প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০
যাঁরা দৈহিক শ্রম দেয়ার চেয়ে মানসিক শ্রম বা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রম প্রদানে অগ্রণী বা পারঙ্গম, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী তাঁরাই বুদ্ধিজীবী। বাংলা একাডেমির ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীদের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা হলো-বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতি সেবী।
আজ ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শুধু এইদিনে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়নি, হত্যা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয় মাসেই। এ হত্যার কারণ সম্পর্কে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ’ গ্রন্থে যা সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হয়েছে, তা হচ্ছে-‘এটা অবধারিত হয়, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাদের রচনাবলির মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, শিক্ষালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা, প্রকৌশল, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে। একটি জাতিকে নির্বীজ করে দেবার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়া। ২৫ মার্চ (১৯৭১) রাতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতর্কিতে, তারপর ধীরে ধীরে, শেষে পরাজয় অনিবার্য জেনে ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হতে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রুত গতিতে।’
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন হানাদার পাক বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে বুদ্ধিজীবীরা প্রাণ হারান। এঁদের মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বও রয়েছেন। বাংলাপিডিয়া হতে প্রাপ্ত তথ্য মতে, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদ, ১৩ জন সাংবাদিক, ৪৯ জন চিকিৎসক ও ৪২ জন আইনজীবী রয়েছেন। এছাড়া সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও প্রকৌশলীসহ রয়েছেন ১৬ জন। ১৯৭২ সালে জেলাওয়ারি শহীদ শিক্ষাবিদ ও আইনজীবীদের যে আনুমানিক তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, শিক্ষাবিদদের মধ্যে সবচে’ বেশি খুলনা বিভাগে (২৮০), তারপর রাজশাহী বিভাগে (২৬২), চট্টগ্রাম বিভাগে (২২৪) ও ঢাকা বিভাগে (২০২) শাহাদাতবরণ করেছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের ২২৪ জনের মধ্যে চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া তথা তৎকালীন বৃহত্তর কুমিল্লায় সবচে’ বেশি শিক্ষাবিদ (৭৯ জন) পাক হানাদার ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
আমাদের চাঁদপুর জেলা প্রশাসন ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ১৯৭২ সালের তালিকা কিংবা সরকারের হালনাগাদ তালিকা থেকে চাঁদপুরের উল্লেখযোগ্য কারা রয়েছেন সেটা জানার চেষ্টা করা দরকার। জানার পর এঁদেরকে মরণোত্তর মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয়ার প্রয়াস চালানো বাঞ্ছনীয়। এর ফলে শহীদদের পরিবার, তাঁদের উত্তরসূরি, আত্মীয়স্বজন ও এলাকাবাসী আত্মশ্লাঘা বোধের সুযোগ পাবে। সবচে’ বড় কথা, বর্তমান ও উত্তর প্রজন্ম শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ থেকে প্রেরণা আহরণের সুযোগ পাবে।
আমরা মনে করি, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং বিজয় দিবসে জীবিত মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও মৃত মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে যে সংবর্ধনা দেয়া হয়, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠানেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়ে কিছু একটা করা দরকার। চাঁদপুর যদি এক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে, তাহলে অন্যান্য জেলাও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্থানিক মূল্যায়নে চাঁদপুরের দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করতে পারবে। আমরা এ ব্যাপারে চাঁদপুরের বর্তমান জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।