বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪  |   ২৮ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের পুত্রবধূ মাদকসহ যৌথ বাহিনীর হাতে আটক।
  •   মহাখালীতে ট্রেন থামিয়ে শিক্ষার্থীদের হামলা, শিশুসহ কয়েকজন রক্তাক্ত
  •   কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে শিক্ষক লাঞ্ছনা ও ভাংচুরের ঘটনা গৃদকালিন্দিয়া কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ॥ পাঠদান স্থগিত
  •   চট্টগ্রামে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের ঝটিকা মিছিল থেকে অর্থদাতাসহ দুজন গ্রেপ্তার।
  •   রাষ্ট্রীয় পদে আসীন হচ্ছেন খবরে আসামিপক্ষে শুনানি করলেন না সমাজী।

প্রকাশ : ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫১

অভিনন্দন আমাদের নারী ফুটবল দল

পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
অভিনন্দন আমাদের নারী ফুটবল দল

কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি আমাদের নারীরা বাঘিনীর রূপ ধরে মাঠ মাতাবে, গ্যালারি জয় করে কাপ ঘরে নিয়ে আসবে। যাঁদের মনভরা মমতা, যাঁদের তনুর প্রতি অণুতে মায়ের কোমল প্রাণের ঘ্রাণ, তারা কখনো রুক্ষ মাঠে রুদ্ররূপিনী হয়ে বধ করবে বিপক্ষের আগ্রাসনকে। দুর্গেশনন্দিনীকে যিনি সৃজন করেছেন আপন মননের নির্মাণ-কুশলতায়, স্বয়ং সেই বঙ্কিমও একসময় বাঙালি নারীকে নিয়ে উপহাস করে বলেছিলেন, 'ঘর হৈতে আঙিনা বিদেশ।' বাংলাদেশের অদম্য নারীরা বঙ্কিমের মন্তব্যকে পাগলের প্রলাপে পরিণত করে প্রমাণ করেছে, 'ইচ্ছা করিলে উপায় হয়।' বাঙালি নারী আজ যেমন এভারেস্ট জয় করেছে, তেমনি একদিন, ঊনিশশো বায়ান্ন সালে তারাই পুরুষের পাশাপাশি রাজপথে নেমেছিলো বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি নিয়ে। ঊনিশশো তিরিশের প্রীতিলতাকেই আবার আমরা যেন দেখতে পেলাম ঊনিশশো একাত্তরে তারামন বিবি, কাঁকন বিবি কিংবা ক্যাপ্টেন সেতারার মহা কীর্তিতে। আজকের কৃষ্ণা, মারিয়া মান্দা কিংবা আনুচিং, মগিনীদের মুখে মুখে আমরা খুঁজে পাই কুমুদিনী হাজং-ইলা মজুমদারের সংগ্রামের সোনালি আভাকে।

অজপাড়াগাঁ ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রামের এগার জন নারী ফুটবলারের সাহসে-প্রত্যয়ে আমরা ঠিকরে পড়তে দেখি ময়মনসিংহ গীতিকায় বর্ণিত জঙ্গলবাড়ির অজেয় যোদ্ধা সুলতানা রাজিয়ার অমিত বিক্রমকে।

দেশ যখন দুর্নীতির করাল গ্রাসে আঁধারগ্রস্ত, আশার সবটুকু আলো যখন কেড়ে নিয়েছে ভুল ইতিহাসের ভয়াল শকট, তখন আমাদের নারী ফুটবলারদের বীরত্ব আমাদের জন্যে নিয়ে এসেছে সুড়ঙ্গ ভেদ করে আলোর দিশা। সে আলোয় পথহীন বাঙালি ফিরে পেয়েছে বেঁচে ওঠার শ্বাস। বিশ্ব যখন এগিয়ে যাচ্ছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মানবকল্যাণমূলক ব্যবহারে, তখন আমরা পড়ে ছিলাম এবং এখনও পড়ে আছি নারীদের পরিধেয় পোশাকের দৈর্ঘ্য পরিমাপে। এহেন বৈরী দিনে আমরা সৌভাগ্যবান, আমাদের নারী ফুটবলারদের বদৌলতে আমরা আজ দক্ষিণ এশিয়ায় অর্জন করেছি শ্রেষ্ঠত্ব। অনেক না পাওয়ার মধ্যে আমাদের এই প্রাপ্তি মেঘের প্রগাঢ় স্তর চিরে আলোর রজত রেখার মতো আশা জাগানিয়া।

আজকে যাদের আলোয় আমরা আলোকিত, সময় এবং সমাজ তাদের আঁধারে রেখেছিলো দীর্ঘদিন ধরে। খেলোয়াড়ের পোশাকে মাঠে অনুশীলন তো দূরের কথা, মেয়েরা হাজারো পুরুষের সামনে ফুটবল খেলবে এটা তো মানার মতো নয়। কিন্তু আমরা ভাগ্যবান, এইসব মেয়ের পাশে দৃঢ় ধৈর্য আর মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাদের সাদামাটা বাবা-মায়েরা। এতোদিন যখন তারা লড়াই করছিলো দারিদ্র্য আর অসচ্ছলতার বিরুদ্ধে, তখন কেউ তাদের খবর নেয়নি। তাদের অনাহার-অর্ধাহারে কেউ তাদের মুখে তুলে দেয়নি একমুঠো অন্ন। কিন্তু যখন তারা আত্মপরিচয় বিনির্মাণে কঠোর সংকল্পে এগিয়ে গেলো, তখন নানা দোহাই দিয়ে তাদের আটকানোর মধ্যযুগীয় চেষ্টা করা হলো। কিন্তু নিয়তি যার বিধিতে লিখে রেখেছে শিরোপা, তাকে বঞ্চিত করে রাখতে পারে কে? তাই শত বাধা উপেক্ষা করেও তারা এগিয়ে এসেছে আঁধার সমুদ্র পেরিয়ে। অপুষ্টি আর অসচ্ছলতা তাদের টেনে রাখতে পারেনি পিছে। তারা কলসুন্দরে, সাতক্ষীরায়, খাগড়াছড়িতে, রাঙামাটি কিংবা বান্দরবানে নিজেদের ধীরে ধীরে তৈরি করেছে ভবিষ্যতের ফুটবল-কুরুক্ষেত্রের জন্যে। শুরুতে তারা একলব্য হলেও দিনশেষে গুরু দ্রোণাচার্যরূপী গোলাম রাব্বানী হেলালের কাছে এক একজন অজেয় অর্জুনে পরিণত হলো। তারা খেলার মাঠকে ইন্দ্রপ্রস্থ বানিয়ে জয় করে নিলো শিরোপা।

দুহাজার নয় সালের ঊনত্রিশে জানুয়ারি নিজেদের মাঠে নেপাল নারী ফুটবল দলের বিপক্ষে খেলতে নেমে যাত্রা শুরু বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের। দুহাজার বাইশ সালের ঊনিশে সেপ্টেম্বর নেপাল নারী ফুটবল দলের বিরুদ্ধে ৩-১ গোলের ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে তারা প্রমাণ করেছে, সুযোগ পেলে এবং যত্ন পেলে তারাই হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের আসল মণিমুক্তা। মুখ থুবড়ে পড়া পুরুষ ফুটবল দলের বিপরীতে সমাজ ও সংগঠনের অবহেলা এবং প্রতিনিয়ত বিরোধিতা সত্ত্বেও তারা দক্ষিণ এশিয়ায় দেশকে এনে দিয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব। অথচ মাত্র অল্প কটা টাকার জন্যে বিমান ভাড়া না দিতে পারার অজুহাতে তাদেরকে মিয়ানমারে খেলতে পাঠায়নি বাফুফে। সেই নারীরাই আবার দুহাজার চব্বিশে এসে একই নেপালকে ২-১ গোলে হারিয়ে সাফ শিরোপা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। এবারও শোনা গেলো, গত তিন মাস ধরে বেতন পাচ্ছে না তারা। অথচ তাদের বেতন লাখ নয়, হাজার টাকা। কারও পঞ্চাশ, কারও তিরিশ, কারও কুড়ি কিংবা কারও আঠারো হাজার টাকা মাত্র। এতো অল্প টাকা বেতনে তারা খেলে দেশকে যে শিরোপা এনে দিলো তা আমাদেরকে মর্যাদাবান করেছে নিশ্চয়ই। অথচ এদেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে কানাডায় কেউ কেউ গড়ে তুলেছে বেগম পাড়া, কেউ কেউ ছেলের খুশির জন্যে দুর্নীতির টাকায় দশ-বারো লাখেও ছাগল কিনতে পারে। কেবল নারীদের ফুটবল খেলার কথা বললেই যত অজুহাত আর দারিদ্র্য।

কেউ কেউ নারীদের এখনও দমিয়ে রাখতে চান মধ্যযুগীয় বিভিন্ন দোহাই দিয়ে। কিন্তু এটা তারা মনে রাখেন না, মাঠে-ময়দানে কাজ করতো বলেই নারীদের হাত ধরেই আবিষ্কৃত হয়েছে কৃষিকাজ ও চাষাবাদ। খেলার মাঠে খেলতে গিয়ে নারীকে যতটুকু স্বাধীনতা দেওয়া দরকার তা আমাদের দিতেই হবে। তাদের প্রতিভা ও দক্ষতাকে জাতির ব্যবহার করতেই হবে। রাষ্ট্রের উন্নয়ন হলো একটি উড্ডীয়মান পাখি যার দুটো ডানা, একটা পুরুষ আর একটা নারী। পাখি যেমন একডানা আহত হলে উড়তে পারে না, তেমনি রাষ্ট্রের উন্নয়নও নারী-পুরুষ যে কোনো একপক্ষের অংশগ্রহণ বিনা সম্ভব নয়। তাই নারী ফুটবল দলকে নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

আমাদের নারী ফুটবলাররা অধিকাংশই দরিদ্র ও অসহায় পিতামাতার সন্তান। তাদের কারও মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই, কেউ ঠিকমতো দুবেলা খেতে পায় না। আবার কারও পুষ্টি ঘাটতি তীব্র। তবুও তারা অদম্য। তাদের দম ও উদ্যমের ঘাটতি নেই।

কিছুদিন আগে চাঁদপুরের মমিনউল্লাহ পাটোয়ারী বীর প্রতীক প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে কয়েকজন তৃণমূলের শিক্ষার্থী বাস্কেটবলে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্যে আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছেছে। এটা আমাদের জন্যে স্বপ্ন ও স্বস্তির সংবাদ। এরকম যদি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নারীদের ক্রীড়ায় নিয়ে এসে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতো, তবে প্রতিটা স্কুল হয়ে উঠতো এক একটা কলসিন্দুর গ্রাম।

আমি স্বচক্ষে দেখেছি, দুহাজার আঠারো সালের বিকেলগুলোতে চাঁদপুর স্টেডিয়ামে তৎকালীন জেলা প্রশাসক, চাঁদপুর জনাব মাজেদুর রহমান খান নারী ফুটবলারদের অনুশীলন দেখতে আসতেন এবং তাদের উৎসাহ দিতেন। এ দৃশ্য আমার চোখে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে এঁকে তুলেছিলো। এই দৃশ্যকে অবিরাম বলবৎ রেখে বলতে চাই, নারী ক্রীড়াবিদদের হেনস্তা নয়, সাফল্যে হিমালয়ের শীর্ষে চড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে হবে। ইতোমধ্যে অনেক নারী ফুটবলার কষ্টে ফুটবল খেলায় ইস্তফা দিয়েছে। আমরা আনুচিং মগিনীর মতো খেলোয়াড়দের হারিয়ে ফেলেছি। আমরা চাই না কৃষ্ণা, ঋতুপর্ণা, মারিয়া মান্দা, রুপনারা হারিয়ে যাক সমাজের অসহযোগিতা ও অসহিষ্ণুতার কারণে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আমাদের মেয়েরা যে দ্বিতীয়বারের মতো আমাদের গর্বিত করলো সাফ ফুটবলের শিরোপা অক্ষুণ্ন রেখে, তার জন্যে তাদেরকে টুপিখোলা অভিনন্দন।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়