প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

আজ ২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বীর বিক্রম শহীদ নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজীর ৫৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনাদের অতর্কিত আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে মরণপণ লড়াই করে শহীদ হন বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজী। এ বীর শহীদ স্মরণে এই দিবসটি কখনো পালিত হয়নি। তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্যে আজও গড়ে উঠেনি কোনো স্মৃতি সংসদ। ১৯৯৫ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার (অবঃ) আবদুর রবকে (বর্তমানে প্রয়াত) সভাপতি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা বাসুদেব মজুমদারকে সাধারণ সম্পাদক করে ২১ সদস্যবিশষ্টি একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ পরিষদের সহযোগিতায় বাসুদেব মজুমদার কর্তৃক নির্মিত বীর বিক্রম শহীদ নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজীর নেতৃত্বে বাখরপুরের যুদ্ধের একটি প্রামাণ্যচিত্র মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার শোভা পেয়েছিল। ‘মুক্তিযুদ্ধে চাঁদপুর’ শিরোনামে সরদার আবুল বাসার রচিত মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত যুদ্ধের ঘটনাবলি নিয়ে ২৭টি পর্ব দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে প্রকাশিত হয়। তন্মধ্যে ১৯৯৯ সালে ৩, ১০ ও ১৭ সেপ্টেম্বর যথাক্রমে ১৯, ২০ ও ২১ পর্বে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাখরপুর যুদ্ধের অংশবিশেষ পাঠকগণের উদ্দেশ্যে আজ তুলে ধরলাম।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজার থেকে বহরিয়া ও আখনের হাট হয়ে একটি রাস্তা দক্ষিণ দিকে হাইমচর বাজার, চরভৈরবী ও হায়দারগঞ্জ হয়ে রায়পুর গিয়েছে। আখনের হাট থেকে অপর একটি রাস্তা চান্দ্রাবাজার, নয়ারহাট হয়ে ফরিদগঞ্জ, রায়পুর গিয়েছে। আখনের হাট (বর্তমানে নদীগর্ভে) থেকে প্রায় ৫ কি. মি. পশ্চিমে বসুরহাট পর্যন্ত যে রাস্তাটি ছিলো তা বর্তামানে মেঘনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। চাঁদপুরের দক্ষিণে ফরিদগঞ্জ-রায়পুরের পশ্চিমাংশের জনসাধারণের জন্যে বৃটিশ আমল থেকে এ রাস্তা চলাচলের একমাত্র পথ ছিলো। বর্ষাকালে চলাচলের একমাত্র অবলম্বন ছিলো নৌকা। যুদ্ধকালীন চাঁদপুরের বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি।
১৯৭১ সালের মে মাস। এসব এলাকায় তখনও রাজাকার সৃষ্টি হয়নি। এলাকার জনগণ নিরাপদে কাজকর্ম করে যাচ্ছিল। চাঁদপুর সদর থেকে ১৪ কি. মি. দক্ষিণে এবং ফরিদগঞ্জ সদর থেকে পশ্চিমে-উত্তর কোণায় প্রায় ১৫ কি. মি. দূরে চান্দ্রা বাজারের অবস্থান। পায়ে চলার পথ ব্যতীত অন্য কোনো যানবাহন দিয়ে যাতায়াতের সুবিধা ছিলো না। অত্যন্ত নিরাপদ স্থান বলে বাজারটি সকাল ও বিকেলে থাকতো জমজমাট।
ফরিদগঞ্জের শান্তিবাহিনীর সহযোগিতায় পাক সেনারা রাজাকার সৃষ্টির কাজে লেগে গেলো। রাজাকার সৃষ্টিতে যখন সফল হতে চলেছে, তখন তারা দৃষ্টি দিলো মুক্তিবাহিনীর আস্তানা কোথায় থাকতে পারে। শান্তিবাহিনী ও রাজাকারদের প্ররোচনায় পাক সেনাদের দৃষ্টি পড়লো চান্দ্রাবাজারের দিকে।
আগস্ট মাস। বর্ষাকাল। ফরিদগঞ্জ হতে নয়াহাট-চান্দ্রাবাজার আখনের হাট রাস্তাটি পানিতে নিমজ্জিত হয়নি। পাক সেনারা ফরিদগঞ্জ থেকে নয়াহাট বাজার হয়ে চান্দ্রাবাজার পৌঁছার পূর্ব মুহূর্তে বালিয়া মজুমদার বাড়ির আনন্দ চন্দ্র মজুমদারের পুত্র শরৎ চন্দ্র মজুমদার, মনমোহন মজুমদারের পুত্র ফণীভূষণ মজুমদার এবং হরিমোহন চক্রবর্তীর পুত্র নিহার রঞ্জন চক্রবর্তীকে গুলি করে হত্যা করে।
