প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২২, ০০:০০
ঈদুল আজহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদ আগামীকাল। করোনার কারণে তিন বছর ধরে ঈদ-আনন্দ অনেকটা তামাটে। করোনাভাইরাস জিরোতে নেমে আসায়, ভাইরাসের দাপট কমতে থাকায় দেশবাসী ধারণা করছিলো এবারের ঈদটা অনেক আনন্দময় হবে। কিন্তু আবারও করোনা আক্রান্ত এবং মৃত্যুও সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে আতঙ্ক। সাথে সারা দেশে জ¦র, ঠাণ্ডা বলা যায় ঘরে ঘরে। করোনা আতঙ্ক আবার পেয়ে বসেছে হয়তো। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মতো সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কুড়িগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গায় বন্যার দুঃসংবাদ। আর এমন সময় এলো কোরবানির ঈদ। এই তিন ধাক্কা সামাল দিতে জনগণের এখন ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা!
ঈদ অর্থ আনন্দ, উৎসব। ঈদ এসেছে কিন্তু আমাদের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসেনি। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য। অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। চাকুরি হারিয়েছেন অনেকে। যারা এমন অবস্থায় পড়েছেন তাদের জীবনে ঈদটা তেমন আনন্দ নিয়ে আসতে পারবে না। সন্তান-স্বজনদের নতুন জামা-কাপড় দেয়াতো দূরের কথা, কোরবানি দিতে পারবেন না অনেকে। তাই ঈদটা ওদের তামাটেই হবে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উৎসবের একটি পবিত্র ঈদুল আজহা। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যাপন দিনটিকে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করে এবং সমতা, মানবিকতা, সহানুভূতি, সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের অমোঘ বার্তা ছড়িয়ে দেয়। এবারও দেবে। ঈদুল আজহা মানেই মাংস খাওয়ার ঈদ। এবার ঈদে কত লাখ লোক কোরবানি দিতে অক্ষম হবে সঠিক সমীক্ষা হলে হয়তো এর সংখ্যা অনেক হবে।
যারা চাকরিজীবী তাদের অনেকেই আজ করোনার কারণে চাকুরি হারিয়ে ঘরে আছেন। হাতে সংসার চালানোর অর্থ নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যেও চরম সঙ্কট চলছে। এমন কষ্টের দিনেই আনন্দের ঈদ এসে হাজির। ঈদ যে কেবল আনন্দের তা কিন্তু নয়। গরিব মানুষের জন্যে ঈদটা কখনো কখনো অনেক কষ্টের বটে। সন্তান, স্বজন আর পিতাণ্ডমাতাকে নতুন কাপড় না দেয়ার কষ্ট, ভালো খাবার দিতে না পারার কষ্ট থেকেই যায়।
রোজার ঈদের মতো এবারের ঈদটা আমাদের জন্যে খুব একটা আনন্দ বয়ে আনছে তা বলা যাবে না। যারা ধনী শ্রেণীর তাদের কথা ভিন্ন, তবে সবার সুখের সাথে সাথেই তো ঈদেও আনন্দের সম্পর্ক থাকে। সবাই মিলে আনন্দ করতে না পারলে সে আনন্দ পূর্ণতা পায় না। ঈদের কোরবানির হাট আর ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে রয়েছে ঝুঁকি। এই ঝুঁকি করোনার প্রকোপ বাড়া এবং মৃত্যুর শঙ্কা তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে আমরা যে বর্তমানে মহাসংকটে আছি এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ছে। এর মধ্যেই দেশে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে যে নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে-এজন্যে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু? সামনে আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আরও বন্যা হওয়ার শঙ্কা আছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে বন্যা মোকাবিলা করার জন্যে সরকার যথেষ্ট প্রস্তুত। বন্যা মোকাবিলার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আমরা আশ্বস্ত হতে পারি। আমাদের মতো দরিদ্র দেশের একের পর এক সংকট মোকাবিলা করা একটু দুরুহই বটে। তবে এ পর্যন্ত সরকারের ত্রাণ সফলতায় আমরা খুশি হতে পারি। এ বিষয়টিতে সরকারের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় আরও বেশি সহায়তা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হবে বলে আমরা আশা করি। খবরের কাগজে বন্যায় আক্রান্ত মানুষের দুঃখণ্ডকষ্টের কথা তুলে ধরা হচ্ছে এবং ত্রাণ কার্যক্রম ততোটা পর্যাপ্ত নয় ইত্যাদি লেখা হচ্ছে। ত্রাণ যতোই দেয়া হোক, ঘরে ঘরে ত্রাণ পৌঁছবে এবং মানুষের চাহিদা শতভাগ পূরণ হবে তা ভাবা হয়তো ভুল হবে।
বন্যা বাংলাদেশের জন্যে একটি বার্ষিক ঘটনা। প্রতি বছরই আমরা বন্যার কবলে পড়ি। কোনো বছর বেশি মাত্রায়, কোনো বছর কিছুটা কম। কোনো বছর কিছুটা আগে, কোনো বছর কিছুটা দেরিতে আসে। এটা নিয়ে আমাদের পূর্ব প্রস্তুতি থাকা বাঞ্ছনীয়। এবারও বোধ করি সরকার প্রস্তুত রয়েছে। তবে করোনার কারণে সারা দেশে ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে এখন শতভাগ সফলতা মিলবে কি না কেউ কেউ সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। দেশের বহু জায়গায় পানি বেড়ে তা মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। এমন পরিস্থিতির জন্যে আমরা কোনো পূর্বাভাস পেয়েছিলাম কি না? তা হলে হয়তো পানি উঠে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে কী করা উচিত, তা নিয়ে নতুনভাবে ভাবার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারতো। সংশ্লিষ্টরা এমন আভাস একেবারে শেষ মুহূর্তেই দিয়ে থাকেন, যার কারণে আমাদেরও আর করার কিছু থাকে না।
করোনার পর বন্যার প্রকোপ। এই দুয়ের প্রভাবে ঈদের খুশি এবার ম্লান। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ঈদের আনন্দেও প্রাক প্রস্তুতি একেবারেই আলাদা। উৎসব পালনের মানসিকতাই নেই। কোরবানির হাটে আগের সেই জৌলুশ নেই। আগের মতো গরু কেনার হিড়িক কমেছে। ইসলাম ধর্মে কোরবানি ওয়াজিব, তাই যাদের সামর্থ্য আছে তারা কোরবানি দিচ্ছেন।
বৈশ্বিক যে কোনো মহামারিকে পরাভূত করতে হলে প্রয়োজন দেশপ্রেমিক দক্ষ নেতৃত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক শাসনতন্ত্র ও সঠিক কর্মকৌশল প্রণয়ন। বন্যা, করোনা সংক্রমণরোধ ও মহামারির পরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় ঠেকাতে আমাদেরকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্যঘাটতি মোকাবিলায় কৃষি জমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত হওয়া দরকার। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ও অধিকতর উৎপাদনশীল কৃষিতে আমাদের মনোযোগ বেড়েছে। একই সঙ্গে চাহিদা অনুসারে কৃষি পণ্যের আমদানি না বাড়িয়ে দেশীয় উৎপাদনে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। ঈদ ঘিরে সব ধরনের অপরাধ ও শান্তি বিনষ্টকারী অপচেষ্টা কঠোরভাবে দমন করতে হবে। হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিসসহ সরকারি-বেসরকারি জরুরি সেবা কার্যক্রম যেনো কোনোভাবেই ব্যাহত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং ঈদ-পরবর্তী পর্যটন কেন্দ্রগুলোর শৃঙ্খলা-নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থাগ্রহণ করতে হবে।
এবারের ঈদে আমাদের একান্ত প্রত্যাশা, রাষ্ট্র ও সমাজ সব সমস্যা-সংকট কাটিয়ে উঠুক। মজবুত হোক আমাদের জাতীয় ভ্রাতৃত্ববোধ। সব ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক দল-মতের মানুষের মধ্যে গড়ে উঠুক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে অটুট বন্ধন। সহনশীলতা, সহাবস্থান ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চা হোক সমাজের সর্বত্র। ঘুচে যাক ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু ও ক্ষমতাবান-ক্ষমতাহীনের ফারাক। ঈদের আনন্দে ধুয়ে-মুছে যাক সব দুঃখ-গ্লানি। শুভ ঈদ। ঈদ-আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে।
মীর আব্দুল আলীম : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।