প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:২৫
‘চলেন হাঁটি’র একটি উদ্যোগে স্বস্তিতে শহরের হাঁটাপ্রেমীরা
এমএন মুরাদ খানের একক পৃষ্ঠপোষকতায় ৩ কি.মি. ও ৬ কি.মি. ওয়াকথন
আনুমানিক ৩০ থেকে ৬০ লক্ষ বছর আগে মানুষ দু পা ব্যবহার করতে শিখেছে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, জিনিসপত্র বহন করার জন্যে এবং দক্ষতার সঙ্গে এনার্জি বা শক্তিকে ব্যবহার করার সুবিধার্থে মানুষ দু পায়ে হাঁটতে শুরু করে। এই হাঁটার উপকারিতা বলে শেষ করা যায় না। হাঁটা নিয়ে স্বাস্থ্যবিদরা বলেন, হাঁটা মানুষের জীবনের এক সাধারণ অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্যকলাপ। এটি শুধু শারীরিক অনুশীলন নয়, মানসিক প্রশান্তির অন্যতম উপায়ও। প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে হাঁটা যেন এক সহজ এবং কার্যকর স্বাস্থ্যচর্চা। হাঁটা মানুষের শরীরের জন্যে এক বহুমুখী উপকার সাধন করে। এটি রক্ত চলাচল বাড়ায়, হৃৎপিণ্ডকে সবল রাখে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। নিয়মিত হাঁটা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং স্থূলতার মতো রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়ক। হাঁটা শুধু শরীর নয়, মনকেও প্রশান্ত করে। সকালে বা সন্ধ্যায় খোলা বাতাসে হাঁটা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এটি উদ্বেগ ও বিষণ্নতা দূর করে এবং মনোযোগ ও সৃজনশীলতা বাড়ায়। জিম বা ব্যায়াম করার সরঞ্জামের প্রয়োজন ছাড়াই হাঁটা সবার জন্যে সহজে উপভোগ্য। এটি এমন একটি অনুশীলন, যা যে কেউ যে কোনো বয়সে যে কোনো জায়গায় করতে পারেন। হাঁটার সময় সঠিক ভঙ্গি বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেরুদণ্ড সোজা রেখে, মাথা উঁচু করে এবং কাঁধগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় রেখে হাঁটা উচিত। আরামদায়ক জুতো পরে হাঁটলে পায়ের চাপ কমে এবং দীর্ঘ সময় হাঁটা সহজ হয়। আজকের যান্ত্রিক জীবনে মানুষ ধীরে ধীরে হাঁটার অভ্যাস হারিয়ে ফেলছে। প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে আমরা বেশিরভাগ কাজই বসে বসে করি। এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যে মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে হাঁটার অভ্যাস ফিরিয়ে আনা জরুরি। হাঁটা একটি সহজ এবং প্রাকৃতিক অনুশীলন, যা শরীর ও মনের সুস্থতার জন্যে অপরিহার্য। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস গড়ে তুললে জীবনের মান উন্নত হয় এবং রোগমুক্ত জীবনযাপন সম্ভব হয়।
|আরো খবর
নানা কারণে শহরের লোকজনের কায়িক শ্রম খুবই কম করা হয়। অনেকেই ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে শহরে হাঁটার জন্যে নিরাপদ স্থানের অভাব। সড়কগুলোতে হাঁটার পরিবেশ নেই। যে কারণে চাঁদপুর শহরের লোকজন নিরাপদ হাঁটার স্থান খুঁজছিলো। সে প্রত্যাশা পূরণে শুরু হয়েছে 'একটি উদ্যোগ’-এর ‘চলেন হাটি’ কর্মসূচি দিয়ে। যাঁর উদ্যোক্তা শহরের আলম পলাশসহ আরো কয়েকজন।
গত ১ জুন ২০২৪ ভোর ৬টায় এই কর্মসূচি শুরু হয় জেলার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ ‘চাঁদপুর সরকারি কলেজ’ ক্যাম্পাসে। বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ এই কর্মসূচিতে যোগ দেন। খুবই মনোরম ও প্রাকৃতিক পরিবেশে এই কর্মসূচির উদ্যোগ নেন তারা।
