প্রকাশ : ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৫৩
নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
আগে তাঁকে জানতে পারিনি খুব একটা। তাঁর সাথে আমার প্রথম দেখা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি কার্যক্রমে, উনিশশো তিরানব্বই সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে। তবে তারও আগে তাঁর মায়ের লেখার সাথে পরিচয়। তিনি যে তাঁর মা তা না জানলেও লেখিকা হিসেবে ড. মঞ্জুশ্রী চৌধুরীকে চিনতে পেরেছিলাম বেশ। সপ্তম শ্রেণিতে তাঁর লেখা 'রূপসী বাংলাদেশ ' শিরোনামে গদ্যটি আমাকে শিহরিত করে তুলেছিলো। তিনি ঐ লেখায় খুব প্রাঞ্জল ও উপভোগ্য ভাষায় বাংলার রূপ ও ঋতুবৈচিত্র্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তাঁরই জ্যেষ্ঠ সন্তান হলেন আজকের অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার আকিলপুর গ্রামের জমিদার পরিবারের সন্তান অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরীর পিতা ছিলেন প্রয়াত শৈলেন্দ্র কুমার চৌধুরী। আমাদের ভর্তি কার্যক্রমে স্যারের দায়িত্ব ছিলো মার্কশিট, সনদপত্র ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করা। আমার মার্কশিট দেখে স্যারে সস্নেহে বলেছিলেন, বাহ্! অনেক নাম্বার পেয়েছো তো তুমি। সে সময় কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন আরেক কিংবদন্তি অধ্যাপক ডা. সৈয়দা নূরজাহান ভূঁইয়া ম্যাডাম। এরপর যখন ক্লাস শুরু হলো তখন দেখলাম, স্যার আমাদের ফিজিওলজি ও বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। তিনি নিতেন বায়োকেমিস্ট্রি ক্লাস। আমাদের পাঠ্য ছিলো হার্পারের বায়োকেমিস্ট্রি বই। তাঁর বাচনভঙ্গি, ডায়াসে দাঁড়ানোর শৈলি এবং উপস্থাপন ছিলো অসাধারণ। মনে হতো একটা কলনাদী ঝরনার পাশে বসে আছি আর ঝরনার প্রবহমান জলধারা মিষ্টি সুরে সুরে বলে চলেছে আলাপের কথামালা। স্যার স্লাইড দেখাতেন যত তার সাথে ব্যাখ্যা দিতেন বেশি। তিনি স্লাইড তৈরির একটা কৌশলও ক্লাসে বাৎলে দিয়েছিলেন। স্লাইডে লিখতে হবে চুম্বক অংশ আর মুখে বলতে হবে তার ব্যাখ্যাটুকু। যাতে করে কারও উত্থাপনযোগ্য প্রশ্ন থাকলে সহজেই ব্যাখ্যা থেকে উত্তর দেওয়া যায়। কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে তিনি একটুখানি ঊর্ধদিকে টক্করের মতো দিতেন। এটা ছিলো তা়ঁর বিশেষত্ব। তাঁর প্রবল মাধুর্যমণ্ডিত ব্যক্তিত্বের সাথে এই টক্করটুকু সোনায় সোহাগা হয়ে উঠেছিলো। প্রথম ক্লাসের পরে আর মোটেও তা বেমানান লাগতো না। বরং মনে হতো, এটাই তাঁর প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বে এনেছিলো পূর্ণতা। স্যারকে অনুকরণের চেষ্টা শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নবীন শিক্ষকদের অনেকেই চেষ্টা করেছেন। বলা যায়, তারা স্যারের ব্যক্তিত্বে প্রভাবিত হয়েছিলেন। স্যারের সহজবোধ্য ইংরেজি ও প্রাঞ্জল উপস্থাপনের কারণে সবার কাছে তাঁর ক্লাসটাই হয়ে উঠতো বিদ্যার পাশাপাশি উন্নতমার্গের বিনোদন।
একদিন স্যার তাঁর ক্লাসে পড়াচ্ছিলেন পিএইচ, বাফার এগুলো কী তা। প্রসঙ্গক্রমে আসলো, কেন হাইড্রোজেন আয়ন একটা প্রোটন। তিনি খুব মনোগ্রাহী করে তাঁর পাঠদানশেষে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আহ্বান করলেন, কে তাঁর মতো করে এই লেকচারটা দিতে পারবে। আমার সহপাঠীদের যারা আমার কলেজজীবনের বন্ধু, তাদের কেউ কেউ খুঁচিয়ে আমাকে এগিয়ে দিলো। আমি দুরু দুরু বুকে ডায়াসে গিয়ে মাইক্রোফোন শার্টের কলারে লাগিয়ে বলতে শুরু করলাম, একটু আগে স্যারের দেওয়া লেকচারের রেকর্ড করা কপির মতো করে। আমার বলা শেষ হলে স্যার খুবই প্রসন্ন হলেন। প্রবল ব্যক্তিত্ববান স্যারের প্রসন্নতায় আমার নিজেকে এভারেস্টজয়ী তেনজিং মনে হলো। এভাবেই শুরু হলো স্যারের সান্নিধ্য। বায়োকেমিস্ট্রির কঠিন গ্লাইকোলাইসিস ও ক্রেবস্ চক্রকে স্যার তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞায় রিকশার চাকার সাথে তুলনা করে সহজবোধ্য করে তুলেছিলেন। প্রতিটা ধাপকে তিনি রিকশার চাকার একটা করে স্পোকের সাথে তুলনা করেছিলেন। কোন্ ধাপে কয়টা এটিপি তৈরি হয় তা আজও চোখে ভাসে কেবল স্যারের রিকশার চাকার চিত্রকল্প তৈরি করার কারণে। পরীক্ষার হলে ভাইভা দেওয়ার সময় এই সত্যটা আবারও বুঝে উঠেছিলাম, শিক্ষক যত বড় ও প্রাজ্ঞ হন তত তাঁর প্রশ্ন হয়ে উঠে সহজবোধ্য ও অনুপ্রেরণামূলক। মনে হতো স্যার বোধ হয় সব সময় পাশ করানোর জন্যেই প্রশ্ন করতেন। পরীক্ষার হল থেকে বের হলে বুঝতাম, আসলে জিজ্ঞেস করার মতো কোনো প্রশ্নই তিনি বাদ রাখেননি।
প্রফেসর ডা. সৈয়দা নূরজাহান ভূঁইয়া ম্যাডামের অবসরের পর অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী অধ্যক্ষের দায়িত্বে আসীন হন। তখন চমেকসুর পক্ষ থেকে ম্যাগাজিন প্রকাশকালে আমার বন্ধুর অনুরোধে আমাকে ঊনচল্লিশটা বাণী একার হাতে লিখে দিতে হয়েছিলো। স্যারের অধ্যক্ষের বাণীতে আমি 'নূতন দিনের নূতন অহনায়' কথাটি ব্যবহার করেছিলাম শুরুতে। তিনি 'অহনা' শব্দের প্রয়োগ দেখে বাণী লেখকের নাম জানতে চেয়েছিলেন। স্যারের এই আগ্রহ আমার আজীবন সম্পদ। ঊনিশশো আটানব্বই সালে ক্যাম্পাসে 'প্রথম আলো-এসকেএফ+' আন্তঃমেডিকেল বিতর্ক প্রতিযোগিতার আসর বসে। আয়োজক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। আমাদের কলেজ হতে দুটো দল স্যার ঠিক করে দেন। একটা হলো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ আগুন দল আর অন্যটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ফাগুন দল। আমি ছিলাম আগুন দলের দলনেতা।
মার্কিন মুলুকে প্রবাসী শিশুসাহিত্যিক মনজুর কাদের ভাই আশিস্ সংগঠনের সাথে জড়িত। এর পূর্ণাঙ্গ রূপ হলো 'আমরা শিশুদের সঙ্গী।' তিনি প্রতি মাসের প্রথম শনিবার সকালে অনলাইনে একটা অনুষ্ঠান করেন শিশুসাহিত্যিক ও শিশুদের নিয়ে। এর একটা পর্বে তিনি এনেছিলেন অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী স্যারকে। স্যারের সম্পর্কে বলার জন্যে তিনি রেখেছিলেন আমাকেও। সাথে আরও কয়েকজন স্যারের ছাত্র-ছাত্রী। স্যার আমার নামটা অনুমোদন করেছিলেন। জুম প্ল্যাটফর্মে স্যারের সামনে স্যার সম্পর্কে বলা আমার জন্যে নোবেল পাওয়ার শামিল। স্যারকে কেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার সেই অবধি দেওয়া হয়নি এ নিয়ে আমরা অনলাইন প্ল্যাটফর্মে প্রচুর লেখালেখি করেছিলাম। বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার পর স্যার আমাকে ফোন করেছিলেন তাঁর পুরস্কার গ্রহণের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে। আহা! আমার স্যার কতো মায়াময়! কতো পিতৃসুলভ!
চেয়েছিলাম, স্যারকে আমার লেখালেখির সাথে জড়িয়ে রাখি। তাই তাঁকে উৎসর্গ করেছি আমার একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ সংকলন ' শেকড়ের রবীন্দ্রনাথ ও বিবিধ ' গ্রন্থটি। স্যার তাঁর কপিটি পেয়ে বেশ উল্লসিত হয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন।
একবার, শামসুজ্জামান খান মারা যাওয়ার পর বাংলা একাডেমির সভাপতি কে হতে পারেন তার সম্ভাবনা যাচাই করতে গিয়ে জেলা শিল্পকলা একাডেমির কালচারাল অফিসার সৌম্য সালেককে আমি বলেছিলাম, অধ্যাপক ডা. শুভাগত চৌধুরী স্যার এ পদের জন্যে অতিশয় যোগ্য ব্যক্তি। বস্তুত, এখনও আমার মনে হয়, স্যারই ঐ পদে সর্বোত্তম যোগ্য ছিলেন, শামসুজ্জামান খান সাহেবের মৃত্যুর পর।
শুভাগত চৌধুরী স্যারের জীবনপাত্র উছলে পড়েছে প্রাপ্তিতে। তবুও কিছু না কিছু অপ্রাপ্তি আছে তো বটেই। এর একটা হলো জাতীয় অধ্যাপকের স্বীকৃতি। তিনি একজন সত্যিকারের দাবিদার ছিলেন। আরেকটা হলো জীবদ্দশায় চিকিৎসায় বা মানবসেবায় বা শিক্ষায় বা সাহিত্যে একুশে পদক পাওয়া। আমি মনে করি রাষ্ট্র এ দুটো জায়গায় স্যারকে বঞ্চিত করেছে। সেই অতৃপ্তি মাথায় রেখেই বলতে হয়, স্যারের জীবন এক সোনার তরী। তাতে সুকর্মের সোনালি ফসলে ভর ভরান্ত। সেই কর্মফসলের সেনার তরী বেয়ে স্যার চললেন অগস্ত্য যাত্রায়। কীভাবে বিদায় বলি স্যার! ভালো থাকুন পরপারে প্রণম্য প্রাণ, অধ্যাপক ডা.শুভাগত চৌধুরী। অসংখ্য শিক্ষার্থীর শিক্ষাগুরু একজন শুভাগত চৌধুরী অগণন নক্ষত্র নির্মাতা। আপনার নক্ষত্রের আলোয় আপনি আজ থেকে চিরজীবী।