পাক সেনারা চান্দ্রাবাজার পৌঁছেই চতুর্দিকে গোলাগুলি শুরু করে সম্পূর্ণ বাজারটি পুড়িয়ে দেয়। বাজার সংলগ্ন ইউনিয়ন পরিষদের ঘরটিও পুড়িয়ে দেয়। বাজারে মদনা গ্রামের আঃ রহমান বাড়ির পুত্র হাদু রাঢ়ীকে পিটিয়ে আধমরা করে মুমূর্ষু অবস্থায় ফেলে রাখে। স্বাধীনতার পর তিনি মারা যান। মদনা গ্রামের নোয়ার আলী জমাদারের পুত্র সিপাহী মুকবুল জমাদারকে গুলি করে মেরে ফেলে। বাজারের পশ্চিম প্রান্তে বালিয়া গ্রামের কেরামত আলী পাটওয়ারীর পুত্র জালাল পাটওয়ারী ও দক্ষিণ বালিয়া গ্রামের ইসমাইল পাটওয়ারীর পুত্র আবুল হোসেন পাটোয়ারীর দু হাত একত্রে বেঁধে খালের পানিতে পিটিয়ে নামিয়ে দিয়ে সাঁতার দিতে হুকুম দেয়। তারা বাধ্য হয়ে হাবুডুবু খেয়ে সাঁতার দিতে থাকে। এক পর্যায়ে বাজারের পশ্চিম পাশের খালের ওপরের বাঁশের সাঁকের বাঁশের দুদিকে দুজন চলে গেলে উভয়ের হাত বাঁশে আটকে যায়। এ বিপজ্জনক অবস্থায় যখন তারা হাবুডুবু খাচ্ছিল, তখনই গুলি করে তাদের হত্যা করা হয়।
চান্দ্রাবাজারের রেশন শপের মালিক আবদুর রহমান পাটওয়ারীর পুত্র সৈয়দ আহমেদ পাটওয়ারীকে পিটিয়ে দুর্বল করে তার মাথায় বুলেটের বাক্স উঠিয়ে দেয়। পাক সেনাদের পিটুনি দেখে বাখরপুর গ্রামের রজ্জব আলীর পুত্র হাফেজ আলী মোল্লা ভয়ে খালের পানিতে ঝাঁপ দিয়ে খালের ওপারে ওঠার চেষ্টারত পাক সেনারা গুলি করলে হাফেজ আলী খালের পানিতে তলিয়ে যায়। পরবর্তীতে তার লাশ নিজ বাড়িতে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।
সৈয়দ আহম্মদের মাথায় বুলেটের বাক্স। সকালের নাস্তা খেলেও এখন ক্ষুধার জ্বালা সইতে পারছে না। ভারী বাক্স নেয়ার অভ্যাস নেই তার। পিটুনির কারণে শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। কিন্তু উপায় নেই বুলেটের বাক্স বহন করতে হবে। পাক সেনারা রাস্তার দু পাশে অজস্র গুলি বর্ষণ করে চলছিল। কে বাঁচলো আর কে মরলো তাদের জানার বিষয় নয়। মুষলধারে বৃষ্টির ন্যায় গুলিবর্ষণ জনসাধারণকে আতঙ্কগ্রস্ত করে তুললো। দিগি¦দিক ছোটাছুটি করে মানুষ আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিল। বাখরপুর গ্রামের মুন্নাফ গাজীর ৫ বছরের ছেলে মাহবুব গাজীর ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হলো। পরবর্তীতে তার ডান হাতের কনুইর ওপর পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। সে মাহবুব কালের সাক্ষী হয়ে আজো বেঁচে আছে। আবদুল হালিম গাজীর স্ত্রী মঞ্জুমা বেগমের পেটে গুলিবিদ্ধ হয়। একই গ্রামের আলী গাজীর পুত্র সৈয়দ গাজী ও তার কন্যা রোকেয়া বেগম এবং শামছল হক ছৈয়ালের পুত্র আঃ কাদের ছৈয়াল গুলিতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। পাক সেনারা পশ্চিম দিকে তৎকালীন হানারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিকট পৌঁছলে দক্ষিণ বালিয়া গ্রামের বাসু পাটোয়ারীর ছেলে সাত্তার পাটোয়ারীকে, আঃ গফুর পাটোয়ারীর ছেলে কুদ্দুছ পাটোন্নারীকে ও আমজাদ আলী শেখের পুত্র আবদুল হক শেখকে গুলি করে হত্যা করে। রাজারহাট যাওয়ার পথে বটগাছের নিচে বাখরপুর গ্রামের আমান উল্যা খানের পুত্র ইউসুফ খান এবং বোনের বাড়িতে এসে নয়ানী লক্ষ¥ীপুর গ্রামের জয়নাল আবদীন ছৈয়ালের পুত্র আঃ মান্নান পাক-সেনাদের হাতে ধরা পড়লে ওই স্থানেই তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে।
প্রত্যক্ষদর্শী চান্দ্রা ইউনিয়নের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রাক্তন ডেপুটি কমান্ডার আবদুল মান্নান ও বাখরপুর নিবাসী প্রাক্তন পোস্ট মাস্টার মাওলানা নেছার আহমেদ জানান, পাকসেনাদের এ আক্রমণে ২০/২৫ জন নিরীহ জনতা শহীদ হন।
পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক চান্দ্রাবাজার এলাকা আক্রান্ত হওয়ার পর জনমনে মারাত্মক ভীতির জন্ম নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা বিষয়টি প্রত্যক্ষ করলেন এবং জনমনে ভয়ভীতি দূর করার জন্য গোবিন্দিয়া গ্রামের রহমত আলী গাজীর পুত্র নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজীর (সকলের নিকট নূরু মেজর নামে পরিচিত) ও বাখরপুর গ্রামের দেলোয়ার হোসেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে ১টি শক্তিশালী মুক্তিযোদ্ধার দল বাখরপুর মজুমদার বাড়িতে অবস্থান নেয়। তাঁরা পাকসেনা ও রাজাকারদের গতিবিধি লক্ষ্য করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কর্ণগোচর হলো পুরাণবাজারের বর্তমান মক্কা মিল এলাকায় রাজাকার বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে গেছে। তাদের অশুভ পদচারণায় জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত। মুক্তিযোদ্ধারা ভাবলেন কীভাবে এ রাজাকারদের শায়েস্তা করা যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের কঠোর তৎপরতার ফলে তখন কিছু সংখ্যক চোর-ডাকাত ধরা পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রভৃতি বুঝিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ করার অঙ্গীকারে আবদ্ধ করেন। তারা অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে পুরাণবাজার রাজাকারদের ধরে আনতে ইচ্ছা প্রকাশ করলে মুক্তিযোদ্ধারা সম্মতি দেন। এমনই কর্মতৎপরতার মাঝে আগস্ট মাসের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় এ বাহিনী চাঁদপুর পুরাণবাজারের পাহারারত রাজাকার চান্দ্রা ইউনিয়নের মদনা গ্রামের হেমায়েত সহ ৪ জন রাজাকারকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র সহ ধরে আনতে সক্ষম হয়। রাজাকারদের ধরার কারণে চান্দ্রা এলাকার জনমনে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আস্থা জন্মে। অতঃপর কাজের সুবিধার্থে মুক্তিযোদ্ধারা দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে একটি গ্রুপ দেলোয়ার হোসেন পাটোয়ারীর নেতৃত্বে হাইমচর এলাকায় গমন করেন। অপর একটি শক্তিশালী দল নূর আহমেদ গাজীর নেতৃত্বে বাখরপুর গ্রামের মজুমদার বাড়িতে থেকে যান ।
চাঁদপুর শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে বাখরপুর মজুমদার বাড়ির অবস্থান। বাড়িতে একটি দ্বিতল ভবন। এ ভবনের পূর্ব পাশ দেয়াল দিয়ে ঘেরা। এ দেয়ালের পেছনে বিরাট সুপারী গাছের বাগান ও দিঘি। পশ্চিম পাড়ে বসবাসের বাড়ি। দক্ষিণ পাশে সুপারী গাছের বাগান। তার পাশে ফসলের বিশাল খোলা মাঠ। মাঠে অথৈ পানি। এ বাড়িতেই বীর বিক্রম শহীদ নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজী ও তার দল দিনের কর্মকাণ্ড শেষ করে গভীর রাতে এসে বিশ্রাম নিতেন।
মুক্তিযোদ্ধাগণ কর্তৃক ৪ জন রাজাকার ধৃত হওয়ার কারণে চাঁদপুরের শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে যায়। তারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান জানার জন্যে গুপ্তচর লাগিয়ে দিয়ে বাখরপুর মজুমদার বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প সম্পর্কে জানতে পারে এবং কীভাবে কখন আক্রমণ করা যায় তার একটি পরিকল্পনা তৈরি করে ।
