প্রকাশ : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০
আমি চাদর গায়ে দিয়ে টুঙ্গিপাড়া চলে যাবো-জাতির পিতা শেখ মুজিব
১৯৭৪ সালের ২৪ জুলাই নূরুল ইসলাম ঠান্ডু ভাই (রাকসু ভিপি, বর্তমান আওয়ামী লীগ জাতীয় কমিটির সদস্য) ও মির্জা আনিসুর রহমান (ভিপি এসএম হল) ও আমি, নওগাঁ হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আব্দুল জলিল ভাইয়ের বাসায় যাই। জলিল ভাইয়ের সাথে গণভবনে আসি। গণভবন গেটে আমাদের জন্যে অপেক্ষারত ছিলেন মন্নুজান হল ছাত্রী সংসদ ভিপি ও সংসদ সদস্য লাইজু আপা। নাটোর হতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলাম আমাদের সাথে যুক্ত হন। উদ্দেশ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ হতে বঙ্গবন্ধুর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎকার।
গণভবনে ঢুকে জলিল ভাই বঙ্গবন্ধুর কক্ষে ঢুকতেই তিনি উঠে আসলেন। বললেন, ‘চল লনে বসি’। আমরা ওনার সাথে পূর্ব পাশে লনে এসে বসলাম। কর্মচারীগণ লনে চেয়ার এনে দিলো। বঙ্গবন্ধু মাঝ চেয়ারটায় বসলেন। আমাদের সাথে যুক্ত হলেন তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলী। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব শ্রদ্ধেয় তোফায়েল আহমেদ ভাই বঙ্গবন্ধুর সাথেই ছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর সাথে কুশল বিনিময় শেষে তিনি আমাদের দেশের তৎকালীন পরিস্থিতির উপর কিছু বললেন এবং ঐদিন মওলানা ভাসানী, মশিহূর রহমান যাদু মিয়া ও আতাউর রহমান খানদের পল্টনে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশের বিষয়ও জানালেন। বললেন : মুনসুর ভাইকে (তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) বলেছি রাজাকারটাকে (যাদু মিয়াকে) লাল দালানে রেখে আসতে। (যাদু মিয়া রাজাকার ছিলেন। পরবর্তীতে জিয়া জেল থেকে ছাড়িয়ে এনে তাকে সিনিয়র মন্ত্রী বানিয়েছিলেন) আর মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খানকে সম্মানের সাথে বাড়ি পৌঁছে দিতে।
কথাগুলো শেষ হতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম মুনসুর আলী এসে হাজির হলেন। ওনাকে দেখেই বঙ্গবন্ধু আমাদের বসতে বলে তাৎক্ষণিক উঠে গেলেন এবং কিছুক্ষণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওনার সাথে কথা বলে আবার এসে আমাদের সাথে যোগ দিতে চেয়ারে বসলেন। আমরা ঔৎসুক্যের সাথে কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। গম্ভীর হয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন ‘রাজাকারটাকে (মশিউর রহমান) লাল দালানে আর আতাউর রহমান খানকে নিজ বাসায় ও মওলানা ভাসানীকে সসম্মানে সন্তোষ, টাঙ্গাইলে ওনার বাড়িতে পাঠায়ে দেয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং বললেন, দেশে যা শুরু হয়েছে তাতে আমার আর ক্ষমতায় থাকা হবে না (উল্লেখ্য তখন ছাত্রলীগে স্নায়ুযুদ্ধ, বিভাজন, জাসদ সৃষ্টি, আওয়ামী লীগে ভুল বোঝাবুঝি, মোশতাক গ্রুপ সক্রিয়, তাজউদ্দিন আহমেদ, ওসমানী, আবু সাইয়িদ চৌধুরীসহ বঙ্গবন্ধুর সাথে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের অতি বিশ্বস্ত বন্ধু নেতাদের দূরত্ব সৃষ্টি ও মোশতাকের ফায়দা হাসিলের ষড়যন্ত্র, দুর্ভিক্ষ, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সব মিলিয়ে অবস্থা ভালো ছিল না)। সংসদ সদস্য লাইজু আপা বললেন, এ সিংহাসন শুধু আপনার। ঈষৎ হেসে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলার সিংহাসন নাহি রবে খালি। বঙ্গ থাকবে, বন্ধু থাকবে না। জাতি থাকবে পিতা থাকবে না। আমার যদি সিংহাসনে থাকতে হয় তাহলে জাতির পিতা আমার থাকা হবে না’। ঠান্ডু ভাই বললেন, তবুও আপনারই এই সিংহাসন। বঙ্গবন্ধু হেসে দিয়ে আমাকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘আব্দুর রহমান তুই ত আইনের ছাত্র, বলতো জাতির পিতা না থাকলে সে জাতি কী হয়?’ বলেই খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন এবং বলে উঠলেন, ‘সবাই যা শুরু করেছে আমি চাদর গায়ে দিয়ে টুঙ্গিপাড়া চলে যাব’।
রাজনীতির নানা মেরুকরণের মধ্য দিয়ে দেশে ১৯৭৫-এর জানুয়ারি মাসে বাকশাল প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৫ আগস্ট গোপালগঞ্জ সংলগ্ন মানিকদাহ গ্রামে এমদাদুল হক চৌধুরী বর্তমান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি সাহেবের বাড়িতে ছিলাম। সকাল ৬টার দিকে একটি বাচ্চা ছেলে খবর দিল শেখ মুজিবকে হত্যার খবর হচ্ছে রেডিওতে। আমি ও চৌধুরী সাহেব লাফিয়ে উঠলাম। রেডিও খুললাম। খবর শুনে নির্বাক হয়ে গেলাম। কানে বেজে উঠল গণভবনে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত ভবিষ্যদ্বাণী ‘বাংলার সিংহাসন নাহি রবে খালি, বঙ্গ থাকবে, বন্ধু থাকবে না। জাতি থাকবে, পিতা থাকবে না, আমি চাদর গায় দিয়ে টুঙ্গিপাড়া চলে যাব’।
১০টার দিকে আমি ও চৌধুরী সাহেব শহরে আসি। শহর জনপদ স্তব্ধ ছিলো। শুধুমাত্র তৎকালীন বঙ্গবন্ধু কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা গোলাম খান মিরাজের নেতৃত্বে ছাত্রদের প্রতিরোধ পুলিশের বাধায় পড়ে। এছাড়া কোথাও কোনো পাখির ডাক, জনপদে কোলাহল ছিলো না, বাতাসে ছিলো না কোনো স্পন্দন। গভীর উৎকণ্ঠায় ১৫ আগস্ট শেষ হলো। পরদিন সকাল ১০টার দিকে হেলিকপ্টারটি দেখা গেলো টুঙ্গিপাড়ার আকাশে। আমার পরম শ্রদ্ধেয়, বাংলা মায়ের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান, বাংলার মহানায়ক, স্বাধীন বাংলার স্থপতি, জাতির পিতা চাদর গায়ে দিয়ে টুঙ্গিপাড়া আসলেন।
১৯৭৮ সালের ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু প্রাক্তন মন্ত্রী মোল্লা জালালউদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট মাহবুব আলী, গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা রইস মিয়া, এমদাদুল হক চৌধুরী (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান), আক্তার উদ্দিন মিয়া, সাবেক সংসদ সদস্য, আরও কিছু নেতা-কর্মীসহ টুঙ্গিপাড়া যাই। এখানে এসে বঙ্গবন্ধুর অনাড়ম্বর কবর জিয়ারত করি। অশ্রুতে ভরে উঠে চক্ষু। মনে হয় মহাবীর আলেকজান্ডার বলছে ‘সেলুকাস বিচিত্র এই দেশ’। মনে পড়ে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার মৃত্যুর সময়ের শেষ কথাটি ‘হায়রে অভাগা দেশ’।
‘মিছিলের পুরো ভাগে ছিলে
পথের ইশারা রেখে,
তুমি গেছ চলি।
আজও হাঁটি সেই পথ ধরে,
তোমার ভাষায় তাই
আজও কথা বলি’
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
মুন্সী আব্দুর রহমান (অ্যাডভোকেট) : সাবেক ভিপি, এসএম হল ও আহ্বায়ক ছাত্রলীগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭২। বীর মুক্তিযোদ্ধা, দেরাদুন মিলিটারি একাডেমি হতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।