প্রকাশ : ১৬ মে ২০২৫, ০৯:১০
তোমাকে দেখে মুগ্ধ হলাম

তোমাকে কতো না খুঁজেছি দেশ-বিদেশে। কিন্তু কোথাও তোমার দেখা মিলেনি। আজ তোমার অপরূপ সৌন্দর্য দেখে চোখ ফেরাতে পারলাম না। এই সেই তুমি, যাকে ৩১ বছর হন্যে হয়ে খুঁজেছি। সত্যি তুমি মায়াবিনী হৃদয়হরিণী। একটা প্রবাদ আছে, যাকে তুমি মন থেকে চাইবে, তাকে তুমি একদিন না একদিন ঠিকই পাবে। দেখো, আমি আমেরিকা থেকে ১ দিনের জন্যে এসেছিলাম আমিরাবাদ গোলাম কিবরিয়া স্কুলের প্রাক্তনদের ১ম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। বাড়িতে এসে দেখি চাচাত ভাগ্নে সাকিলের বিয়ে। আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে বরযাত্রী যাবে। আমাকে বরযাত্রীর সাথে যাবার জন্যে চাচাত ভাই ইসমাইল অনুরোধ করলো। আমি বরযাত্রীর সাথে গেলাম।
গ্রামের সুন্দর পরিবেশে বিয়ের আয়োজন। খাওয়াদাওয়াশেষে বাড়ির পেছনে তাকাতেই দেখি আমার সেই তুমি। দেখে মনে হচ্ছিলো তোমাকে জড়িয়ে ধরে থাকি কিছুক্ষণ। আহ্ কী শান্তি! তোমার পাশে কিছুক্ষণ বসে আমার কথা, আমার ভালোবাসার কথা বলে আসলাম। বেশিক্ষণ থাকতে পারিনি, কারণ আমাকে স্কুলে যেতে হবে প্রোগ্রামের আপডেট নিতে। চলে আসলাম তোমাকে ছেড়ে। জানি, তুমি মন খারাপ করেছো তোমাকে বেশিক্ষণ সময় দিতে পারিনি। লক্ষ্মীসোনা! আবার আসলে তোমাকে অনেক সময় দেবো। তোমার সাথে বসে বসে বসে গান ও কবিতা শোনাবো।
এতোক্ষণ যাকে নিয়ে লিখলাম তার নাম কস্তুরী ফুল (কচুরিপানা)। ইতিহাস থেকে জানতে পারলাম, কস্তুরীর বেগুনি রঙের অর্কিড-সদৃশ ফুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জর্জ মরগান নামে এক স্কটিশ ব্যবসায়ী ব্রাজিল থেকে সোনার বাংলায় নিয়ে আসেন ১৮৮৪ সালে।। আমার সোনার বাংলার আলো বাতাস ও ভালোবাসা পেয়ে কয়েক বছরের মাঝে দ্রুত এর বংশ বেড়ে যায়। সেই সময় তাকে আর ঘরে রাখা যায়নি। পরে সে ডোবা, নালা, খাল বিল, পুকুর, হাওর এমনকি নদীতে পর্যন্ত বসবাস করতে থাকে। তারপর কতো কাহিনি হয়েছে তাকে নিয়ে। ইংরেজ প্রশাসকেরা অর্থনীতি বাঁচাতে কচুরিপানা নিধনের উপায় খুঁজে বের করতে পূর্ব বাংলার কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক এবং ওয়াটার হায়াসিন্থ কমিটির সেক্রেটারি কেনেথ ম্যাকলিনকে দায়িত্ব দেন। তিনি ঢাকা এগ্রিকালচারাল ফার্মে ১৯১৬ সালে একটি গবেষণা করেন। তাতে জানা যায়, কচুরিপানা জৈব সার, পশু খাদ্য বা রাসায়নিক উপাদান তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে যখন পটাশের সংকট চলছিল, তখন মেসার্স শ’ অ্যান্ড ওয়ালেস অ্যান্ড কো নামের একটি কোম্পানি ১৯১৮ সালে ভারত সরকারকে কচুরিপানা শুকিয়ে কিংবা ছাই আকারে তাদের কাছে পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। ১৯২০ সালের মধ্যে প্রায় প্রতিটি নদ-নদী, খাল-বিল কচুরিপানায় ছেয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তৎকালীন প্রশাসন দ্বিধায় পড়ে যায় যে, তারা এই উদ্ভিদ নির্মূলে কাজ করবে না। এর লাভজনক ব্যবহারের বৈজ্ঞানিক উপায়ের ওপর জোর দেবে। এ নিয়ে ১৯২১ সালে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিজ্ঞানী ও উদ্ভিদবিদ স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। পরের এক বছরে তারা সাত দফা বৈঠক করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব বাংলায় কচুরিপানা মানুষের জন্যে হুমকিতে পরিণত হয়েছে। এজন্যে তারা কচুরিপানার ওপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা অব্যাহত রাখা এবং এর অর্থনৈতিক ব্যবহার বাড়ানোর ওপর জোর দেন। কিন্তু কচুরিপানার বিস্তার ঠেকাতে কী করা হবে সে বিষয়ে তারা সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। এমন অবস্থায় কচুরিপানার বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরিবর্তে এর নির্মূলের ধারণাটি গুরুত্ব পায়। এরপর ১৯৩৬ সালে ‘কচুরিপানা-বিধি’ জারি করে তৎকালীন সরকার। কচুরিপানা-বিধি অনুযায়ী, নিজ জমি বা দখলি এলাকায় কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কচুরিপানা পরিষ্কার অভিযানে সবার অংশ নেয়া বাধ্যতামূলক ঘোষণা করা হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার জেলা প্রশাসকরা স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে কচুরিপানা দমন কর্মসূচি হাতে নেন। সে সময় দেশপ্রেম ও উৎসাহ নিয়ে সাধারণ মানুষ এই কাজে যোগ দেয়। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কচুরিপানা উৎখাত শুরু হয়। তারপর ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানা মুক্ত করার অঙ্গীকার ছিলো। নির্বাচনে বিজয়ের পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তাঁর সরকার গঠন করেন এবং প্রথমেই ‘কচুরিপানা উৎখাত কর্মসূচি’ হাতে নেন। এরপর ১৯৩৯ সালের এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে তিনি ‘কচুরিপানা সপ্তাহ’ পালন করেন। নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের জন্যেই কচুরিপানার বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান চালিয়েছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। কচুরিপানার সমস্যা ১৯৪৭ সালের দিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কিন্তু পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি। এসব কারণে তখনকার গণমাধ্যমে কচুরিপানাকে ‘বিউটিফুল ডেভিল’ এবং ‘বেঙ্গল টেরর’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছিল।
যে তোমাকে (কচুরিপানা) একসময় নিধন করতে মানুষ মাঠে নেমেছিলো, প্রায় শতবর্ষ পরে এখন তা অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে এটি সার হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়। আজকাল কচুরিপানা থেকে বায়োগ্যাস তৈরি করে ফারমেন্টেশনের মাধ্যমে বায়ো-ফার্টিলাইজার প্রস্তুত করা হচ্ছে। যেহেতু এই উদ্ভিদে প্রচুর নাইট্রোজেন উপাদান রয়েছে, তাই এটি বায়োগ্যাস উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন কেউ তোমাকে আর মারার চিন্তা করে না। আসলে এভাবেই বেঁচে থাকে ভালোলাগা বা ভালোবাসার সবকিছু। ভালোবাসা চিরন্তন। তার মৃত্যু নেই। শত চেষ্টা করলেও ভালোবাসাকে মারতে পারবে না। সে বেঁচে থাকুক আমৃত্যু। কাউকে ভালোবাসলে তার খোঁজ খবর একটু নিতে হয়। তাই আমিও তোমার একটু খোঁজ খবর নিতে গিয়ে অনেক কিছু লিখে ফেললাম। রাগ করো না লক্ষ্মীটি আমার। ভালোবাসায় ভালো থেকো।
ড. আব্দুস সাত্তার : ওয়াশিংটন ডি সি।
রচনাকাল : ১২ মে ২০২৫।