পাকসেনারা রাজাকারদের সহযোগিতায় ৭/৮টি ছইওয়ালা নৌকায় প্রায় ৫০/৬০ জনের একটি শক্তিশালী দল নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী চাঁদপুর থেকে বাখরপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ওই মজুমদার বাড়ির উত্তর পাশের বিশাল খোলা মাঠ দিয়ে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ভোর ৫টার দিকে পৌঁছে। তারা মজুমদার বাড়ির অদূরে এসেই বাড়ির দিকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এবং গ্রামটি একেবারে নিস্তব্ধ। হঠাৎ গুলির আওয়াজে মজুমদার বাড়ির দ্বিতল ভবনে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতিহীনভাবেই পাল্টা গুলি করে প্রতিরোধের প্রচেষ্টা নেয়। জানা যায়, দ্বিতল ভবনে ২৫/৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। এ মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতল ভবনে থেকেই প্রাণপণে অত্যন্ত কৌশলে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পাক সেনারা রকেট লাঞ্চার দিয়ে আক্রমণ করে দালানের কিছু অংশ ভেঙ্গে ফেলে। দীর্ঘক্ষণ লড়াই করার পর মুক্তিযোদ্ধাদের বুলেট ও গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধারা কোনো প্রকার আক্রমণ না করে চুপ হয়ে গেলে পাক সেনারা দ্রুত বাড়িটি ঘিরে ফেলে। অতঃপর হ্যান্ড মাইক দিয়ে দালান থেকে বের হওয়ার জন্যে আহ্বান জানায় এবং আশ্বাস দেয় যে, দালান থেকে বের হয়ে আসলে কিছুই করবে না। মুক্তিযোদ্ধারা আত্মসমর্পণ করতে রাজি নন। পাক সেনাদের আক্রমণের মুহূর্তে উত্তর দিক ব্যতীত বাকি তিনদিকে পলায়নের বেশ সুযোগ ছিলো। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা দালান ত্যাগ না করেই অত্যন্ত সাহসের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। যুদ্ধ করতে করতে যখন বুলেট, গোলাবারুদ শেষ হয়ে যায়, আর পাক সেনারা হ্যান্ড নাইক দিয়ে দালান থেকে বের হওয়ার জন্য আহ্বান জানায়, তখন কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজী হঠাৎ পাক হানাদার বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ না করে তার শেষ সম্বল একটি গ্রেনেড ফাটিয়ে নিজেই আত্মহত্যা করেন। ১০/১২ জন মুক্তিযোদ্ধা দালান থেকে বের হয়ে আসলে তাদের বেঁধে লাইন করে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রচণ্ড ব্রাশফায়ারে এদের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। অনেকের পেটের নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত মূল্যবান জিনিসপত্র মজুমদার বাড়ির দালানের পূর্ব পাশের শীতলা খোলার সামনে এনে পুড়িয়ে দেয়। মদনা গ্রামের ইউনুছ খানের পুত্র হাবিলদার আঃ মান্নানকে দালানের উত্তর পাশে কাঁঠাল গাছের নিচে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। দালানের সামনে দক্ষিণ পাশে মুমূর্ষু অবস্থায় নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাওয়া ও পেছনে হাত বাঁধা একজন মুক্তিযোদ্ধার কনুইয়ের সমস্ত মাংস উঠে যায়। এ মুক্তিযোদ্ধাকে দ্রুত হানারচর স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়। পরবর্তীতে রাজাকাররা এ মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার সংবাদ জেনে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে হামলা করে মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে মেরে ফেলে ।
