প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২১, ১৪:১৮
দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম জাতি গঠনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসামান্য অবদান
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) জোরদার এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম জাতি গঠনে ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করেছেন।
ঘূণিঝড়, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীবন ও সম্পদহানি কমিয়ে আনার মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবেলায় দেশকে সক্ষম করে তুলতে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
সরকারি নথি থেকে দেখা যায় যে, প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’ (সিপিপি) গঠন করা বঙ্গবন্ধুর একটি সাহসী উদ্যোগ ছিল। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের আর্থিক সঙ্কটের প্রাক্কালে স্বাধীন বাংলাদেশের মাত্র এক বছর ছয় মাস বয়স অতিক্রমকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে 'ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি' (সিপিপি)’র কার্যক্রম অক্ষুণ্ন রেখে অর্থনৈতিক বাধা কাটিয়ে উঠতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখেন।
১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের আকার ছিল ৯৯৫ কোটি টাকা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এর মধ্যে ১৯৭৪ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের পুনর্বাসনের জন্য ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় । দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যেভাবে অগ্রাধিকার দিয়েছেন, সেটি ছিল ঐতিহাসিক এবং সাহসী পদক্ষেপ।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়ঙ্কর ঘূণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে এবং বিপুল সম্পদ বিনষ্ট হয়। ঘূণিঝড় এক ঘন্টারও কম সময় স্থায়ী হয়েছিল তবে এতে লাখ লাখ লোক গৃহহীন হয়ে পড়ে। বাঙালি জাতির জন্য এটি ছিল এক মর্মান্তিক ইতিহাস। এই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে জীবন ও সম্পদহানিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুবই বেদনাহত হয়েছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের শাসকদের ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের সিডিউল বদলাতে চাপ প্রয়োগে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। পরে এই নির্বাচন ১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা চালান। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি বিশেষ করে দেশের উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি, লাখ লাখ ঘরবাড়ি ও সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয়স্থল গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। আগে ও পরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বিভিন্ন মাত্রার শতাধিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। এর মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি ঘূর্ণিঝড় ছিল ভয়ঙ্কর শক্তিশালী, যাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি, লাখ লাখ বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত এবং লাখ লাখ একর জমির শষ্য বিনষ্ট হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬২, ১৯৬৩ এবং ১৯৬৫ সালে তিনটি ঘূর্ণিঝড়ে এক লাখের বেশি লোকের মৃত্যু হয়েছে।
এই তিনটি ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে ১৯৬৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক সিদ্ধান্তে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা দিতে লীগ অব রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে (এলওআরসিএস) নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এবং ধ্বংসযজ্ঞ দেখে বঙ্গবন্ধুর হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল এবং তিনি উপকূলীয় এলাকার এই ভয়াবহতার কথা কখনো ভুলে যাননি। তাই লীগ অব রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং বাংলাদেশ রেড ক্রসের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু ঘূণিঝড় প্রস্তুত কর্মসূচি (সিপিপি) গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। সিপিপি শুরু করার সাথে সাথে একটি কার্যকর ও টেকসই কর্মসূচি গ্রহণে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরির উপায় বের করতে একটি সমীক্ষা চালান। এই সমীক্ষায় একটি কমিউনিটিভিত্তিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম তৈরির প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়। এই কার্যক্রমে তরুণ-যুব শক্তি হবে চালিকা শক্তি। রহমান ঘূণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)’র জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আর্থিক সহযোগিতার অঙ্গীকার ২০,৪৩০ জন স্বেচ্ছাসেবককে মানবিক সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করে।
১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার চর হেয়ারে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবকের উপস্থিতিতে তৎকালীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত মাননীয় মন্ত্রী এবং স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী জনাব মতিউর রহমান বাংলাদেশ রেড ক্রস সোসাইটির চেয়ারম্যান গাজী গোলাম মোস্তফা,এমপি এর উপস্থিতিতে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। এক বছরান্তে লীগ অব রেডক্রস এন্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ ৩০ জুন ১৯৭৩ সালে মাঠ পর্যায়ে কর্মসূচি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাংলাদেশ সরকারকে এর দায়িত্বভার গ্রহণের অনুরোধ জানান।
জাতিসংঘের সহযোগিতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মাটির দুর্গ তৈরি করেন, যা স্থানীয়ভাবে ‘মুজিবকিল্লা’ হিসেবে পরিচিত। এই দুর্যোগকালে লোকজনের আশ্রয় নেয়ার পাশাপাশি তাদের গবাদিপশু নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার লক্ষ্যে এই মাটির কিল্লা তৈরি করা হয়।
তিনি নিবেদিতপ্রাণ প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক গঠনে নির্দেশনা প্রদান করেন। বাংলাদেশের উপকূলীয় জনসাধারণকে দুর্যোগে দ্রুত সাড়া প্রদানের জন্য বেতার যোগাযোগের মাধ্যমে সঠিক সংবাদ পৌঁছে দেয়া, ঘূর্ণিঝড়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হ্রাস/কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। ১৯৯১-২০২০ সাল পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে গিয়ে দায়িত্ব পালনকালে সিপিপি’র ২৭ জন স্বেচ্ছাসেবক প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সিপিপি’র ৭৬ হাজার নিবেদিতপ্রাণ স্বেচ্ছাসেবকদের নিঃস্বার্থ সেবাদান করছে। এর ফলে সমগ্র বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণকারী প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়সমূহ যথাক্রমে ২০০৭ সালে আঘাত হানা সিডর, ২০০৯ সালের আইলা, ২০১৬ সালে রোয়ানু, ২০১৭ সালে মোরা, ২০১৮ সালে তিতলী, ২০১৯ সালে ফণী ও বুলবুল এবং ২০২০ সালে আম্পানে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে জীবনহানীর লক্ষের অংক এখন একক অংকে নেমে এসেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর এই পথিকৃতের ভূমিকা পালনের কারণে বাংলাদেশ আজ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রে রোল মডেল হিসেবে বিশ্বের স্বীকৃতি পেয়েছে।
জাতির পিতার নির্দেশিত পথে দক্ষ জনবল ও স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে দুর্যোগে পূর্ব প্রস্তুতির কারণে জীবন-সম্পদ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষায় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করতে বিশেষ অবদান রাখছে। ফলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর “সোনার বাংলা”, দেশরত্ন মানবতার জননী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’,২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশের মর্যাদা লাভ করবে। এজন্য সকলকে জাতির পিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সততা, আত্মবিশ্বাস, আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে দেশ এবং জাতির কল্যাণে নিজেকে নিয়োগ করতে হবে।
লেখক: মোঃ নূর ইসলাম খান অসি
পরিচালক (অপারেশন) - ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি)
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ।