প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২১, ০০:০০
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রা। পঞ্জিকা অনুযায়ী আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে এ উৎসবটি উদ্যাপিত হয়ে থাকে। ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা হয়ে থাকে কচুয়ার সাচারে। সাচারের এবারের রথযাত্রা উৎসব ১৫৪তম। আগামী ১২ জুলাই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো সাচারের রথযাত্রা উৎসব। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ও কঠোর লকডাউনের বিধিনিষেধ থাকায় জনসমাগম এড়াতে ‘সাচার রথযাত্রা’ উৎসবটি স্থগিত করা হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে মন্দির প্রাঙ্গণে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন করার কথা জানিয়েছেন রথযাত্রা উদ্যাপন কমিটি।
সাচার জগন্নাথ ধাম সাংস্কৃতিক সংঘের সভাপতি বটু কৃষ্ণ বসু জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে এবারের রথযাত্রা ও রথমেলা উৎসব স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। গত বছরও মহামারী করোনার কারণে আমরা রথযাত্রা উৎসব উদ্যাপন করতে পারিনি। ভেবেছিলাম এ বছর বড় পরিসরে উদ্যাপন করবো। করোনার কারণে এবারো লকডাউন থাকায় রথযাত্রা উৎসব স্থগিত করা হয়েছে। তাই উদ্ভূত পরিস্তিতিতে ছোট্ট পরিসরে মন্দিরকেন্দ্রিক পূজা অনুষ্ঠিত হবে।
কারুকার্যখচিত দৃষ্টিনন্দন রথটি সাচারকে দিয়েছে বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে বিশেষ পরিচিতি। ঐতিহ্যবাহী সাচারের এ রথটি তৎকালীন জমিদার গঙ্গা গোবিন্দ সেন ১২৭৫ বাংলা সনে নির্মাণ করেন।
‘শ্রী শ্রী দারু বক্ষো গ্রন্থ’ থেকে জানা যায়, ভারতের পুরাধামে জগন্নাথ দর্শন না দেয়ায় গঙ্গা গোবিন্দ সেন আমরণ অনশন আরম্ভ করেন। তথায় শ্রী ভগবানের স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে দেশে ফিরে এসে নিজ গ্রাম সাচারে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তি নির্মাণপূর্বক এ রথ প্রতিষ্ঠা করেন।
কথিত আছে, গঙ্গা গোবিন্দ সেন প্রতিবছর ভারতের শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করতেন। জগন্নাথের দর্শন পাবার জন্যে তিনি ব্যাকুল ছিলেন। পায়ে হেঁটে কয়েক সপ্তাহ পূর্বে বাড়ি থেকে রওনা দিতেন। যেখানে গিয়ে রাত হতো সেখানে গিয়েই গোবিন্দ সেন নিদ্রা যেতেন। সাথে করে তিনি খাওয়ার জিনিসপত্র নিয়ে যেতেন। এভাবে প্রতিবছর এ শরণার্থী পায়ে হেঁটে জগন্নাথ দেবের দর্শন পাবার জন্যে যেতেন। গোবিন্দ সেন তার জন্যে এমনই পাগল ছিলেন। গোবিন্দ সেন একদিন এক গায়েবি শব্দ শুনতে পারলেন ‘বাবা তুমি চলে যাও, কষ্ট করে বহুদূর পাড়ি দিতে হবে না। তোমার বাড়িতেই এ জগন্নাথ একদিন যাবে’। পরের রাতে গোবিন্দ সেন আবার স্বপ্নাদেশে দেখতে পেলেন জগন্নাথ তাকে বলে ‘কীরে বাড়িতে যাসনি?’ সেন বিষয়টি বুঝে উঠতে পারছে না। আবার স্বপ্নাদেশে জনৈক বলেন, ‘তোর বাড়ির উত্তর পাশের বড় খালে দেখবি একটা নিমগাছ ভেসে আসবে সে নিম গাছটি তুলে নিবি। তারপর বাড়ির পশ্চিম ভিটিতে একটি মন্দির স্থাপন করবি’। সে স্বপ্নাদেশ মোতাবেক বাড়িতে ফিরে এসে গোবিন্দ সেন মন্দির স্থাপন করেন। আবার প্রতিবেশীদের জানিয়ে দেয়া হয়।
প্রতিবেশীরা শুনে সবাই সহযোগিতা করবে বলে আশ্বস্ত করে। ক’দিন পর নিমগাছ ভেসে আসে। এদিকে মন্দির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। পুনরায় সেনকে এক কাঠমিস্ত্রি এসে দেখা করে বলে আমি জগন্নাথ দেবের ঘর ও মূর্তি নির্মাণ করে দেবো। ওই কাঠমিস্ত্রি তার সহযোগীদের নিয়ে পরে মন্দিরের কাজ শুরু করে। সকল জানালা-দরজা বন্ধ করে দিয়ে তার কাজ আরম্ভ করে। প্রথমদিকে কাজ করার সময় হাতুরির আওয়াজ শোনা যেতো। পঞ্চমদিন কোনো আওয়াজ হচ্ছে না। তাই প্রতিবেশীরা মনে করছে কাজ শেষ হয়ে গেছে। মূলত কাজ শেষ হয়নি। শুধু বাকি ফিনিশিং করা। ভুলবশত মন্দিরের দরজা খুলে ফেলে প্রতিবেশীরা। এতে করে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা এ তিনটি মূর্তির হাতের আঙ্গুল ও কোমড়ের নিচের অংশ তৈরি করা সম্ভব হয়নি এবং ভেতরে থাকা মিস্ত্রিদের কেউ দেখতে পাইনি। যা এখনো কালের সাক্ষীরূপে রয়েছে।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনী পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলা রথটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হলেও পূর্বের সেই কারুকার্য আর দৃষ্টি হচ্ছে না। সাচারের মাটি খুঁড়তে গিয়ে এখনও তৎকালীন হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যবহারিত নানা ধরনের মূর্তি পাওয়া যায়। প্রতি বছরের আষাঢ় মাসে প্রথম রথ এক সপ্তাহ পরে ফেরত রথযাত্রা উপলক্ষে এখানে প্রায় তিন হাজার স্টল ও মাসব্যাপী মেলা বসতো এবং মিলন হতো বহু ভক্তের।