বৃহস্পতিবার, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫  |   ২১ °সে
আজকের পত্রিকা জাতীয়আন্তর্জাতিকরাজনীতিখেলাধুলাবিনোদনঅর্থনীতিশিক্ষাস্বাস্থ্যসারাদেশ ফিচার সম্পাদকীয়
ব্রেকিং নিউজ
  •   হাইমচরে মাটি বোঝাই বাল্কহেডসহ আটক ৯
  •   কচুয়ায় কৃষিজমির মাটি বিক্রি করার দায়ে ড্রেজার, ভেকু ও ট্রাক্টর বিকল
  •   কচুয়ায় খেলতে গিয়ে আগুনে ঝলসে গেছে শিশু সামিয়া
  •   কচুয়ায় ধর্ষণের অভিযোগে যুবক শ্রীঘরে
  •   ১ হাজার ২৯৫ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে কোস্ট গার্ড

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০

একাত্তরের অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর আজকের বাংলাদেশ
অনলাইন ডেস্ক

আমাদের দেশে কি ডান কিংবা বাম ধারার অনেক রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী এবং সচেতন মহলের মধ্যে একটা উদ্বেগ লক্ষ্য করা যায়। তারা প্রায় এই বলে আক্ষেপ করেন যে, ’৭১-এর চেতনা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশ থেকে বিচ্যুত হয়েছে প্রায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে দেশ থেকে বিচ্যুতি বা লোপ পেতে বসেছে কথাটা অপ্রিয় সত্য। আলাপ-আলোচনায়, সভায় এবং পত্র-পত্রিকায় এরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নানাভাবে, যার যেমন খুশি বা সুবিধা তেমন করে উপস্থাপন করে থাকেন। কেউ বলেন এই চেতনা অসাম্প্রদায়িকতা, কেউ বলেন এই চেতনা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীশক্তি ধ্বংস করা, কেউ বলেন এই চেতনা মৌলবাদকে নির্মূল করা, আরো বলেন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে কি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা এইগুলো? তবে না, আসলে ঐগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপসর্গ বা উপাদান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আসলে একটি শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন মানবীয়-সমাজ ও দেশ গঠন প্রক্রিয়া।

১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখনই কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগঠিত করতে চেষ্টা করেছেন, তখনই তৎকালীন শাসকদল ও শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিরা তাকে ইসলামণ্ডবিরোধী, ইসলামী-রাষ্ট্র, পাকিস্তান-বিরোধী ইত্যাদি আখ্যায় আখ্যায়িত করায় প্রথম থেকেই এই অঞ্চলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যাহত এবং স্পষ্টত একটা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী চরিত্রও পরিগ্রহ করে। ১৯৪৭ সাল থেকে জনগণের সকল প্রকার গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর যে ধারাবাহিক আক্রমণ তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকশ্রেণী চালিয়েছিল সেটা তারা ধর্মের দোহাই দিয়েই সবসময় করেছিল। এজন্য জনগণের এক ব্যাপক অংশের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনার-আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হয়েছিল। ফলে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চেতনার প্রধানতম উপসর্গ ছিল অসাম্প্রদায়িকতা।

মুক্তিযুদ্ধে ধর্মণ্ডবর্ণ, নারী-পুরুষ, জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে মানুষ যুদ্ধ করেছিল একটি শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আর সেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছিল দেশের মানুষ ১৭ই মার্চ। ঠিক সেদিন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামে এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটলো। হেফাজতের নেতাকে সমালোচনা করে একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে ৮৮টি হিন্দু বাড়ি ও ৫টি মন্দিরে হামলা চালানো হয়। এর আগেও ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে এ ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেছে।

২০১৯ সালে ‘তৌহিদী জনতার’ ব্যানারে ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় সহিংসতার চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হয়। এ ঘটনার জের ধরে ভাংচুর হয় হিন্দু বাড়ি ও মন্দির। ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ১৫টি হিন্দু মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট হয়। ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন যশোরের অভয়নগর চাপাতলা গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা চালানো হয়। ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১২ সালে রামু উখিয়া, টেকনাফের বৌদ্ধমন্দির ও বৌদ্ধপল্লীতে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সেদিন প্রায় ২০টি বৌদ্ধবিহার, ৪১টি বসতঘর পুড়িয়ে দেয়। এসব ঘটনার কোনো বিচার আদৌ হয়নি। আমরা যদি আরও পেছনে ফিরে দেখি, ১৯৯২ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ৩৫২টি মন্দির পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি হিন্দু পরিবারগুলোর ওপর ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসে, অনেক ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে যা বলার নয়। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর হিন্দুদের ওপর নির্যাতন হয়। বলতে গেলে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হন। ’৭১-এর মুক্তি আন্দোলনের মানুষরা কি এই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন?

’৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় প্রায় ১ কোটি বাঙালি ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। তারা ধর্মের ভিত্তিতে সেখানে আশ্রয় পাননি। তারা বাস্তুচ্যুত বাঙালি হিসেবেই আশ্রয় পেয়েছিল। একটা সময় ছিল এদেশের মানুষ হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান মিলেমিশে একই পাড়ায় বসবাস করতো। হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবে মুসলমানরা এবং মুসলমানদের উৎসবে অন্যরা শরীক হতো। সম্প্রীতির সেই মেলবন্ধন কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। দেশটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফলে চারটি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম পালন করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না। কিন্তু ইসলামের নামে আর পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশের মানুষকে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সব ধর্মের সমানাধিকার এবং সবাই যেন সমানভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে। ধর্মের নামে কেউ যেন কারও উপরে জুলুম করতে না পারে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে বলা আছে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য। আরও বলা আছে, (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে। অপরদিকে সংবিধানের ২(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্ম পালনে রাষ্ট্র সমমর্যাদা ও সমানাধিকার নিশ্চিত করিবে। তবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ছিল না। পরে জেনারেল এরশাদ সংবিধানের অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে তা যুক্ত করেছেন। সংবিধানে সব ধর্মের সমানাধিকারের কথা বলা হলেও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থেকেই যায়। তাই বর্তমানে সংবিধানে একদিকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম অপরদিকে ধর্মনিরপেক্ষতা যা সাংঘর্ষিক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অন্যতম উপসর্গ বা উপাদান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের কোন ধর্মীয় চরিত্র থাকবে না। মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাজনের পর প্রথম থেকেই শেখ মুজিব বুঝেছিলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এদেশ সবার। প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে পরিচিত করেন। এ দলটি ধর্মনিরপেক্ষ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে থাকে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। তবে বাংলার শ্রমিক, কৃষক, নারী-পুরুষ, হিন্দু-মুসলিম, ধনী-গরীব, জাতি-উপজাতি নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু যে দলটি অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এবং পরিচিতি হয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল সেই দলটিই রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলেও দেশে এখনো চলছে ধর্মের নামে সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িকতা। তথাকথিত ধর্মের অবমাননার নামে বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া, লুটতরাজ এমনকি ধর্ষণের মতো অপরাধও ঘটছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে অন্যতম মূল চেতনা তা আজ যেন মুখ থুবড়ে পড়ছে। যা বললে হয়তো ভুল হবে না নিশ্চয়ই।

আমাদের অনেক অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু একটি জায়গায় যেন আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছি, তা সকলেরই অনুমেয়। দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে দেশ জাতিসংঘের চূড়ান্ত সুপারিশ অর্জন করেছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে। মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে। স্বাধীনতার মাত্র ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়ন সারা বিশ্বের কাছে একটি বিস্ময়। কিন্তু প্রয়োজন প্রগতিশীল মানবিক মূল্যবোধের এক সমাজব্যবস্থা। কারণ এখনো সমাজ থেকে মূলোৎপাটন ঘটেনি সাম্প্রদায়িক শক্তির। এজন্য সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন দরকার।

আমাদের মূল শেকড় মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিটি মানুষের আত্মপরিচয় তার শেকড় থেকে উঠে আসার পরিচয়। প্রতিটি মানুষের বেড়ে-উঠার পাশাপাশি জানতে হবে এ দেশটি কিসের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্টি হয়েছিল। এ দেশটির জন্মের ইতিহাস জানতে হবে। এ দেশটির জন্মের পেছনে রয়েছে কত ত্যাগ-তিতিক্ষা, তবেই স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যেমনি ধর্মণ্ডবর্ণ, ধনী-গরীব, জাতি-উপজাতি, সর্বোপরি আপামোর সাধারণ মানুষ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে বিজয় লাভ করেছি, তেমনি আমাদের উচিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সাম্প্রদায়িকতা পরিহার করে বৈষম্যহীন-শোষণমুক্ত কাঙ্ক্ষিত সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসা।

সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যসূত্র :

১. বাংলাদেশে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা। প্রকাশক : স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটি, ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৯;

২. এশীয় গবেষণা পত্রিকা (মে সেমিনার- ১৯৮৪- এর প্রবন্ধ), প্রকাশক : এশীয় গবেষণা কেন্দ্র, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা, মে ১৯৮৪;

৩. বঙ্গবন্ধুর নীতিনৈতিকতা- হাসান মোরশেদ,

৪. বাংলাদেশের অভ্যুদয় : আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণ- মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম, ইমপ্রেস পাবলিশার্স, মার্চ, ১৯৮৩

৫. বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৬ মার্চ ২০২১

৬. নয়া দিগন্ত, ৯ এপ্রিল, ২০২২

লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মোঃ হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা; চাঁদপুর জেলা শিক্ষক নেতা; সমাজ ও রাজনীতিবিশ্লেষক।

  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়