-কৃষকদেরকে বেশ উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। বিপ্লব করলেই বিপ্লবের কাজ শেষ হয়ে যায় না। তার ‘এপ্রিল থিসিস’ এবং ‘নিউ ইকোনমিক পলিসি’ই বিপ্লব-পরবর্তী কাজকে আরো ত্বরান্বিত করে। ১৯২২ সালে এসে ৫ বছরের প্রভূত উন্নতি দেখে জনগণ ও সারা বিশ্ব হতবাক হলো। এখন বিদায় নেয়ার পালা। সবশেষে দিয়ে গেলেন ‘কংগ্রেসের নিকট পত্র’, সমবায় প্রমোদ, আমাদের বিপ্লব, বরং অল্প কিন্তু ভালো করে। ১৯২৩ সালের মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে উল্লিখিত প্রবন্ধগুলো লিখে যান তিনি। অবশেষে বিশ্ব শ্রমজীবী মানুষের এ মহানায়ক ১৯২৪ সালের ২১ জানুয়ারি মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা যান।
জাহাঙ্গীর হোসেন : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চাঁদপুর জেলা কমিটি; প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি।