প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:১৪
গণতন্ত্র: ধারণা, স্তম্ভ এবং প্রয়োগ
"আমাদের গণতন্ত্র, আমাদের ভবিষ্যৎ: বিএনপির ৩১ দফা"
গণতন্ত্র (Democracy) একটি শাসনব্যবস্থা যেখানে জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে এবং রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে। এটি এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে জনগণের মতামত, ইচ্ছা ও প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা হলো জনগণের সার্বভৌমত্ব, অর্থাৎ জনগণ সরকারের মালিক। এই শাসনব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল জনগণের স্বাধীনতা ও অধিকার সুরক্ষিত রাখা, যাতে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান অধিকারী হতে পারেন এবং নিজেদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন।
|আরো খবর
গণতন্ত্রের পূর্ণতা তখনই আসে, যখন জনগণ তাদের ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারে, সরকারের কার্যক্রমের প্রতি নজর রাখতে পারে, এবং একটি সুষ্ঠু আইনি কাঠামো ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলতে থাকে। গণতন্ত্র শুধু একটি ভোটদান প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি একটি সাংবিধানিক ও আইনি কাঠামো, যেখানে সকল নাগরিকের অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং তারা নির্দ্বিধায় সমাজে নিজেদের মতামত ও কৌশল প্রকাশ করতে পারে।
গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলো:১. জনগণের সার্বভৌমত্ব (Popular Sovereignty): গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণের সার্বভৌমত্ব, যা অন্যভাবে বলা যায়, জনগণের শাসন। গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের শাসনক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে। জনগণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করে এবং তাদের ভোটের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন করে। জনগণের মতামত এবং ইচ্ছার উপরই রাষ্ট্রের কার্যক্রম নির্ভর করে।
২. বিচারব্যবস্থা (Judiciary): একটি শক্তিশালী এবং স্বাধীন বিচারব্যবস্থা গণতন্ত্রের অপরিহার্য অংশ। একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করা সম্ভব হয়। গণতন্ত্রে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখতে বিচারব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক চাপ থেকে বিচার বিভাগ মুক্ত থাকে এবং শুধুমাত্র আইনের আলোকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
৩. মুক্ত গণমাধ্যম (Free Media): গণতন্ত্রে একটি স্বাধীন গণমাধ্যম অপরিহার্য, কারণ এটি সরকারের কাজের প্রতি জনগণের নজরদারি রাখে, জনমত তৈরি করে এবং সঠিক তথ্য প্রদান করে। গণমাধ্যম সরকারের কার্যকলাপের উপর প্রশ্ন তোলে, মানুষের মতামত প্রকাশে সহায়তা করে এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন আনার ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা জনগণের মৌলিক অধিকার হিসেবে গণ্য করা হয়।
৪. নির্বাচন ব্যবস্থা (Electoral System): গণতন্ত্রে সুষ্ঠু, অবাধ, এবং ন্যায়সঙ্গত নির্বাচন ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধিকে নির্বাচন করে এবং তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থায়, জনগণ তাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ পায় এবং সরকার তাদের জন্য কাজ করে। নির্বাচনী ব্যবস্থা দুর্নীতিমুক্ত, সুশৃঙ্খল এবং জনগণের জন্য উপযুক্ত হলে একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
৫. অধিকার ও স্বাধীনতা (Rights and Freedoms): গণতন্ত্রে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর মধ্যে বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের অধিকার এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার অন্তর্ভুক্ত। গণতন্ত্রে নাগরিকদের এসব অধিকার সুরক্ষিত থাকে এবং তাদের স্বাধীনতার ক্ষতি করার কোনো সুযোগ থাকে না। একটি কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যখন নাগরিকরা তাদের স্বাধীনতা এবং অধিকারকে স্বীকৃতি পায় এবং তারা নির্ভয়ে সমাজে অংশগ্রহণ করতে পারে।বিএনপি’র ৩১ দফা এবং গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের ৩১ দফা ঘোষণার মাধ্যমে দেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য একটি নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে। এই ঘোষণার মাধ্যমে বিএনপি দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে। এখন, এই ৩১ দফায় যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে তা কীভাবে গণতন্ত্রের স্তম্ভগুলোকে শক্তিশালী করবে এবং একটি উন্নত, সুশাসিত ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে, তা বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।১. জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং সুষ্ঠু নির্বাচন:বিএনপি তাদের ৩১ দফায় জনগণের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করার জন্য সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচনের আয়োজনের কথা উল্লেখ করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, নির্বাচনী কমিশনকে স্বাধীন করা এবং ভোটাধিকার সুরক্ষিত রাখা জরুরি। বিএনপি নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছাকে শক্তিশালী করে তুলতে চায় এবং সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত। ২. বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা: বিএনপি তাদের ঘোষণায় বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার উপর গুরুতর গুরুত্ব দিয়েছে। একটি শক্তিশালী, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা সুশাসন নিশ্চিত করার অন্যতম উপায়। বিএনপি তাদের ৩১ দফায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত। ৩. মুক্ত গণমাধ্যম:বিএনপি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এবং সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে চায়। গণমাধ্যম জনগণের সঠিক তথ্য জানাতে এবং সরকারের প্রতি জনমত তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দফায় জনগণের তথ্য জানার অধিকার সুরক্ষিত রাখতে এবং সরকারের কার্যকলাপের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। ৪. দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা: দুর্নীতি গণতন্ত্রের অন্যতম শত্রু। বিএনপি তাদের ৩১ দফায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জানিয়েছে। দুর্নীতি দূরীকরণে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি দূর করা হলে, জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব এবং রাষ্ট্রের কার্যক্রম আরো গতিশীল হবে। ৫. মানুষের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা:বিএনপি তাদের ঘোষণায় মানুষের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে। বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশের অধিকার এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এসব অধিকার জনগণের মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিএনপি'র ৩১ দফা ঘোষণায় গণতন্ত্রের সকল স্তম্ভের প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এসব দফার মাধ্যমে গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব বলে মনে হয়। জনগণের সার্বভৌমত্ব, বিচারব্যবস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং মৌলিক অধিকার রক্ষায় গ্রহণ করা পদক্ষেপগুলি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী এবং কার্যকর করবে।
এখনো, এসব দফার বাস্তবায়ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নির্ভরশীল। তবে, বিএনপির ৩১ দফা ঘোষণার মাধ্যমে এক শক্তিশালী, দুর্নীতিমুক্ত এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের দিকে পদক্ষেপ নিয়েছে, যা জনগণের জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।
লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, চাঁদপুর জেলা বিএনপি, শিক্ষক নেতা।