প্রকাশ : ১৫ মে ২০২৫, ০৮:৫৯
টেকসই উন্নয়নে পারিবারিক নীতিমালা

পরিবার হলো মূলত রক্ত সম্পর্কিত ব্যক্তিদের সংগঠন, যেখানে পরিবারের সকল সদস্যের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, নিরাপত্তা এবং বিনোদনের আয়োজন হয়ে থাকে। পরিবার কখন কী কারণে গড়ে উঠেছে তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। বেশিরভাগের মত হলো, মানুষ সমতলে বসবাস করার সময় কৃষি কাজ শিখে ফেলে। কৃষিজাত পণ্য সংরক্ষণের জন্যে গোলা ঘর এবং নিজেদের জন্যে বসতঘর নির্মাণ করতে শুরু করে। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে পরিবার গড়ে উঠে । সম্পদের বিলি বন্টনকে কেন্দ্র করে
বিবাহ প্রথা এবং উত্তরাধিকারের বিষয়টি সামনে চলে আসে । বিভিন্ন রকমের চড়াই উতরাই পেরিয়ে স্বামী-স্ত্রীকেন্দ্রিক একক পরিবারই মূলধারায় চলে আসছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসার, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, পুষ্টিকর খাবারের সহজলভ্যতা, উন্নত চিকিৎসার ফলে মানুষের জীবনযাপন সহজতর হয়ে উঠেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবারের দায় দায়িত্ব পালন ব্যক্তির জীবনকে পীড়াদায়ক করে ফেলে। সমাজের নানা রকমের পরিবর্তনের পর মানুষ পরিবারকেন্দ্রিক জীবনের গুরুত্ব অনুধাবন করতে শুরু করেছে।
১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের এক সভায় ১৫ মে কে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। জাতিসংঘ ১৯৯৪ সালকে আন্তর্জাতিক পরিবার বর্ষ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। ১৯৯৫ সাল থেকে ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এ বছরে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসের থিম বা প্রতিপাদ্য হলো৷ ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবারভিত্তিক নীতিমালা’।
লোভ লালসা, রাগ- ক্ষোভ, হিংসা-প্রতিহিংসা, লুটপাট ও দুর্নীতির তাণ্ডবে পরিবারগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। পরিবারগুলো জৌলুস হারিয়ে প্রায় প্রাণহীন, মানহীন মলিন চেহারায় হাজির হয়েছে। পরিবারে শান্তির পরিবর্তে অশান্তির আগুন জ্বলছে। মানুষের মধ্যে পরিবারবিমুখ হবার তাড়না প্রবল হয়ে উঠেছে।
পরিবার হলো রাষ্ট্রের ক্ষুদ্রতম ইউনিট। সেটা অশান্ত, অকার্যকর হলে রাষ্ট্র ব্যবস্থা চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
পরিবার মূলত ভবিষ্যতের সুনাগরিক গড়ে ওঠার পবিত্র পীঠস্থান। শিশুরা বড়োদের স্নেহ-মমতা, সেবা-যত্ন, ভালোবাসা নিয়ে বড়ো হলে ভবিষ্যতে দায়িত্ব কর্তব্য পালনে আন্তরিক হবে। পরিবারে শিশু জন্ম লাভের পর সদস্যদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বইতে থাকে । নতুন অতিথির জন্যে সবার আনন্দ উচ্ছ্বাস পরিবারের সম্পর্ক মজবুত হতে সহায়তা করে। পরিবার সবার জন্যে খাদ্যের ব্যবস্থা করে, সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা লাভের সুযোগ দেয়, অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে, নৈতিক শিক্ষা দেয়, সামাজিক কাজে অংশ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করে, রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ায়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্যে প্রস্তুতি নিতে উৎসাহিত করে, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার তাগিদ দেয়, প্রবীণদের সম্মান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্যে অনুপ্রাণিত করে।
কৃষিভিত্তিক সমাজকে কেন্দ্র করে যে যৌথ পরিবারের জন্ম হয়েছিল, শিল্প বিপ্লবের পরবর্তী সময়ে এসে একক পরিবারে রূপ নিলো। ইচ্ছে করলেই আগের যৌথ পরিবারে ফিরে যাওয়া সম্ভব হবে না। তবে যে করেই হোক দুর্বল পরিবার ব্যবস্থাকে সবল করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, পরিবারের সকল সদস্য একই রকমের দক্ষতা, যোগ্যতার অধিকারী হবে না। কেউ লেখাপড়ায় এবং আয় রোজগারে ভালো করবে, নেতৃত্বের গুণাবলি নিয়ে পরিবারে ভূমিকা পালন করবে। আবার কেউ খেলাধুলা, নাচ, গান, কবিতা, নাটক, সিনেমা ও সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। বোহেমিয়ান ধরনের লোকজন পরিবারেই থাকে। নানান ধরনের আচার আচরণের লোকজন নিয়ে পরিবার। পরিবারের কোনো সদস্য দীর্ঘ মেয়াদি রোগে ভুগছেন, শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতাহীন সদস্যদের পরিবারেই বসবাস। পরিবার হলো সেই জায়গা, যেখানে স্বস্তি, নিরাপত্তা, দায়িত্ব- কর্তব্য, শান্তি, শৃঙ্খলা , শ্রদ্ধা-ভালোবাসার শুভ সূচনা হয়। চূড়ান্ত বিচারে কোনো পরিবারই নিখুঁতভাবে কাজ করে না। আন্তরিক ভালবাসা আর ক্ষমা করার মানসিকতা এটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারে।
আগামী দিনের সভ্য এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে পরিবারই মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। যে পরিবার অসৎ দুর্নীতিবাজ সেই পরিবারের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ তৈরি হওয়া প্রায় অসম্ভব একটি বিষয়।
আমাদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন, তার আয় রোজগার সম্পর্কে মানুষের তেমন কোনো ধারণা নেই। কেউ কেউ সবসময়ই নিজেকে মহৎ, সৎ, আদর্শবান, ত্যাগী, চরিত্রবান, পরোপকারী হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেন। নানা রকম পরিস্থিতিতে মানুষ মুখ বুঁজে অনেক কিছু সহ্য করেন। পরিবারের সদস্যরা অনৈতিক আয় রোজগার সম্পর্কে কম-বেশি বুঝতে পারে। ঘুষ-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পরিবার মানুষের কাছে অসম্মান, অমর্যাদার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি আদর্শ পরিবার একটি ভালো মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সমতুল্য। আজকে যে সমাজে ভালো মানুষের জন্যে হাহাকার আমরা শুনতে পাই, তার মূলে রয়েছে দুর্নীতিবাজ, অসৎ পরিবারগুলো থেকে আগত চরিত্রহীন মানুষের সরব উপস্থিতি।
আমরা ভুলে যাই যে, আম গাছ থেকে জাম পাওয়া যায় না। খারাপ পরিবার থেকে ভালো মানুষের সৃষ্টি হয় না। সন্ত্রাসী, চোর, ডাকাত, বদমায়েশ, লম্পট, ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ মানুষের ঘরে আদর্শবান, ন্যায়পরায়ণ মানুষের জন্ম হওয়া খুবই অস্বাভাবিক।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেসব দুর্নীতি, লুটপাটের কাহিনী আমরা শুনতে পাই, তার পেছনে রয়েছে কিছু অসৎ পরিবার থেকে আগত সদস্যদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বা পৃষ্ঠপোষকতা।
মাঝে মধ্যে আমরা সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে যতোটা সরব, ঠিক ততোটাই নিজেদের পরিবারের বিষয়ে নিয়ে নিরব থাকি।
পরিবারকে ঘুষ, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, লুটপাট থেকে বিরত রাখার ক্ষেত্রে আমাদের চরম উদাসীনতা রয়েছে। রাষ্ট্র মেরামতের পাশাপাশি পরিবার মেরামত করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
পরিবার শক্তিশালী, দয়ালু, ন্যায়পরায়ণ না হলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশ সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না। পৃথিবী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক এই সময়ে এবারের আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসের থিম বা প্রতিপাদ্য ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য পরিবার ভিত্তিক নীতিমালা ‘ প্রণয়নের আহ্বান তাৎপর্যপূর্ণ।
লেখক : প্রবীণ বিষয়ে লেখক, গবেষক ও সংগঠক।