চাঁদপুর জেলা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবেদার (অবঃ) আবদুর রব (বর্তমানে প্রয়াত)। তিনি জানান, এ যুদ্ধের সময়ে তিনি তার বাহিনী নিয়ে ফরিদগঞ্জের পূর্বাঞ্চলে অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ডের নির্দেশ অনুযায়ী এবং চাঁদপুর অঞ্চলের কমান্ডার জহিরুল হক পাঠানের সাথে পরামর্শ মতে চাঁদপুর দক্ষিণাঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম দেখাশুনার জন্য তিনি বাখরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথিমধ্যে এ যুদ্ধের সংবাদ পান। তিনি এ যুদ্ধের বর্ণনা এবং নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজীর বীরত্বের ঘটনাবলি লিখিতভাবে কমান্ডার জহিরুল হক পাঠানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ডকে অবহিত করেন। নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজীকে তার নিজ বাড়ি গোবিন্দিয়ার দাফন করা হয়।
বীর মুক্তিযোদ্ধা নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজী বীর বিক্রম উপাধি পেয়েছেন। স্বাধীনতার পর শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটেও নাম প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পরিবারের কেউই জানতেন না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৬ সালের ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে তৎকালীন সরকারের এক দাওয়াত নামার মাধ্যমে এ বীর মুক্তিযোদ্ধার বীর বিক্রম উপাধি ভূষিত হবার সংবাদ তার পরিবার জানতে পেরেছে।
১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকায় লিখেছিলাম বীর বিক্রম নায়েক সুুবেদার শহীদ নূর আহমেদ গাজীর স্ত্রী খাইরুন্নেছা তাঁর সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না। দারিদ্র্যের নিষ্ঠুর কষাঘাত আর অসহ্য বেকারত্বের যন্ত্রণা সইতে না পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন তার এক শিক্ষিত পুত্র সন্তান। মৃত্যুকালে চাঁদপুরে স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য ভিটামাটি রাক্ষুসী মেঘনা গ্রাস করে নেয়ার পর থেকে অসহায় খায়রুন্নেছা চার সন্তান নিয়ে ঢাকার আনাচে-কানাচে ¯স্রোতে ভাসা শেওলার মতো ঘুরে বেরিয়েছেন। এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক মোঃ হারুন চৌধুরীর নিকট টেলিফোনে জানতে চাইলে তিনি জানান, বীর বিক্রম নায়েক সুবেদার শহীদ নূর আহমেদের স্ত্রী ঢাকায় আছেন। তিনি সেনাবাহিনীর লোক বিধায় স্থানীয়ভাবে মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা পাচ্ছেন না।
২০২৩ সালের ১০ আগস্ট চান্দ্রা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খান জাহান আলী কালু পাটওয়ারী জানান, বীর বিক্রম শহীদ নায়েক সুবেদার নূর আহমেদ গাজীর স্ত্রী খায়রুন নেছা এখনও বেঁচে আছেন। তিনি বর্তমান সদাশয় সরকার প্রদত্ত সকল সুবিধা পাচ্ছেন। তাঁর বড় পুত্র ডাঃ সিরাজুল ইসলাম গাজী ঢাকার হলিফ্যামিলি হাসপাতালে কর্মরত আছেন। ছোট পুত্র হাফেজ মাওলানা সাইফুল্লাহ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের ঢাকাস্থ বিজিবি মসজিদের ইমাম এবং কন্যা দারুল বেগম গৃহিণী।
উল্লেখ্য, শহীদ নূর আহমেদ ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে ই.এম.ই. কোরে নায়েক সুবেদার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই বছর ডিসেম্বর মাসে ছুটিতে দেশে এসে তিনি আর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাননি। সরাসরি বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তখন তিনি নিজে চাঁদপুর শহরের তৎকালীন আনসার ক্লাবে (বর্তমানে চাঁদপুর সরকারি মহিলা কলেজ ছাত্রী নিবাস) ইপিআর, ছাত্র-জনতার সাথে সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং দেশ মাতৃকার জন্যে অকাতরে নিজের জীবন বিসর্জন দেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল বাসার : বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি। জন্মসূত্রে হাজীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা।