প্রকাশ : ২২ জুন ২০২২, ০০:০০
চাঁদপুর কণ্ঠ ও আমি
উজ্জ্বল হোসাইন
দেখতে দেখতে চাঁদপুর কণ্ঠের ২৮ পেরিয়ে ২৯ বছরে পদার্পণ। চাঁদপুর জেলাবাসীর প্রিয় পত্রিকা দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ। সাপ্তাহিক থেকে প্রথম দৈনিক হিসেবে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ চাঁদপুর জেলায় আত্মপ্রকাশ করে। মনে পড়ে ১৯৯৯ সালে যখন চাঁদপুর সরকারি কলেজে সদ্য ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছি, কলেজ লাইব্রেরীতে গিয়ে পত্রিকা পড়া তখন একটি নেশার মতোই ছিলো। প্রতিদিন কলেজ লাইব্রেরিতে গিয়ে পত্রিকার টেবিলে যখনই পত্রিকা পড়তাম তখন জাতীয় দৈনিকের সাথে চাঁদপুর কণ্ঠ পত্রিকাটি না দেখলে মনে হতো যেন অনেক কিছুই অজানা থেকে যেতো। সেই থেকে ভালোলাগা-ভালোবাসার পত্রিকা প্রিয় চাঁদপুর কণ্ঠ। এরপর সাংস্কৃতিক সংগঠন করার সুবাদে পরিচয় হয় দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাতের সাথে। সেই পরিচয়ের পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সার্বক্ষণিকভাবে চিন্তাশীল একজন মানুষ। আসলে তাঁর ধ্যান-জ্ঞানে শুধুই চাঁদপুর কণ্ঠ ছাড়া অন্য কিছু নেই। সেজন্যেই তিনি চাঁদপুর কণ্ঠের মায়া ত্যাগ করে কখনো অন্য পত্রিকাতে পা বাড়াননি।
|আরো খবর
একটি জেলা শহরে এতোগুলো দৈনিক পত্রিকার মাঝে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা সবসময়ই চ্যালেঞ্জের বিষয়। চাঁদপুর কণ্ঠ সেই চ্যালেঞ্জটি নিয়েছে সবসময়ই। পত্রিকার কলেবরে কিছু না কিছু ব্যতিক্রমী জিনিস সব সময়ই সংযোজিত হয়েছে। আমি একজন কর্মী হিসেবে বলবো, চাঁদপুর কণ্ঠে প্রতিটি দিন প্রতিটি সংস্করণে কোনো না কোনো নতুনত্ব থাকে। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন এবং পাঠকপ্রিয়তার কারণেই চাঁদপুর কোর্ট স্টেশনের পাটোয়ারী নিউজপেপার এজেন্সিতে সকাল ১০ টার পরে আর চাঁদপুর কণ্ঠ খুঁজেই পাওয়া যায় না। অনেক পাঠককে বলতে শুনেছি, সকাল বেলা যদি চাঁদপুর কণ্ঠ না পড়ি তাহলে দিনের অনেক কিছুই জানা হয় না। সেজন্য সকালের নাস্তার টেবিলে অনেকেই চাঁদপুর কণ্ঠটিতে চোখ বুলিয়ে নেন একবার। এখানে বলে রাখা ভালো, বস্তুনিষ্ঠতা এবং পাঠকপ্রিয়তায় চাঁদপুর কণ্ঠে যে সমস্ত নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আছে তাদের প্রত্যেকেই নিজেদের স্থানে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তারই একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হলো, আমি যখন গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরি খুঁজছি, তখনই চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালের একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। প্রায় অর্ধ শতাধিক কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয় দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে। যথাযথ নিয়ম মেনেই আবেদন করি। আমার সাথে যে সমস্ত আবেদনকারী ছিলেন তাদের সাথে পরীক্ষা দিয়ে আমি লিখিত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করি। লিখিত পরীক্ষার রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার পর জানতে পারি যে, ভাইভা পরীক্ষায় অনেক লবিং হবে। সেহেতু উপায়ান্তর না দেখে চাঁদপুরে অনেক শুভাকাক্সক্ষীর কাছেই আমি গিয়েছি। তাদের কাছে আমার একটাই দাবি ছিল যে, আমি যদি পরীক্ষায় কোয়ালিফাই না করি তাহলে চাকরি না পেলেও আমার দুঃখ থাকবে না। কিন্তু সব মিলিয়ে যদি আমি প্রথম স্থান অধিকার করি তাহলে আমাকে যেন কেউ বাদ দিতে না পারে সেই ব্যবস্থাটি আপনারা করবেন। এই কথাটি আমি তৎকালীন চাঁদপুর ডায়াবেটিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব ডা এম এ গফুর, যুগ্ম সম্পাদক আলহাজ্ব মোস্তাক হায়দার চৌধুরী, সমিতির আজীবন সদস্য ও দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক জনাব কাজী শাহাদাতসহ আরো অনেককেই বলেছি।
সেদিনের সেই কথা আজও মনে পড়ে। লিখিত ও মৌখিক এবং ব্যবহারিক পরীক্ষায় আমি প্রথম স্থান অর্জন করি। যেহেতু প্রথম স্থান অর্জন করি সেহেতু আমাকে চাকরির জন্য নির্বাচিত করা হয়। সেই থেকে আমার কর্মস্থল চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতাল। ২০১২ সালের জুন মাসের ১৬ তারিখে চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালে যোগদান করি। অদ্যাবধি হাসপাতালের আইটি অফিসার হিসেবে নিয়োজিত রয়েছে। আমি মনে করি, সেদিন যদি চাঁদপুরের সেই সুধীজনরা না থাকতো তাহলে হয়তো আমার চাকরিটি হতো না। হাসপাতালে যেহেতু সকাল ৮ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত কর্মকাল। সেজন্যে পুরো একটি বিকাল শিল্প-সংস্কৃতি এবং আড্ডাবাজি করেই কাটিয়ে দিতাম। হঠাৎ একদিন মনে হলো, এভাবে আড্ডাবাজি করে তো আর সময় কাটবে না। বন্ধুদের সাথে আড্ডা এবং শিল্প-সংস্কৃতি আমার মূল কাজ নয়। আমাকে ভিন্ন একটি কাজ করতে হবে। তখন আমি চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাতের চাঁদপুর কণ্ঠ কার্যালয়ে গিয়ে আমার মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করি। আমি তাকে বলেছিলাম যে, আমি আপনার সাথে থাকতে চাই। তিনি আমাকে বলেছিলেন, তুমি আমার সাথে থাকতে চাও বুঝলাম না। তখন আমি বলেছিলাম যে, আপনার সাথে থাকতে চাওয়া মানে এই নয় যে, সব সময় আপনার আশেপাশে থাকা। আপনার সাথে থাকতে চাওয়া মানে আপনার সততা, নির্ভীকতা, একাগ্রতা, কাজের প্রতি দায়িত্বশীলতা এগুলো আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, সেজন্যে আপনার সাথে পত্রিকায় কাজ করতে চাই। যেহেতু আমি চাঁদপুর ডায়াবেটিক হাসপাতালে দুপুর ২ টার পর সারাটি বিকেল অবসরে থাকি সেহেতু আমি আপনার পত্রিকায় একটু সময় ব্যয় করতে চাই। তিনি আমাকে হেসে বললেন, তোমাকে আমি কোন্ জায়গায় রাখবো ? তুমি তো আর মাঠে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবে না। অফিসে কম্পিউটার অপারেটরও হতে পারবে না, তাহলে আমি তোমাকে কোন্ জায়গায় স্থান দিবো ? ঠিক আছে, তুমি যেহেতু বলেছ আমি ব্যাপারটি চিন্তা করে দেখি। এর কিছুদিন পরে চাঁদপুর কণ্ঠ বিতর্ক ফাউন্ডেশনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম স্বপন আমার সাথে দেখা করেন। তিনি আমাকে বলেন যে, উজ্জ্বল ভাই, শাহাদাত সাহেব বলেছেন আপনাকে কোন জায়গায় রাখবে এটি চিন্তা করে জানাবেন। নজরুল ভাইকেও আমি জানালাম যে, ভাই, আমি আসলে বিকেল বেলা অবসর থাকি, কিছু একটা করতে চাই। এর কিছুদিন পরে জনাব কাজী শাহাদাত স্বাক্ষরিত একটি চিঠি নজরুল ইসলাম স্বপন আমার কাছে নিয়ে আসেন। আমার হাতে দিয়ে বললেন, এটি আপনার নিয়োগপত্র। নিয়োগপত্রটি খুলে খুশিতে আমি আনন্দে আত্মহারা। বিকেলের অবসর সময় কাটানোর একটি পথ তৈরি হলো। নিয়োগপত্রে লেখা ছিল পার্ট টাইম সিস্টেম ডেভলপার হিসেবে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠে যোগদান। সেমতে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি চাঁদপুর কণ্ঠে যোগদান করি। আমার দায়িত্ব কর্তব্যে লেখা ছিল যে, চাঁদপুর কণ্ঠ অনলাইন ও মাঝে মাঝে সার্কুলেশন বিভাগে কাজ করা।
চাঁদপুর কণ্ঠ অফিসের প্রথম দিন যোগদানপত্র কাজী শাহাদাতের হাতে দেওয়ার সময় তিনি আমাকে বলেছিলেন, চাঁদপুর কণ্ঠ অনলাইনটি অনেক পুরানো হলেও তা নিয়ে ঠিকমত কাজ করার কাউকে পাই নি। যার হাতে এটির দায়িত্ব দিয়েছি কিছুদিন করার পর সে-ই ঝিমিয়ে গেছে। তুমি অন্তত সেটি করবে না এটি আমার বিশ্বাস আছে। আমি তখন কাজী শাহাদাত আংকেলকে বলেছিলাম যে, আমার প্রাণ থাকতেও চাঁদপুর কণ্ঠ ছেড়ে যাবো না। আমি যতদিন চাঁদপুরে অবস্থান করবো ততদিন আপনার সাথে কাজ করবো। কারণ আমি তো আপনার সাথেই থাকতে চেয়েছি। এরপরে আমাকে রেড ক্রিসেন্ট ভবনস্থ চাঁদপুর কণ্ঠ কার্যালয়ে দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষ দেওয়া হয়। যে কক্ষে লেখা ছিল সিস্টেম ডেভলপারের কক্ষ। সেখানে প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে আমাকে বসানো হয়। আমি অফিসে গিয়ে নিয়মিত অনলাইনটি নিয়ে কাজ করা শুরু করি। এগিয়ে নিতে থাকি প্রিয় দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ অনলাইনকে। চাঁদপুর কণ্ঠ অনলাইনের সাপোর্ট দিচ্ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা আইটি প্রতিষ্ঠান অরেঞ্জবিডি। চাঁদপুর কণ্ঠ বিষয়ে অরেঞ্জবিডিতে কয়েকবার যোগাযোগ করার পরে তারা আমার চাহিদা মতো কাজ করে দেন। কিন্তু বাদ সাধে অন্য জায়গায়। হঠাৎ একদিন চাঁদপুর কণ্ঠের কম্পিউটার বিভাগের ক’জন কম্পিউটার অপারেটর অঘোষিতভাবে একযোগে চলে যান। সেদিন প্রধান সম্পাদক মহোদয় আমাকে তাঁর কক্ষে নিয়ে বলেন যে, তারা তো নেই, কয়েকদিন তুমি চাঁদপুর কণ্ঠের কম্পিউটার বিভাগের দায়িত্ব নাও। আমি বললাম, ঠিক আছে আমি দায়িত্ব নেব। শুরু হলো একসাথে কম্পিউটার বিভাগে কাজ করা এবং চাঁদপুর কণ্ঠ অনলাইন নিয়ে কাজ করা। এরপর নতুনত্ব পেয়েছে চাঁদপুর কণ্ঠ অনলাইন টি। ভবিষ্যতে আরো নতুনত্ব আসবে।
এরপরে মনে মনে শুরু হলো নতুন মিশন। কীভাবে কম্পিউটারের মাধ্যমে পত্রিকার মেকআপ দেওয়া যায়। যেই কথা সেই কাজ। শুরু হলো কম্পিউটারে পেজ মেকআপ-এর কাজ। যেখানে আগে এমএসওয়ার্ডে ট্রেসিং বের করে পেস্টিং টেবিলে নিয়ে সেগুলো কেটে কেটে লাগানো হতো। সে পেস্টিং টেবিলের যুগের প্রথা বাদ দিয়ে শুরু করলাম নতুন অধ্যায়। সহকর্মী আলআমিন হোসাইন, মোস্তফা কামাল সুজন, কাজী আজিজুল হাকিম নাহিনকে সাথে নিয়ে শুরু করলাম ইলাস্ট্রেটরে পেজ মেকআপের কাজ। যেখানে চাঁদপুরের অনেক দৈনিক ঢাকায় নিউজ পাঠিয়ে দিয়ে তাদের পত্রিকা পাঠকের হাতে তুলে দেন, সেখানে চাঁদপুর কণ্ঠ একমাত্র পত্রিকা যে পত্রিকার পেজ মেকআপ ইলাস্ট্রেটর মাধ্যমে সম্পন্ন করে ব্যতিক্রমী ভাবে পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কারণ একটি পত্রিকার পেজ মেকআপ কী হবে এটি সম্পাদক যদি এক নজর না দেখেন তাহলে পত্রিকার মেকআপে অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যথাযথ নিউজ যথাযথ জায়গায় স্থান দেয়া যায় না। সেই কঠিন কাজটি চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত, বার্তা সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্লাহ সবসময়ই করে থাকেন। আর তাদের সাথে সহকর্মী হিসেবে আমরা সেগুলো পরিপূর্ণভাবে পালন করে পাঠকের হাতে তুলে দেই চাঁদপুর কণ্ঠ। এভাবেই পাঠকের হাতে পৌঁছে যায় প্রতিদিনের দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ। প্রতিটি নিউজের ট্রিটমেন্ট কীভাবে করতে হয় তা চাঁদপুর কণ্ঠ সঠিকভাবে পালন করে।
ইলাস্ট্রেটর পেজ মেকাপে শুধু খরচ সাশ্রয় হয়নি, হয়েছে সময় সাশ্রয়। পেজ মেকাপের কাজটি কঠিন হলেও পরের দিন যখন পত্রিকাটি পাঠকের হাতে পৌঁছে যায়, তখন সমস্ত কষ্ট ভুলে যাই।
ইলাস্ট্রেটরে পেজ মেকাপের কাজ প্রথমে আমরা পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করলেও এখন সেটিই হয়েছে আমাদের একমাত্র ভরসার স্থল। পত্রিকাটি সবসময় সাদাকালোতে মুদ্রিত হলেও মাঝে মধ্যে পত্রিকার পাঠকদের চাহিদার প্রেক্ষিতে সেটি রঙ্গিনে রূপান্তরিত করা হয়। আর এভাবেই এগিয়ে চলছে দৈনিক চাঁদপুর কণ্ঠ। চাঁদপুর কণ্ঠ শুধু ২৮ বছর কেন, শতবর্ষ অতিক্রম করবে-এই প্রত্যাশা করছি।