প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৫, ০৮:৫৫
বাবা

বাবা আমার জীবনের প্রথম নায়ক, ছায়ার মতো থাকা সেই মানুষটি, যিনি নিঃশব্দে তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন সবসময়ই। কখনো কঠোর, কখনো কোমল, কিন্তু তাঁর প্রতিটি আচরণের ভেতরে ছিলো ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ।
অনেক ছোট থেকেই শুরু করছি। চার বছর বয়সে আমার পড়াশোনার প্রয়োজনে শাহরাস্তি থেকে চাঁদপুরে সপরিবারে পাড়ি জমাই। কিন্তু আমার বাবার ব্যবসা এবং রাজনীতি সবকিছুই ছিলো শাহরাস্তিকেন্দ্রিক।
ব্যবসা, ঠিকাদারি এবং রাজনীতির এই বিশাল ব্যস্ততার মাঝেও তিনি প্রায়শই সময় বের করে শাহরাস্তি থেকে চাঁদপুর আগে চলে যেতেন এবং বিকেলে আমাকে নিয়ে বড় স্টেশন মোলহেডে ঘুরিয়ে আনতেন। বাদাম চিবুতে চিবুতে গল্প এবং কথার ছলে আমাকে নৈতিকভাবে গড়ে তুলবার সুকৌশলটি তিনি অবলম্বন করেছিলেন।
মাত্র চার বছর বয়সে চাঁদপুর চলে আসায় তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসাটা আগে সেভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ হয় নি।
করোনা মহামারীতে দেশব্যাপী লকডাউন দিলে গ্রামে এসে দীর্ঘ সময় অবস্থানকালে মানুষের তাঁর প্রতি ভালোবাসা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করতে পারি।
অবশেষে তাঁর মৃত্যুর পর গ্রামে এসে ব্যবসার হাল ধরলে আস্তে আস্তে বুঝতে পারি, কতোটা শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা মানুষের কাছে পেয়েছেন তিনি।
আমি যেখানেই গিয়েছি, মানুষ যখন শুনেছে দেলোয়ার হোসেন মিয়াজীর সন্তান, তখন অসংখ্য অগণিত লোকের মুখে যে কথাটি আমার বার বার শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, সেটি হচ্ছে--আপনার বাবা একজন ভালো মানুষ ছিলেন। যেটা ব্যক্তি হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড়ো অর্জন, আর সন্তান হিসেবে আমার সৌভাগ্য আমি মনে করি।
অত্যন্ত পরিশ্রমী ছিলেন তিনি। সকাল সাড়ে ৭টায় আমার কেজি স্কুলে ক্লাস শুরু হতো। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে আমি খুব কমই বাবাকে বাসায় পেয়েছি। আম্মুকে একদিন জিজ্ঞেস করলে বলেন, তোমার বাবাতো সেই সাড়ে ৫টায় শাহরাস্তির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন।
আমাদের প্রতিষ্ঠানের পুরাতন একজন শ্রমিক আমাকে একদিন বলেছিলেন, প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও তিনি কর্মচারীদের আগে এসে উপস্থিত হতেন এবং তাঁর আগে আমরা কখনো কাজে এসে উপস্থিত হতে পারি নি।
আমার দেখা কয়েকটি ঘটনার মধ্যে দুটি, যেগুলো আমার চিন্তা চেতনাকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছে, সেটি শেয়ার করে আজকের মতো শেষ করছি।
প্রথমটি হচ্ছে : যে কোনো একটি নির্বাচনে যেখানে শুধুমাত্র জনপ্রতিনিধিরা ভোট দিয়ে থাকেন, সেই নির্বাচনের একজন প্রার্থী রাতের বেলা আমাদের চাঁদপুরের বাসায় আসেন এবং তাঁর নির্বাচন করার জন্যে আমার বাবাকে বড়ো অঙ্কের টাকার প্যাকেট দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি তাকে সেই টাকার প্যাকেট ফিরিয়ে দেন এবং সহজ সাবলীল ভাষায় বলেন, ভাই আমাকে টাকা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে ভোট দিতে পারবো না ঠিকই, কিন্তু কথা দিলাম কোথাও আপনার একটি ভোটও নষ্ট করবো না। এর বিনিময়ে আমার টাকার কোনো প্রয়োজন নেই।
ওই প্রার্থী চলে যাওয়ার পর আমাকে হাসতে হাসতে বলেন, আমাকে টাকা দিয়ে কিনতে আসছে। এতো টাকা মানুষের কী কাজে লাগে!!
পরদিন ওই ব্যক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী একই ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আসলে একইভাবে তাকেও প্রত্যাখ্যান করেন এবং পরামর্শ দেন অহেতুক টাকা নষ্ট না করার জন্যে।
দ্বিতীয় ঘটনা : করোনাতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকায় আমি গ্রামে এসে আমাদের প্রতিষ্ঠানে সময় দেওয়া শুরু করি। তখন ক’জন শ্রমিকের মধ্যে একজনকে দেখলাম খুবই দুর্বল কাজের ক্ষেত্রে। তিনি অন্যদের তুলনায় অনেক ধীরে কাজ করেন এবং বয়স্কও বটে। পরে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, আমার বাবাই তাকে কাজে রাখতে বলেছেন এবং তিনি অনেক দূর থেকে এসে কাজে যোগ দেন। সেই ভাড়াও আমার প্রতিষ্ঠান বহন করছিলো।
তখন আমি সন্ধ্যায় আমার আব্বুকে গিয়ে বললাম, এই লোককে কেন কাজে রাখছো?ওনার চেয়ে অনেক শক্ত, এফিশিয়েন্ট লোকতো কাজ করতে আগ্রহী।আর তিনি কাজের বেলায় একদমই দুর্বল।বয়স্ক মানুষ, বেশি প্রেশারও দেওয়া যায় না।
আব্বু আমাকে বললেন, এ রকম কিছু মানুষকে চালিয়ে নেওয়া লাগে।বয়স হলে যদি সবাই একটা মানুষকে ছেড়ে দেয়, তাহলে সে চলবে কীভাবে!! ওনার বাড়ি আমাদের বাসার পাশেই।আগে আমাদের কাজ করতেন। আমাদের প্রতিষ্ঠান স্থান পরিবর্তন করে দূরে চলে যাওয়াতে তিনি অন্য প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কাজ করতেন। কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়াতে এখন কেউ কাজে নেয় না। ওকে এভাবেই চালিয়ে নিতে হবে।
ঘটনা দুটি আমাকে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছে।
বাবা আমার জীবনের অভিভাবক, পথপ্রদর্শক ও আশ্রয়। জীবনের প্রতিটি কঠিন মুহূর্তে তাঁর উপদেশ, সাহস আর অভিজ্ঞতা আমায় পথ দেখায়।
লেখক পরিচিতি : মরহুম দেলোয়ার হোসেন মিয়াজীর একমাত্র ছেলে।