এই কর্মসূচিতে হাঁটতে আসা মুক্তা রহমান বলেন, আমাদের হাঁটার জন্যে সড়কই সমস্যা। মসৃণ ও সমান্তরাল সড়ক নেই। অনেক সময় হাঁটার সঙ্গী থাকে না। সুন্দর জায়গা পাওয়া যায় না। যখন কলেজের এই সুন্দর পরিবেশ করার কাজ চলছিলো, তখনই আশা করেছি এখানে আমাদের জন্যে হাঁটার অনুমতি থাকলে ভালো হতো। অবশেষে আমাদের নিরাপদ হাঁটা শুরু হলো।
মোসা. আফরোজা পারভীন নামে আরেকজন বলেন, আমি নিয়মিত হাঁটি, তবে আমার বাসায়। কারণ রাস্তায় অনেক গাড়ি, রিকশা ও অটো। নিরাপত্তার অভাব। ‘চলেন হাঁটি’-এর এই উদ্যোগটি আমার খুবই ভালো লেগেছে। যাঁরা উদ্যোগটি নিয়েছে তাদেরকে এবং কলেজ কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। আসুন আমরা সবাই এই ‘চলেন হাঁটি’ কর্মসূচিতে যোগ দেই।
অ্যাড. মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, শহরে হাঁটার জায়গা না থাকার কারণে ঠিকমতো হাঁটা যায় না। আমাদের নিজেদের বিদ্যাপীঠে মনোরম পরিবেশে হাঁটতে পেরে খুবই ভালো লেগেছে। এতে হাঁটার পাশাপাশি নানাজনের সাথে কুশলাদি বিনিময় হয়।
'চলেন হাঁটি'র আয়োজনে ২৩ নভেম্বর ২০২৪ শনিবার সকালে চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠ থেকে তিন কিলোমিটার ও ৬ কিলোমিটার ওয়াকথন সম্পন্ন হয়েছে। এ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ও 'চলেন হাটি'র উপদেষ্টা মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন পুলিশ সুপার মুহাম্মদ আব্দুর রকিব, পিপিএম । অনুষ্ঠানে সভাপ্রধান ছিলেন চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ এম এ মান্নান। দিনের শুরুতে অতিথিবৃন্দ শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে হাঁটা কর্মসূচির সূচনা করেন।
'চলেন হাঁটি' সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আলম পলাশ বলেন, গত ৬ মাস পূর্বে শহরের বেশ কিছু লোকজন নিয়ে চাঁদপুর সরকারি কলেজে হাঁটার জন্যে উদ্যোগ নেই। এই বিষয়ে আমরা কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি চাইলে, কলেজ কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেন। তবে কলেজের পক্ষ থেকে পরিচয়পত্রসহ লোকদের হাঁটার জন্যে শর্ত দেন। যে কারণে একটি সামাজিক সংগঠন করার চিন্তা করা হয়। তার প্রেক্ষিতে আমরা ক্রীড়া ও সামাজিক সংগঠন ‘একটি উদ্যোগ’-এর পক্ষ থেকে ‘চলেন হাঁটি’ কার্যক্রম শুরু করি। তিনি আরও বলেন, শহেরর লোকজনের সড়কে হাঁটা নিরাপদ নয়, হাঁটতে গিয়ে নানা দুর্ঘটনার শিকার হন। তবে সুস্থ থাকার জন্যে আমাদের প্রত্যেকেরই হাঁটা প্রয়োজন। আমাদের উদ্যোগের কারণে এখন বহু লোক প্রতিদিন কলেজ মাঠে হাঁটতে আসেন। এতে পরস্পরের প্রতি সামাজিক বন্ধন তৈরি হচ্ছে এবং সকাল বেলা একটি মিলন মেলা সৃষ্টি হয়।
আলম পলাশ বলেন, ইতোমধ্যে আমরা এই উদ্যোগে সম্পৃক্তদের নিবন্ধনের মাধ্যমে পরিচয়পত্র বিতরণ ও টি-শার্ট প্রদান করেছি। সকলে টি-শার্ট ও আইডি কার্ড পরিধান করে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন। এই সংগঠনের আরো ইভেন্ট রয়েছে-- বাস্কেটবল ও মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ। ভবিষ্যতে আজকের চেয়েও বড়ো ধরনের ম্যারাথন আয়োজন এবং সাঁতার প্রশিক্ষণের পলিকল্পনা রয়েছে। তিনি বলেন, আজকে এই প্রথম প্রতিযোগিতায় পুরুষদের বয়সভিত্তিক দুটি দলের মধ্যে একটি ১৫ থেকে ৪৫ বছর ও অপরটি ৪৬ থেকে ৭৫ বছরের। নারীদের জন্যেও দুটি দল। একটি ১৫ থেকে ৪৫ বছর এবং অপরটি ৪৬ থেকে ৭৫ বছর বয়সীদের। চাঁদপুর সরকারি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে পুরুষরা শহরের ৬ কিলোমিটার এবং নারীরা ৩ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে ম্যারাথন শেষ করেন। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ৪টি গ্রুপে ১২ জনকে দেয়া হয় সনদ, মেডেল ও ক্রেস্ট।