প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস ও নিত্যসঙ্গী বই
‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে কিন্তু বইখানা অনন্ত যৌবনা- যদি তেমন বই হয়’। উক্তিটি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বইকেনা’ প্রবন্ধ থেকে নেয়া। বইপড়া বা বই কেনাবেচায় উৎসাহিত করার জন্যে এর চেয়ে ভালো বিজ্ঞাপন আর হয় না। তাই বোধহয় বই প্রসঙ্গে এই উক্তিটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। আরও শত শত মহান উক্তি আছে বই নিয়ে। সাধারণত ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে পাঠ্যবই (সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত) অধ্যয়ন করা বেশি প্রয়োজন। মানুষের জীবনে তাদের ছাত্রজীবন এক তৃতীয়াংশ বা দুই তৃতীয়াংশ সময় জড়িত। আবার অনেকের কাছে সারাজীবনই ছাত্রজীবন।
জ্ঞান অর্জনের জন্যে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই অধ্যয়ন করা জরুরি। ছাত্রজীবন থেকেই বই পাঠের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে এটা একসময় মহৎ নেশায় পরিণত হয়। পাঠ্যবই সাধারণত সার্টিফিকেট তথা সনদনির্ভর। অন্যান্য বই ডিগ্রিবিহীন হলেও সারাজীবন চলার পথের পাথেয়।
আজ ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষার মাস হিসেবেই পরিচিত। ১৯৫৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় গ্রন্থাগারের ভিত্তিপ্রস্তর করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদের সিদ্ধান্তে ৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ২০১৮ সালে থেকেই দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হয়ে আসছে। সকল বয়সী পাঠকদের বইপড়ার প্রতি উদ্দীপ্ত করাই এই দিবসের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
লাইব্রেরির প্রতিশব্দ গ্রন্থাগার। গ্রন্থ মানে বই, আগার অর্থ স্থান বা গৃহ। সুতরাং বই রাখার জন্যে গৃহকে গ্রন্থাগার বলে। মানবজীবনে সভ্যতার বিকাশে লাইব্রেরির ভূমিকা অপরিসীম। সাধারণত চার ধরনের লাইব্রেরি আমাদের চোখে পড়ে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, একাডেমিক লাইব্রেরি এবং বিশেষ লাইব্রেরি। বইপ্রেমিদের জন্যে লাইব্রেরি হচ্ছে শান্ত অভয়ারণ্য, যেখানে শব্দগুলো জীবন্ত, সীমাহীন জ্ঞানের ভাণ্ডার, জ্ঞানের পাঠাশালা বা শ্রেণিকক্ষ, মানবজাতির ডায়েরি, সাফল্য গড়ার মন্ত্র, মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতার প্রয়োজনীয় উপাদান ইত্যাদি। লাইব্রেরিতে থাকে অতীতের মূল্যবান সম্পদ, তথ্যস্মৃতি বা জীবন্ত উপাদান, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে ব্যবহারের উপযোগী। গ্রন্থপাঠে অনাবিল আনন্দ আছে, বিনোদন আছে, মজা আছে, নিখুঁত ভালোবাসা জড়িয়ে আছে। আবার আছে সহস্র মনোভাবনা। পাঠের আনন্দ পাঠককে নিয়ে যায় জ্ঞানের রাজ্যে, বিচরণ করায় বিশ্বসাহিত্যের পাতায় পাতায়। মানুষ সাধারণত মৃত্যুর পরেও বাঁচতে চায়, অমরত্ব চায়, কিছু একটা লিখতে চায়। বইয়ের সাথে নিত্য কথা বলে বিনোদন চায়। তাঁর অমর আত্মাকে মরতে দিতে চায় না। অর্জন করতে চায় বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, ধর্মনীতি, সমাজনীতি প্রভৃতি সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য। খুলতে চায় মনের ভুবন ও স্বপ্নের আকাশ। যতো জ্ঞানী-গুণী তাঁদের পদচারণায় পৃথিবীকে ধন্য করেছেন, তাঁরা সকলেই ছিলেন বই পাঠে নিমগ্ন, বইপাঠের আনন্দে বিভোর। তাই তো তাঁদের অবস্থান জ্ঞান ও গরিমার চূড়ায়, মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার।
আমাদের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে রয়েছে বিশাল সোনালি ইতিহাস। সাহিত্য হচ্ছে মহাকালের সিঁড়ি। গুটিকয়েক কবি-সাহিত্যিক এক পক্ষ নিয়ে লিখেছেন, অন্য পক্ষকে কটাক্ষ করেছেন। আবার কেউ কেউ তাদের পক্ষে সেগুলোর উত্তর লিখে যুক্তিখণ্ডন করেছেন। সাহিত্য রচনা শক্ত কাজ হলেও অসম্ভব নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি-মেধামন ও সৃজনশীলতার বাতিঘর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র। ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের হাতের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা হয়।
অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং একজন সুবক্তা হিসেবে দেশে ও বিদেশে পরিচিত। জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে মানবিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ গড়ার লক্ষ্যে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ স্লোগানে ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির প্রতিটি জেলায় পথচলা শুরু হয়। এই প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে রাষ্ট্র ও সমাজের আলোকবর্তিকা হয়ে এখন দেশের সর্বত্র কাজ করছে। নিচ্ছে নিত্যনতুন উদ্যোগ।
‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’ স্লোগানে বইপড়া কর্মসূচির সঙ্গে বর্তমানে প্রায় ২৫ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী সম্পৃক্ত। ফেসবুকের কিছুটা কুপ্রভাব এবং কুপাঠ্য বইয়ে আজকাল বিশ্ববাজার ছেয়ে গেছে। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন বই ও দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরির পাঠকসংখ্যা বৃদ্ধি একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবাইকে একসাথে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে, নচেৎ ফলাফল জিরোতে পরিণত হবে। মহাকালের ¯্রােতে ধ্বংস বা মৃত্যুর পানে যাওয়ার আগেই ক্ষণস্থায়ী নশ্বর এ মানবজীবনকে বইমুখি করতে হবে। বাংলা ভাষা এবং বিশ্বসাহিত্যের মূল্যবান বইগুলোকে একই সাথে ডিজিটালাইজ্ড করে নতুন প্রজন্মকে ট্যাবে বা ল্যাপটপে পড়াশোনার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বইপড়ার সামাজিক আন্দোলন যদি অব্যাহত না থাকে তাহলে দেশ ও সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বই মানুষকে নরকের প্রজ্জ্বলিত আগুনের মাঝে ফুলের হাসি ফোটাক- এ ইতিবাচক মনোভাব সবার কাছেই কামনা করি।
মোঃ কায়ছার আলী : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।