প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
জিরো টলারেন্স
নিত্যদিনের ন্যায় গত ১৬ জানুয়ারি ২০২৪ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকাখানা হাতে পাওয়ার অব্যবহিত পরেই সোল্লাসে পত্রিকার সব ক’টি পাতা হালকাভাবে চোখ বুলাতে শুরু করলাম। হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হলো, বাংলাদেশ সরকারের নতুন মন্ত্রিসভার দুটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত। একটি হলো : চলমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, অপরটি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কঠোর হওয়া। প্রথমোক্তটির মর্মার্থ বোধহয় প্রচলিত আইনসিদ্ধ, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগও অপরাধীকে দেয়া হবে না। এতো এদেশে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলোর ক্ষেত্রে যৎপরনাস্তি প্রযোজ্য। কিন্তু এদেশে প্রচলিত আইনের যুক্তি-তর্কে অথবা অজ্ঞাত কোনো কৌশলে অনিবার্য মানবতা বিরোধীরা ছাড়া পেয়ে যায়। তাতে অপরাধপ্রবণতায় অসম ত্বরণ সৃষ্টি হয়ে যায়। ফলে সামাজিক অস্থিরতায় মানুষ দিশেহারা এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। একদা ভৌগোলিকভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-ত্রিপুরা-আসামণ্ডমেঘালয় নিয়ে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম ব-দ্বীপ নদীমাতৃক এই বাংলাদেশ। ঐতিহাসিকভাবে অনেক ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিলো এবং বহু বিদেশি শাসক এদেশ শাসন করেছে। এই বাংলা দেখেছে অনেক বর্গি শঙ্কর শাসক এবং শোষক। মানব অবয়বে এ দেশের মানুষগুলোকে চেনা অত্যন্ত দুরূহ কাজ। কারণ অতিসামান্য স্বার্থের কারণে এদেশের পরশ্রীকাতর মানুষগুলো চোখের পলকে কায়া পরিবর্তন করতে পারে। বহু চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে একমাত্র শেখ হাসিনাই দেশের মসনদে আসীন আছেন অনেক দিন। বাংলার সাতশ’ বছরের ইতিহাসে যারা দীর্ঘসময় ক্ষমতায় ছিলেন তাঁদের মধ্যে শেখ হাসিনা অন্যতম। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার কিছু বুঝে উঠার আগেই মাত্র এক বছরের মাথায় আপনজনদের কুৎসিত ষড়যন্ত্রের কাছে পরাস্ত হওয়ায় দীর্ঘ সময়ের জন্যে বাংলাকে পরাধীনতা বরণ করতে হয়। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব শায়েস্তা খানকে দিল্লী থেকে বাংলায় সুবেদার হিসেবে (প্রাদেশিক শাসক) নিয়োগ করেছিলেন। তিনি দুই দফায় ১৬৬৩-১৬৭৮ এবং ১৬৮০-১৬৮৮ এ ২৩ বছর বাংলা শাসন করেছিলেন। তাঁর সময় টাকায় আট মণ চাল বিক্রি হতো। তবে চৌদ্দ ও ষোল শতাব্দীতে কোনো কোনো শাসক ২০ থেকে ২৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। খালেদা জিয়া দুই মেয়াদে দশ বছর ছিলেন বাংলার মসনদে। প্রেসিডেন্ট এরশাদ ছিলেন টানা আট বছর। দলীয় বিভেদ এবং সরকারের সিদ্ধান্তহীনতা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে। বাংলার আদি নৈতিকতাণ্ডআতিথেয়তাণ্ডমনুষ্যত্ববোধের বিসর্জন ঘটায়ে আজ বাংলার দূষিত জলবায়ুতে জন্মেছে পরশ্রীকাতরতাণ্ডনিকৃষ্ট পশুত্ববোধ-অযোগ্য ব্যক্তির ক্ষমতায় আরোহনের লড়াই আর বিষকুম্ভ পযঃমুখম চরিত্র। এক সময় এ দেশের মানুষ স্থানীয় সরকার এবং প্রকৃত অর্থেই আদর্শবান লোকদেরকে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে ক্ষমতাবান করতো। কিন্তু আজকাল ক্ষমতার চেয়ার মানে অর্থশালী হওয়ার জাদুর কাঠি বলেই জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছা পরোক্ষ ব্যাপার।
অপরিকল্পিত উন্নয়নে আজ এদেশে পয়ঃনিষ্কাশন বা বর্ষার আগমন হচ্ছে না। এতে পলির আগমন না হওয়ায় নদীগুলোতে নাব্যতা বিলীন হওয়ার উপক্রম। সার্বিক বাংলায় শস্য-শ্যামল মনোরঞ্জন দৃশ্যগুলোও বিলুপ্তির পথে। বর্ষার পলিমাটির কাজ এখন কৃত্রিমভাবে জোগান দেয়া হচ্ছে। এতে প্রাচীন বাংলা অর্ধকায়া বিশিষ্ট বাংলা হয়ে আছে। এর আশু সংস্কার অত্যন্ত অপরিহার্য। এ যেনো দেখার কেউ নেই।
ইতিহাসের অপরিহার্যতার প্রবহমানতা কোনো ক্রমেই ঠেকানো যায় না। যেমন ১৭৫৭ সালের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সম্রাট বাবর কর্তৃক দিল্লীতে মোঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের পর সম্রাট হুমায়ুন এবং সম্রাট আকবর দ্যা গ্রেট পর্যন্ত যে অকুতোভয় বিচক্ষণ সৈনিক কখনো সাধারণ সৈনিক, কখনো বা প্রধান সেনাপতি এবং কখনো বিপদের বন্ধু হিসেবে বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে ছিলেন তিনি ‘বৈরাম খাঁ।’ সে বৈরাম খাঁ সম্রাট কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে এক সময় হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে মক্কার পথে রওনা হন এবং গুজরাটের কাছে অজ্ঞাত গুপ্ত ঘাতকের হাতে নৃসংশভাবে নিহত হন। এ কিন্তু বিধিলিপি নাকি ইতিহাসের প্রবহমানতা তা পাঠকের বিবেচ্য বিষয়।
দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি স্বয়ংক্রিয়তার ওপর নির্ভরশীল। কারণ যে দেশের দুই-তৃতীয়াংশ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী এবং মন্ত্রিপরিষদের সক্রিয় উপাদান সে দেশের পৃথক দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কমিটি নিশ্চয়ই হাস্যকর। সারা দুনিয়ায় ‘বড়দিন’সহ সকল উৎসবে জিনিসপত্রের দাম কমে আমাদের দেশে এর সম্পূর্ণ বিপরীত।
দেশের উদীয়মান তরুণ সমাজ হলো ভবিষ্যৎ কর্ণধার। আজ সেই তরুণ সমাজ মাদকাসক্ত হয়ে উজ্জ্বল তারুণ্যকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটা কিন্তু ক্ষমতায় আসার পূর্ব প্রতিশ্রুতি এবং বর্তমান ঘটমান অবস্থার মধ্যে চরম সাংঘর্ষিক। অজ্ঞাত পৃষ্ঠপোষকতাই এসব অপকর্মের অনুঘটক। মাননীয় সাংসদ নিয়েই সংসদ। এর জনহিতকর কর্মকাণ্ড যুগযুগান্তর স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে। তবেই কবির কণ্ঠে কণ্ঠ মিলায়ে বলা যাবে :
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, /সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভূমি ॥’
বিমল কান্তি দাশ : কবি ও প্রবন্ধকার; অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক, বলাখাল যোগেন্দ্র নারায়ণ উচ্চ বিদ্যালয় ও কারিগরি কলেজ, বলাখাল, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।