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মহাসিন উদ্দিনের উদ্বোধনী ঘোষণার মাধ্যমে হাঁটা কর্মসূচি শুরু হয়। এরপর পুরুষদের গ্রুপটি চাঁদপুর সরকারি কলেজ হতে ইলিশ চত্বর-স্টেডিয়াম রোড-ট্রাক রোড, বিআইডব্লিউটিএ মোড়, নতুন বাজার, মেথা রোড, কবি নজরুল সড়ক, পাল বাজার মোড়, কুমিল্লা রোড হয়ে আবার চাঁদপুর সরকারি কলেজে এসে শেষ করে। আর নারীদের গ্রুপটি চাঁদপুর সরকারি কলেজ হতে ইলিশ চত্বর-স্টেডিয়াম রোড, মিশন রোড, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়ক, আল্লাহ চত্বর, কুমিল্লা রোড হয়ে আবার চাঁদপুর সরকারি কলেজে এসে শেষ করে। এরপর চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠে সকালের নাস্তা বিতরণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ডায়াবেটিস নির্ণয়, রক্তের চাপ পরিমাপ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে অংশগ্রহণকারীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। এরপর সমাপনী ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠিত হয়।
সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আলম পলাশের সঞ্চালনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমাদের সুস্থ থাকার জন্যে হাঁটা যেমন প্রয়োজন, তেমনি মনকে ভাল রাখার জন্যে ভালো পরিবেশে আসতে হবে। নানা কাজ শেষে সকালে যখন হাঁটবেন এবং সবার সাথে দেখা হবে তখন আপনার মনে প্রশান্তি আসবে। নিজের নানা ব্যস্ততার মাঝে একত্র হয়ে কথা হলে মন হালকা হবে এবং ধীরে ধীরে মন সুস্থ হতে থাকবে। হাঁটার জন্যে যখন সকলে একত্রিত হবেন, তখন নিজেদের মধ্যে একটি সামাজিক বন্ধন তৈরি হবে। আমরা ভালো পরিবেশ করে দিতো পারবো, কিন্তু সেটি ধরে রাখার দায়িত্ব আপনাদের। আর ভালো পরিবেশ আমাদের স্বাস্থ্যের জন্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
সমাপনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পুলিশ সুপার মুহম্মদ আবদুর রকিব পিপিএম, চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা (ইউএনও) সাখাওয়াত জামিল সৈকত ও চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. একেএম মাহাবুবুর রহমান।
অনুষ্ঠানে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ৪টি দলের ৩জন করে ১২জন বিজয়ীকে সনদ, মেডেল ও ক্রেস্ট প্রদান করা হয়। অংশগ্রহণকারী অতিথিসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, শিক্ষক, আইনজীবী ও সাংবাদিকরা আয়োজনের বিষয়ে লিখিত মন্তব্য করেন।
উপস্থিত ছিলেন চাঁদপুর প্রেসক্লাব সভাপতি শাহাদাত হোসেন শান্ত, চাঁদপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম, যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি মির্জা জাকির, টেলিভিশন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি রিয়াদ ফেরদৌস, সময় টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি ফারুক আহাম্মদ, যমুনা টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি কাদের পলাশ, ফটোজার্নালিস্ট এসোসিয়েশন চাঁদপুর জেলা শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ক্রীড়া সাংবাদিক চৌধুরী ইয়াসিন ইকরাম, এখন টিভির তালহা জুবায়ের, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনের মনির হোসেন বাবলুসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক ও সুধীজন।
ওয়াকথন প্রতিযোগিতার একক পৃষ্ঠপোষকতায় ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক এন এম খান মুরাদ।