প্রকাশ : ০৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

পবিত্র কোরআনের সুরা বনি ইসরাইলের ২৩-২৪ আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ...পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো। তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উফ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না। তাদের সাথে বলো শিষ্টাচারপূর্ণ কথা। তাদের সামনে ভালোবাসার সঙ্গে, নম্রভাবে মাথা নত করে দাও এবং বলো হে পালনকর্তা, তাদের উভয়ের প্রতি রহম করো, যেমন তারা আমাকে শৈশবে লালন-পালন করেছেন।
আমরা মোনাজাতে যে দোয়া ‘রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানি সাগিরা’ উচ্চারণ করি, সে দোয়া তো আল্লাহতায়ালা উপরোল্লিখিত আয়াত দুটির শেষেই শিখিয়ে দিয়েছেন। বৃদ্ধ পিতা/মাতা বা উভয়ের প্রতি সন্তানদের দায়িত্ববোধকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে গিয়ে আল্লাহতায়ালা এ দুটি আয়াতে প্রায় সবটুকুই বলে দিয়েছেন। এমতাবস্থায় যদি পত্রিকায় দেখা যায়, ‘পুত্রের নির্যাতন সইতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা’ শিরোনামের সংবাদ, তখন কোন্ পাঠক ঘৃণা, ক্ষোভ ও নিন্দার প্রাবল্যে ভুগে না থাকেন ? সংবাদটিতে লিখা হয়েছে, অর্থ আত্মসাৎ, সম্পত্তির লোভের কারণে নিজের জন্মদাতা পিতা ও গর্ভধারিণী মাকেও রেহাই দিলো না পাষ- ছেলে। ছেলের নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে নিজ বসতভিটা ছেড়ে এখন মেয়েদের বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা। হামলার ঘটনায় আহত পিতা মুকবুল আহাম্মদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় মা বাধ্য হয়ে পুত্র ও পুত্রবধূর নামে আদালতে মামলা দায়ের করেন। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে আসা ছেলের হুমকি-ধমকিতে তারা আতঙ্কগ্রস্ত। এক প্রকার পালিয়ে মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। সন্তানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তার বিচার দাবি করেছেন তারা। ঘটনাটি হাইমচর উপজেলার আলগী দুর্গাপুর এলাকার হলেও বর্তমানে ফরিদগঞ্জে মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বৃদ্ধ পিতা-মাতা। ক’মাস পূর্বে ছেলের হাতে অমানবিক নির্যাতনের শিকার হওয়া বৃদ্ধ মুকবুল আহাম্মদ পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। বৃদ্ধ মুকবুল আহাম্মদ (৭০) ও তার স্ত্রী তাহেরা বেগম (৬৩) জানান, তাদের বাড়ি হাইমচর উপজেলার দক্ষিণ আলগী গ্রামে। সকল ছেলে-মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছয় ছেলে মেয়ের মধ্যে অভিযুক্ত ছেলে আতিকুর রহমান সবার বড়। সে গত কয়েক বছর ধরে তাদের ওপর অন্যায়ভাবে অত্যাচার করে আসছে। তাহেরা বেগম বলেন, আমার স্বামী একজন আবসরপ্রাপ্ত লোক, নিজে চলতে কষ্ট হচ্ছে। জমি ভাগ করে দেয়ার জন্যে এবং মেয়েদের শ্বশুর বাড়ি থেকে ধার নেয়া টাকা ছেলের কাছে ফেরত চাইলেই নির্যাতন শুরু হয় আমাদের ওপর। গত কয়েক বছর ধরে আমরা তার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। সর্বশেষ গত ২৫ জুন আমি এবং আমার স্বামী মুকবুল আহাম্মদ ছেলে আতিকুর রহমানের কাছে মেয়েদের পাওনা টাকা চাইলে ছেলে আতিক ও তার স্ত্রী আমাদের ওপর হামলা করে। পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করে আমার স্বামীকে। স্থানীয় লোকজন আমাদেরকে উদ্ধার করে প্রথমে হাইমচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। পরবর্তীতে অবস্থার অবনতি হলে চাঁদপুর ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করে। ছেলের অপকর্মের কারণে আর কোনো গত্যন্তর না হওয়ায় মা তাহেরা বেগম বাদী হয়ে চাঁদপুর জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা (সিআর ১১০/২০২৩) দায়ের করেন। পিতাকে নির্যাতনের কারণে বিজ্ঞ আদালত ছেলে আতিকুর রহমানকে জেলে পাঠায়। পরবর্তীতে ছেলে জামিনে বেরিয়ে আসে। তাহেরা বেগম জানান, জামিনে বেরিয়ে আসার পর থেকে ছেলে আতিকুর রহমান আরো বেপরোয়া আচরণ শুরু করেছে। আমাদেরকে মেরে ফেলার হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। তার হুমকি-ধমকিতে ভীত হয়ে আমরা বর্তমানে আমাদের মেয়েদের বাড়িতে থাকছি। গত বৃহস্পতিবার পূর্বের হামলার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়লে আমার স্বামীকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করাই। মুকবুল আহাম্মদ জানান, পিতা হয়ে সন্তানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ আমি ও আমার স্ত্রী। বর্তমানে আমরা আতঙ্কগ্রস্ত। বাধ্য হয়ে মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। এই কুপুত্রের বিচার চাই।
সমাজে কুপুত্র হিসেবে পরিচিত একজন আতিকুর রহমান কি এতোটাই শক্তিশালী যে, তাকে সমাজের মোড়ল, জনপ্রতিনিধি, সুধী-সজ্জন-সচেতন মানুষদের কেউই তার পিতা-মাতাকে নির্যাতন করার বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস পোষণ করেন না? যদি আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে কেউ উচ্চকণ্ঠ ও প্রতিবাদী হতেন, তাহলে হাইমচরের মুকবুল-তাহেরা দম্পতি এতোটা নির্যাতিত ও অসহায়ত্বে ভুগতেন না। পিতামাতার ভরণপোষণের বিষয়ে ও বার্ধক্যে তাদের প্রতি সন্তানদের ধর্মীয় ও আইনি দায়িত্ব রয়েছে। অতএব, আতিকুর রহমানের মতো কুপুত্রদের বিরুদ্ধে সমাজের অন্য সকলে রুখে দাঁড়ানোর মতো যথেষ্ট ফুরসত রয়েছে। সে ফুরসতকে কাজে না লাগিয়ে যারা নীরবতা পালন করেছেন বা করে চলছেন, তারা প্রত্যেকে যে আত্মঘাতী কাজ করেছেন বা করে চলছেন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সেজন্যে এমন কুপুত্রদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই হবে। এটি না হলে আতিকুর রহমানের মতো কুপুত্ররা সমাজে পিতামাতার প্রতি দায়িত্বহীনতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেবে, যা একসময় অপ্রতিরোধ্য হয়ে যাবে এবং ওই সমাজ চরমভাবে কলুষিত হবে। অতএব, সাবধান।