বুধবার, ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২২ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়
মোঃ রাশেদুল ইসলাম

জাতির মেরুদণ্ডস্বরূপ শিক্ষার ভিত্তিপ্রস্তর যেখানে রচিত হয়, যে কারখানায় তৈরি হয় তার নাম ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়’। একটি শিশু ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায়-নীতিবান, আদর্শবান, চরিত্রবান হবে কিংবা দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তাঁর প্রাথমিক জীবনের শিক্ষার উপর। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কী করা উচিত, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, সমাজ এবং শিক্ষকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সমস্যা এবং তা উত্তরণে কিই-বা করণীয় সেসব বিষয় নিয়ে আলোকপাত করাই এই লেখাটির মুখ্য উদ্দেশ্য।

আমরা জানি, এক দশক আগেও বাংলাদেশে স্কুলগামী ছাত্র-ছাত্রীর হার ছিলো খুব কম এবং মেয়েদের হার ছিলো আরও কম। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ যেমন- সময়মতো বই বিতরণ, বিনা বেতনে শিক্ষা, ফ্রি টিফিনের ব্যবস্থা, বাল্যবিবাহ রোধ প্রভৃতি কারণে স্কুলগামী ছেলেমেয়ের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি শিক্ষার হারও প্রতি বছর বেড়েই চলেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষার হার বাড়লেই কি আদর্শবান জাতি হওয়া যায়? আমরা একজন শিক্ষিত মানুষের কাছে যে ধরনের ব্যবহার আশা করি, যে ধরনের সেবা প্রত্যাশা করি তা কি বাংলাদেশে সর্বক্ষেত্রে সবসময় পাই? কীভাবে একজন সেবাপ্রত্যাশী অপরিচিত মানুষকে সম্বোধন করতে হয়--তা কি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা শিখিয়েছে? তাকে কি শিখিয়েছে যে সে যখন বড় হয়ে সরকারি চাকরি নিয়ে অফিসে যাবে তখন জনগণের মালিক নয়, সেবক হিসেবে ভাবতে হবে এবং সেবা দিতে হবে? আমার মনে হয়, এসব প্রশ্নের অধিকাংশেরই জবাব হবে ‘না-বোধক’। তাহলে এই প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা দিয়ে আমরা কি আদর্শ বিনয়ী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করতে পারবো--আমার মনে হয় এটি দায়িত্বশীল সবাইকে গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত।

অন্যান্য দেশে নার্সারি স্কুলে প্রথম ছয় বছর অষঢ়যধনবঃ আর কিছু সংখ্যাগত ধারণা ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের তেমন কিছুই পড়ানো হয় না, এমনকি নির্ধারিত সিলেবাস বা কোনো পাঠ্যবই নিয়েও স্কুল যেতে হয় না। সেখানে শিক্ষকরা বাবা-মায়ের স্নেহ-মমতা দিয়ে যা শেখান তা হলো আদর্শ-নীতি নৈতিকতা, সততা এবং দায়িত্ব বোধ। উদাহরণস্বরূপ- কীভাবে খেতে হয়, খাওয়ার আগে ও পরে কী বলতে হয়, বন্ধুর সাথে, শিক্ষকের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয়, রাস্তা পারাপারে কী করণীয়, ফোনে কীভাবে কথা বলতে হয়, মানুষের বিপদে কীভাবে সাহায্য করতে হয়, পশু-পাখি, ফুল ও গাছপালার সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয়, বাস, ট্রেনে চলাচলের সময় কীভাবে থাকতে হয়, এসব বিষয়ে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয়ভাবে শিক্ষা দেয়া হয়। এই বিষয়গুলো বলতে বলতে শিশুদের মনমগজে এমনভাবে গেঁথে দেয়া হয় যে, বড় হয়ে তারা একদিকে যেমন বিনয়ী হয়, অন্যদিকে তারা হয়ে উঠে নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন আদর্শ মানুষ।

অন্য দেশের সাথে আমাদের মৌলিক পার্থক্য হলো আমরা শুরুতেই বাচ্চাদের ঘাড়ে এক বোঝা বইয়ের ব্যাগ চাপিয়ে ভালো রেজাল্টের জন্যে শিক্ষক-অভিভাবক সবাই ছোটাছুটি করি। ফলে ভালো রেজাল্টধারী অনেক ছাত্র/ছাত্রী পাওয়া গেলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন ভালো মানুষের বড়ই অভাব। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় এই অবস্থার পেছনে যেসব কারণ দায়ী তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হলো।

নৈতিক শিক্ষার অভাব

প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের সিলেবাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, সেখানে নৈতিক শিক্ষা বা নীতি কথার চেয়ে তাত্ত্বিক কথা অনেক বেশি, যা বাচ্চারা মুখস্থ করে পরীক্ষায় পাসের জন্যে। আবার পরক্ষণে তা ভুলেও যায়। আচরণগত শিক্ষা দেয়া হয় খুবই কম, এমনকি প্রতিদিন লাইনে দাঁড় করিয়ে যে শপথবাক্য পাঠ করানো হয় তার অর্থ হৃদয় দিয়ে কতজন ছাত্র-ছাত্রী অনুভব করে তা নিয়ে অনেকেরই প্রশ্ন রয়েছে।

মানসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব

বলতে দ্বিধা নেই, যারা মানুষ গড়ার কারিগর, তাদের অনেকেরই নৈতিক মান নিয়ে অনেক খবর পত্র-পত্রিকায় দেখা যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখানোর মহান দায়িত্ব যাদের তারা শিক্ষকতা নামক মহান পেশাটিকে নেহায়েতই আয়-রোজগারের একটি উপায় হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বা নিয়েছেন। এ অবস্থায় থেকে বের হওয়া খুবই জরুরি।

শিক্ষকের অপ্রতুলতা

বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকের যে অনুপাত তা মানসম্মত শিক্ষার জন্যে মোটেও উপযোগী নয়। প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, এ অনুপাত ১:৫৩। এই অনুপাত কমিয়ে ১:২৫-এ আনা উচিত। অন্যথায় শিক্ষার আদর্শিক গুণগত মানে পৌঁছানো কখনোই সম্ভব হবে না।

শিক্ষার পরিবেশের অভাব

আদর্শবান জাতি গঠনের লক্ষ্যে সুস্থ মেধা বিকাশ উপযোগী যে ধরনের শ্রেণিকক্ষ দরকার তা অনেক বিদ্যালয়েই অনুপস্থিত। সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক বিদ্যালয়ে বসার বেঞ্চ নেই, টয়লেট নেই, খেলার সামগ্রী নেই। যা প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে অত্যন্ত জরুরি।

দারিদ্র্য

বাংলাদেশে এখনও অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। এসব পরিবারের মা-বাবারা মনে করেন তার সন্তান স্কুলে গিয়ে যে বৃত্তি পাবেন তার চেয়ে অনেক বেশি আয় করতে পারবে বাসাবাড়ি বা বাইরে অন্য কোথাও কাজ করে। ফলে তারা তাদের সন্তানদের বিদ্যালয়ের চেয়ে জীবন-জীবিকার কাজে নিয়োজিত করতেই বেশি পছন্দ করে। শিক্ষার সুদূরপ্রসারী ফলাফল সম্পর্কে তাদের ধারণাও একবারেই কম।

ব্যবস্থাপনা কমিটির দুর্বলতা

বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির অন্যতম দায়িত্ব হলো শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করা। অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এসএমসির অনেক সদস্যই শিক্ষার গুরুত্ব বা গুণগত মান বৃদ্ধির বিষয়ে মোটেও সচেতন নয়। অনেকেই এসএমসির সদস্য হওয়াকে বা সভাপতি হওয়ার বিষয়টিকে সম্মান বৃদ্ধির/ক্ষমতাণ্ডআধিপত্য বৃদ্ধির/আয়-রোজগার বৃদ্ধির উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক মতাদর্শকে বিবেচনায় না এনে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদানকে বিবেচনা করার জন্যে বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

অভিভাবকদের অসচেতনতা

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ যেহেতু গ্রামে বসবাস করে এবং তারা কৃষি কাজে জড়িত, স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাদের মতো কৃষক বানাতে চায়। তাদের অনেকের ধারণা, পড়ালেখা করে গরিব মানুষের সন্তানদের চাকরি পাওয়া কঠিন। তাছাড়া শিক্ষার গুরুত্ব বা সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে চিন্তা করার মতো কল্পনাশক্তিও তাদের নেই।

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে করণীয়

প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে যে বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত সেগুলো সংক্ষেপে নিচে তুলে ধরা হলো :

ক) শুধু সিলেবাসভুক্ত পড়াশোনা না করিয়ে আদর্শভিত্তিক নীতি-নৈতিকতাসম্পন্ন মানসিকতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে।

খ) চার বছর বয়সে স্কুলে গমন বাধ্যতামূলক করে ছয় বছর বয়স পর্যন্ত শুধু নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। ৬ বছর প্লাস হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদান শুরু করতে হবে।

গ) শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধাবী, চরিত্রবান ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে হবে।

ঘ) শিক্ষকদের পৃথক বেতন কাঠামো করে তাদের মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করতে হবে।

ঙ) ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত কমিয়ে আনতে হবে।

চ) শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবকদের আরও বেশি সচেতন করতে হবে।

ছ) প্রত্যেকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাসে অন্তত ১ দিন একজন সফল ব্যক্তিত্বকে দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভবিষ্যৎ তৈরির জন্যে স্বপ্ন দেখাতে হবে এবং জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।

জ) সর্বোপরি, সুস্থ মেধা বিকাশে শিক্ষার পরিবেশ তৈরির জন্যে যা যা প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যে তা নিশ্চিত করতে হবে।

উপর্যুক্ত সমস্যাগুলো সমাধানের পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন, মানসম্মত ও যুগোপযোগী করতে হলে এর বিকেন্দ্রীকরণ এবং সচেতন জনগণের অংশ নেয়া অত্যন্ত জরুরি। এজন্য এলাকাভিত্তিক তথা উপজেলা পর্যায়ে পরিকল্পনা করে এগোতে হবে। স্কুল পরিচালনায় তৃণমূলের জনগণকে নিয়ে আসতে হবে ওয়াচডগের ভূমিকায়। ব্যবস্থাপনা কমিটি ও অভিভাবক পরিষদের সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সেটা স্থানীয়দের জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটি, অভিভাবক কমিটি এবং ইউনিয়ন পরিষদের স্থায়ী কমিটির মধ্যে সমন্বয়ের ওপরও জোর দিতে হবে।

পরিশেষে আশাবাদ ব্যক্ত করতে চাই যে, বিনয়ী, সৎ ও যোগ্যতাসম্পন্ন একটি জাতি গঠনের জন্যে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো অবশ্যই একদিন দূর হবে এবং যে স্বপ্ন সাধ নিয়ে এই জাতির পথচলা শুরু হয়েছিলো তা অচিরেই পূর্ণ হবে। আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ এবং সেবাধর্মী একটি জাতি গঠনে সবাই কাজ করবো- এই প্রত্যাশা রইলো সংশ্লিষ্ট সবার কাছে।

মোঃ রাশেদুল ইসলাম : উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, হাজীগঞ্জ, চাঁদপুর।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়