প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১২
ছায়ার নেপথ্যে শাসন : দুর্নীতির অদৃশ্য সুতোয় নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি ও সমাজ

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্বেতপত্র কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন একটি অশনি সংকেত। এতে উন্মোচিত হয়েছে আওয়ামী লীগ শাসনামলে দুর্নীতির বহুমাত্রিক কৌশল, যা শুধু অর্থনীতিই নয়, প্রশাসনিক কাঠামোকেও দুর্বল করে দিয়েছে। ব্যাংক থেকে অবকাঠামো, জ্বালানি থেকে তথ্যপ্রযুক্তি—প্রতিটি ক্ষেত্রই দুর্নীতির শিকার।
|আরো খবর
ব্যাংক খাত : অর্থনীতির মেরুদণ্ডে আঘাত
শ্বেতপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাত ছিলো দুর্নীতির প্রধান লক্ষ্য।
ঋণ কেলেঙ্কারি : প্রতারণাপূর্ণ ঋণ প্রক্রিয়া, ঋণের অর্থ আত্মসাৎ এবং পুনরুদ্ধারে অক্ষমতা।
ব্যাংক অধিগ্রহণ : রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তায় ব্যাংকের মালিকানা জোরপূর্বক দখল।
অর্থ পাচার : বেআইনিভাবে অর্জিত অর্থের বিপুল পরিমাণ বিদেশে পাচার।
এই পদ্ধতিগুলো অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ব্যাংকের স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিনিয়োগ পরিবেশ।
উন্নয়ন প্রকল্প : সুযোগের আড়ালে অপচয় দুর্নীতির আরেকটি বড়ো ক্ষেত্র ছিলো।
অলাভজনক প্রকল্প : শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থে এমন প্রকল্প গ্রহণ, যা বাস্তবায়নের যোগ্যতা বা প্রয়োজনীয়তা ছিলো না।
প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি : অনুমোদনের পর ব্যয় কৃত্রিমভাবে বৃদ্ধি করে তহবিল আত্মসাৎ।
দরপত্রে স্বজনপ্রীতি : প্রতিযোগিতাহীন দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর লাভ।
এ ধরনের দুর্নীতি শুধু সম্পদের অপচয়ই নয়, সাধারণ মানুষের করের টাকাও অপব্যবহার করেছে।
প্রশাসনিক দুর্নীতি : নিয়োগ ও পদোন্নতিতে অনিয়ম।
স্বজনপ্রীতি : রাজনৈতিক আনুগত্যকে মেধার চেয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রশাসনিক নিয়োগ।
পদোন্নতির জন্যে ঘুষ : প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার বিপরীতে ঘুষের মাধ্যমে পদোন্নতি।
তথ্য গোপন : গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করে স্বার্থান্বেষীদের সুবিধা প্রদান।
এই ধরনের দুর্নীতি প্রশাসনের দক্ষতা ও স্বচ্ছতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত খাতসমূহ
শ্বেতপত্রে দেখা গেছে, দুর্নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলো হলো :
১. ব্যাংক খাত : আর্থিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট।
2. ভৌত অবকাঠামো : তহবিল অপব্যবহার ও দীর্ঘসূত্রিতা।
৩. জ্বালানি ও বিদ্যুৎ : জনজীবনে সংকট সৃষ্টি।
৪. তথ্যপ্রযুক্তি : সম্ভাবনাময় খাত হলেও দুর্নীতি এগিয়ে যেতে বাধা দিয়েছে।
সম্ভাব্য প্রতিকার ও করণীয়
শ্বেতপত্রের উত্থাপিত সমস্যাগুলোর প্রতিকার সম্ভব সুশাসন ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে।
১. দুর্নীতির তদন্ত : দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা।
২. স্বচ্ছ নীতিমালা : ব্যাংক খাত ও উন্নয়ন প্রকল্পে কঠোর নীতিমালা প্রয়োগ।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার : নিয়োগ ও পদোন্নতিতে মেধার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত।
৪.জনসচেতনতা বৃদ্ধি : দুর্নীতি প্রতিরোধে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা।
উপসংহার
শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদন শুধু একটি নিরীক্ষা নয়, বরং একটি শিক্ষণীয় দলিল। এটি স্পষ্ট করেছে যে, সুশাসন ও স্বচ্ছতা ছাড়া কোনো দেশই টেকসই উন্নয়ন অর্জন করতে পারে না। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্যে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব, প্রশাসন এবং সাধারণ জনগণের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।