প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজির আধিপত্যকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব
জেলা আওয়ামী লীগ সেক্রেটারির বাড়িতে হামলা
মসজিদ ও কবরস্থানে হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন
চাঁদপুর পৌর বাসস্ট্যান্ডে আধিপত্য ও চাঁদাবাজিকে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয়পক্ষের কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়। এ ঘটনায় একপক্ষ চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারীর বাড়িতে (করিম পাটওয়ারী বাড়ি) হামলা করেছে। হামলার সময় দুলাল পাটওয়ারীর বাবা সাবেক গণপরিষদ সদস্য মরহুম আব্দুল করিম পাটোয়ারীর কবর ও মসজিদের লাইট ভাংচুর করা হয়। হামলায় দুলাল পাটওয়ারীর ভাই কামাল পাটওয়ারী, শ্রমিক নেতা ফারুক দেওয়ানের বড় ছেলে রিভিন দেওয়ান, পাটওয়ারী বাড়ির সাইফুল পাটওয়ারী ও রিয়েল পাটওয়ারীসহ কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন।
ঘটনার সূত্রে জানা যায়, প্রতি বছর পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার পরদিন থেকে টানা ১০/১৫ দিন দক্ষিণাঞ্চলের লোকজন সড়কপথে চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রাম যায়। ফলে চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রূটে যে পরিমাণ বাস আসা-যাওয়া করে ওই পরিমাণ বাস দিয়ে এই যাত্রীদের লোড নিয়ে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। কারণ ঈদের পর থেকে টানা প্রায় ১৫ দিন প্রতিরাতে চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রামমুখী যাত্রীদের জন্যে ৩০ থেকে ৩৫টি বাস প্রয়োজন হয়।
এদিকে ঈদের সময় এই অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে চাঁদপুর বাস টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রামে যাওয়া বাসগুলো অতিরিক্ত যাত্রী এবং ঈদের পর নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে ২/৩শ’ টাকা অতিরিক্ত ভাড়া যাত্রীদের থেকে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রত্যেক ঈদে অতিরিক্ত যাত্রীর এই চাপ সামাল দিতে চট্টগ্রাম-চাঁদপুর রুটে চাঁদপুর-ঢাকা ও চাঁদপুর-কুমিল্লা রুটের বাস দিয়ে যাত্রীদের চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া হয় অতিরিক্ত ভাড়া। ভিন্ন রুটের বাস চট্টগ্রাম রুটে সার্ভিস দেয়ার সুবাদে একটি মোটা অংকের টাকা বাস মালিক সমিতি, শ্রমিক নেতা, চট্টগ্রাম রূটের স্থানীয় কাউন্টার মালিকরা নিয়ে যায়। পুলিশকেও টাকা দেয়া হয় বলে জানা যায়। এটাকে চাঁদাবাজিই বলা হয়। এছাড়া বছরব্যাপী চলে চাঁদাবাজি, যেটিকে স্থানীয়ভাবে জিবির টাকা বলে থাকে। এই জিবির টাকা দীর্ঘদিন ধরে ভাগাভাগি হয়ে থাকে। শ্রমিকের ঘামকে পুঁজি করে যাত্রীদের পকেট কেটে যে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হয়, সে টাকা যায় স্থানীয় প্রভাবশালী মালিকপক্ষ এবং প্রভাবশালী শ্রমিক নেতাদের পকেটে। এই চাঁদাবাজির টাকা ভাগাভাগি নিয়ে শ্রমিক নেতা ফারুক দেওয়ান ও মালিকপক্ষ কামাল পাটওয়ারীর সাথে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের বলে জানান সাধারণ শ্রমিকরা।
এই চাঁদাবাজির ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১৪ এপ্রিল রাতে চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রুটের বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম দুলাল পাটওয়ারীর ভাই কামাল পাটোয়ারীর সাথে জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ফারুক দেওয়ানের বাকবিতণ্ডা হয়। এ সময় উভয় পক্ষের লোকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হলেও ওইদিন পুলিশের উপস্থিতির কারণে বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ১৮ এপ্রিল বৃহস্পতিবার রাতে সংঘর্ষ ও হামলার ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি ফারুক দেওয়ানের ছেলে রিভিন দেওয়ানের (২৫) সাথে পাটোয়ারী বাড়ির সামনে ওই বাড়ির ছেলেদের বাকবিতণ্ডা হলে রিভিন দেওয়ানকে কামাল পাটোয়ারীর লোকজন পিটিয়ে মারাত্মক আহত করে। এতে তার মাথা ফেটে যায় এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত পায়।
এ খবর শুনে ফারুক দেওয়ানের অনুসারী শ্রমিক ও রিভিন দেওয়ানের বন্ধু শুভাকাঙ্ক্ষী ও নাজির পাড়ার লোকজন ঐক্যবদ্ধ হয়ে মরহুম আঃ করিম পাটোয়ারী বাড়িতে (দুলাল পাটওয়ারী বাড়ি) হামলা চালায়। এ হামলায় দুলাল পাটওয়ারীর ভাই কামাল পাটোয়ারী, ভাতিজা সাইফুল পাটোয়ারী, জিকু পাটোয়ারী, মানিক পাটোয়ারী, রাজন পাটোয়ারী ও রিয়েল পাটোয়ারীসহ কয়েকজন আহত হয়। খবর পেয়ে চাঁদপুর সদর মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন।
এ হামলার বিষয়ে পাটোয়ারী বাড়ির লোকজন জানান, ফারুক দেওয়ান ও রিভিন দেওয়ান নিজেরা নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের বাড়িতে অতর্কিত হামলা চালায়, যাতে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। তাদের হঠাৎ এই আক্রমণে আমরা ডাক-চিৎকার দেই।
হামলায় আহত কামাল পাটোয়ারী বলেন, কোনো ইস্যু ছাড়াই তারা এই হামলা করে আমাদের বাড়ির লোকজনকে আহত করে এবং তাদের হামলায় মসজিদ ও আমার বাবার কবর পর্যন্ত রেহাই পায়নি। শুধু তাই নয়, আমরা পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েও পুলিশের সহযোগিতা পাইনি। পুলিশের সামনে আমাদের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে। শত শত ইটের টুকরো বাড়িতে পড়ে আছে।
এদিকে আহত রিভিন দেওয়ান ও তার বাবা ফারুক দেওয়ান বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই আমার ছেলের উপর কামাল পাটোয়ারীর নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে তাকে রক্তাক্ত জখম করা হয়। আহত রিভিন দেওয়ান বলেন, আমি রাত ১১টার দিকে পাটওয়ারী বাড়ির সামনে দিয়ে রিক্সায় আমাদের এলাকায় যেতে নিলে কামাল পাটওয়ারীর নেতৃত্বে সাইফুল পাটওয়ারী, রিয়েল পাটওয়ারীসহ ১০/১৫ জন আমার উপর অতর্কিত হামলা করে।
ফারুক দেওয়ান অভিযোগ করে বলেন, চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রুটে ঈদ উপলক্ষে চলমান বাস থেকে কামাল পাটোয়ারী প্রতি বাসে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। আমি তাতে বাধা দিলে তিনি প্রতিহিংসামূলক আমাদের উপর এ আক্রমণ চালায়। বাসস্ট্যান্ডে কোনো চাঁদাবাজি চলবে না এমন হুঁশিয়ারি দেয়ায় আজ আমার ছেলেকে মেরে ফেলার জন্যে তারা অতর্কিত হামলা করে।
এদিকে মসজিদ ও কবরস্থানে হামলার ঘটনার প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার বাদ জুমা মরহুম আব্দুল করিম পাটোয়ারী বাড়ি জামে মসজিদের মুসল্লিরা জুমার নামাজ শেষে মানববন্ধন করেন। এ ঘটনার বিচার চেয়ে এ মানববন্ধন করেন।
এ ঘটনায় কোনো পক্ষ থেকে থানায় কোনো অভিযোগ বা মামলা করা হয়নি। তবে ফারুক দেওয়ান জানান, ছেলের অবস্থা গুরুতর। এজন্যে তাকে চিকিৎসক ঢাকায় রেফার করায় সে ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছে। ছেলে সুস্থ হয়ে আসলে এ ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে।
এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর মডেল থানার দায়িত্বরত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আঃ রাজ্জাক মীরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ঘটনা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে ফোর্স পাঠিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনি। শুধু তাই নয়, আমিসহ আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে যায় এবং ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকে কেউ কোনো অভিযোগ বা মামলা করেনি। যে কেউ ইচ্ছা করলে অভিযোগ বা মামলা দায়ের করলে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
তিনি আরো বলেন, আশা করছি সামনে এ ধরনের আর কোনো ধরনের ঘটনা ঘটবে না।