প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২১, ০০:০০
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল কাশেম। তিনি ফেণী জেলার ছাগলনাইয়া উপজেলার পূর্ব শিলুয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি একজন প্রত্যাগত প্রবাসী। তিনি চাঁদপুর কণ্ঠের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকার পর্বের মুখোমুখি হন। তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন জাহাঙ্গীর আলম হৃদয়।
চাঁদপুর কণ্ঠ : প্রবাসে কতোদিন আছেন, কী করছেন, কেমন কাটছে সময়?
বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম : সৌদি আরবে ৩৯ বছর ছিলাম। সৌদি আরবের জেদ্দায় বাংলাদেশ দূতাবাসে পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসেবে স্বনামধন্য সাবেক রাষ্ট্রদূত মরহুম হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও মোহাম্মদ মহসিন সাহেবের মতো বরেণ্য কূটনীতিকদের সাথে ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত কাজ করেছি।
১৯৮১ সালে বাংলাদেশ দূতাবাস জেদ্দার পিআরও হিসেবে চাকুরিরত থাকাকালীন তখনকার সরকারের কোনো নির্দশনা না থাকা সত্ত্বেও জননেত্রী শেখ হাসিনাকে জবপবরাব ্ ঝববড়ভভ করে প্রটোকল প্রদান করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো, যখন তিনি পবিত্র ওমরা হজ পালন করতে এসেছিলেন।
উল্লেখ্য, তখন আওয়ামী লীগের কোনো সংগঠন তো দূরের কথা, কেউ ভয়ে আওয়ামী লীগের নামও মুখে উচ্চারণ করতো না।
১৯৮৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ওআইসির অধীনস্থ আন্তর্জাতিক ইসলামিক ফিকা একাডেমি, জেদ্দায় প্রধান প্রটোকল অফিসার হিসেবে সাফল্যের সাথে কাজ করি। জেদ্দায় অবস্থানকালীন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত সৌদি আরব ইউনিট কমান্ড কাউন্সিল জেদ্দার কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ পাই। যে দায়িত্ব ২০১৭ সালে দেশে ফেরত আসার আগ পর্যন্ত পালন করি। বিএনপির পরে ২য় বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার অনেক পরেও জেদ্দাস্থ বাংলাদেশের দুই স্কুলে জাতির পিতার ছবি উঠানো হয়নি। পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পক্ষ হতে আমি ও মীর কাসেম মজুমদারসহ তখনকার সিজি মহোদয় নাজমুল ইসলাম (বর্তমানে ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত) মহোদয়কে বিষয়টি জানালে তিনি আমাদের সামনে ফোন করে দুদিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ছবি উঠানোর কড়া নির্দেশনা দান করেন।
আমি জেদ্দাস্থ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পরিষদ ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছিলাম। তখন যারা সভাপতি ছিলেন, তারা হলেন যথাক্রমে শেখ বাবুল ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন মিন্টু।
ফ্রেন্ডস্ অব বাংলাদেশ জেদ্দার প্রধান উপদেষ্টা মোঃ আবুল কাসেম ছালেহ দেশে প্রত্যাবর্তন করলে মীর কাসেম মজুমদারের বিশেষ অনুরোধে কিছুদিনের জন্যে কাসেম ভাইয়ের স্থলাভিষিক্ত হয়ে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনও করেছিলাম।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ জেদ্দা ইউনিটি কমান্ডার থাকাকালীন প্রতি বছর জেদ্দাস্থ স্কুলের বাচ্চাদেরকে নিয়ে হাতে লাল-সবুজের পতাকা দিয়ে বিজয় মিছিল করতাম। প্রতি বছর ‘রণাঙ্গন ৭১’ নামে ম্যাগাজিন বের করতাম। এ প্রজন্মকে জানিয়ে দিতাম ১৯৭১ সালে কার সাথে কার যুদ্ধ হয়েছিলো এবং কেনো কারা মুক্তিযোদ্ধা, আর কারা রাজাকার ছিলো।
আমার লেখা বই ‘স্মৃতিতে রণাঙ্গন ৭১’ ২০১১ সালে বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে মোড়ক উন্মোচন করেন প্রয়াত প্রফেসর অফ ইমিরেটাস আনিসুজ্জামান স্যার।
চাঁদপুর কণ্ঠ : বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আপনার অনুভূতি কেমন?
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল কাশেম : ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বজ্রকণ্ঠের ভাষণ শুনে সরাসরি ভারত গিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করতে পারবো এ আশা কখনো করিনি। মরণপণ যুদ্ধ করে অর্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ভোগ করার অনুভূতিতেই আলাদা চমক, যা ব্যক্ত করার মতো ভাষা নেই। মহান স্বাধীনতার অগ্রদূত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যদি বেঁচে থাকতেন আমাদের অনুভূতি কখনো আর অপূরণ থাকতো না।
চাঁদপুর কণ্ঠ : আপনার দৃষ্টিতে স্বদেশের উন্নতি-অগ্রগতি কতোটুকু হয়েছে?
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল কাশেম : জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে দিয়েছেন অমূল্য মহান স্বাধীনতা। তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ও জাতিকে উপহার দিয়েছেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং অভূতপূর্ব উন্নতি। আজ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি বা জিডিপি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও অন্যান্য দেশকে ডিঙ্গিয়ে। বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বে রোল মডেলের পরিচিতি লাভের পেছনে জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও প্রবাসীদের অবদানের কথা দেশ ও জাতি চিরদিন মনে রাখবে। তাঁর মতে যারা বিদেশ বিভূঁইয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে স্বদেশে পাঠায় এবং জাতীয় অর্থ তহবিলের সিংহভাগ জোগান দেয় তারা রেমিট্যান্স যোদ্ধা।
আলহামদুলিল্লাহ, জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার সকল প্রয়োজনীয় সূচকেই জাদুর কাঠির মতো উন্নতির ছোঁয়া লাগিয়েছেন। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ও শিশু উন্নয়নে অর্জন, নারীর ক্ষমতায়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, কৃষিতে কৃতিত্ব ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মংগা চিরতরে বিদায়, রেমিট্যান্সযোদ্ধা প্রবাসীদের উন্নয়নে অর্জন, জাতিসংঘের শান্তিমিশনে বাংলাদেশের অর্জন, বিদ্যুৎখাতে অভূতপূর্ব সাফল্য, শিল্প ও বাণিজ্য খাতে অর্জন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অর্জন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ও মন্দা মোকাবেলায় সাফল্য, অবকাঠামো খাতে রাস্তা ঘাট, ওভারব্রিজ, মেট্রোরেল, নদীর তলদেশে সুড়ঙ্গ পথ ও বিশ্ব আলোচিত স্বপ্নের পদ্মাসেতু বিনির্মাণ উল্লেখযোগ্য।
১৯৭৩-৭৪ বাংলাদেশের অর্থবছরে রফতানি আয় ছিলো মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন ডলার। ওই সময় জিডিপির আকার ছিলো ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা, মাথাপিছু আয় ছিলো মাত্র ১২৯ ডলার। দারিদ্র্যের হার ছিলো ৭০%। ৫০ বছর পর দেখা যাচ্ছে রফতানি ও রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের আয় বেড়ে মিলিয়ন ডলার থেকে বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছেছে। ২০২০ সালের হিসেবে প্রায় ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৩৯.৬) বেড়েছে, যা ৩৬৯ গুণ। মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১৬ গুণ অর্থাৎ ২০৬৪ ডলার। দরিদ্র্যের হার কমে হয়েছে ২০.৫ শতাংশ।
কোনো একসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলো কেউ। ইদানীং জরিপে বলা হচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে সে দেশটি হতে যাচ্ছে বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে এসেছে।
চাঁদপুর কণ্ঠ : দেশকে নিয়ে আপনার কোনো কষ্ট-বেদনা-অতৃপ্তি আছে কি?
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল কাশেম : বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে কোনো প্রকার কষ্ট-বেদনা না থাকলেও কিছু অতৃপ্তি আছে বৈকি। যেমন বাঙালি হয়েও কিয়দংশ লোক পাকিস্তানিদের মনে লালন-পালন করে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও তারা বাংলাদেশকে মেনে নিতে কষ্ট পায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি এবং মহান স্বাধীনতার শত্রুরা আজও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারছে না। তারা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে অথচ বাঙালি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে বসবাস করছে, তারা জাতীয় সঙ্গীত ও জাতীয় পতাকাকে যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন করে না। বিশেষ করে, মাদ্রাসা-মক্তবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে জাতীয় সংগীত গায় না। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এগুলোকেই আমার দুঃখ-বেদনা-অতৃপ্তি মনে করি।
চাঁদপুর কণ্ঠ : সকলের উদ্দেশ্যে আপনার পছন্দের কিছু কথা বলুন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল কাশেম : দেশ ও জাতির উদ্দেশ্যে বলবো, দেশ ও জাতিকে ভালোবাসা ঈমানের অংশ। যারা নিজের দেশ ও জাতিকে ভালোবাসে না তারা বেঈমান। মহান আল্লাহ বেঈমানদেরকে পছন্দ করেন না। তাই অসহায়, দুঃস্থ, রুগ্ন মানুষ, সুবিধাবঞ্চিত, ছিন্নমূল ও পথশিশুদের সেবা প্রদান, সামাজিক নির্যাতন প্রতিরোধ ও ধর্মীয় বিবাদ দূরীকরণে আইনী উদ্যোগ গ্রহণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ও বস্তুগত সাহায্যের মাধ্যমে পুনর্বাসিত করা, মাদক ও সন্ত্রাসের করাল গ্রাস থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করা, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, যৌতুক, বাল্যবিবাহ রোধে পরিবেশ ও শব্দদূষণ বন্ধে ফুটপাত ও ওভারপাস ব্যবহার করা এবং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইন মেনে চলার জন্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
করোনাকালীন সরকার প্রদত্ত সকল প্রকার বিধিনিষেধ মেনে চলা একান্ত বাঞ্ছনীয়। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, করোনামুক্ত থাকুন। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।